——
গত ৫ ই নভেম্বর ২০২৪ যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী ভারতীয় বংশোদ্ভূত বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস পরাজিত হয় এবং রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হয়।
২০২৫ জানুয়ারি ২০ তারিখে তিনি ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন।তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তার পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত কেমন হবে গনঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সেটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে মনে করা হচ্ছে না।কেননা তার পররাষ্ট্র নীতি নিজেদের স্বার্থ,অনুকূল বানিজ্য চুক্তি এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিকরণের দিকেই বেশি মনোযোগ দিবে।সেক্ষেত্রে তিনি তার পূর্বেই ঘোষিত ‘আমেরিকা ফার্স্ট ‘ নীতিকে প্রাধান্য দিবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন মেয়াদে চীন,ভারত,রাশিয়া এবং সামরিক জোট ন্যাটোর দিকে বেশি নজর রাখবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যান্য যে কোন সময়ের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থায় রয়েছে,তাই ট্রাম্প সেক্ষেত্রে চীনের দিকে বেশি নজর রাখবে। কেননা চীন তার অন্যতম প্রধান বানিজ্য প্রতিদ্বন্দ্বী সেক্ষেত্রে চীনের সাথে তার ২০১৬ পরবর্তী যে বানিজ্য যুদ্ধ ছিলো সেটি না হলেও চীনা পন্যের উপর ৬০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হবে বলা হচ্ছে।
ভারতের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় ভারতের দিকে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে।
যেহেতু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির দিকে বেশি নজর রাখবে তাই বাংলাদেশ তার কেন্দ্রবিন্দু হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাচনের পূর্বের তার ঘোষিত কিছু নীতি সমূহ পর্যালোচনা করলে সেই সম্ভবনা একদমই ফেলে দেওয়া যাবে না যে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশে খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রথমটি হলো অবৈধ অভিবাসী ট্রাম্প তার নির্বাচনের পূর্বেই ঘোষনা দিয়েছিলেন তিনি জয়ী হলে সকল অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করবেন।এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।কেননা বর্তমানে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র বসবাস করছে,তাদের মধ্যে কয়েক হাজার অবৈধ অভিবাসী ও রয়েছে যারা প্রতি মাসে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে।তাদের বিতাড়িত করলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে একটি প্রভাব পড়বে।২০১৭ সালে ট্রাম্প ১১ জন অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীকে বিতাড়িত করেছিলেন।
এছাড়াও আমেরিকা যদি তার ‘ ভারতের চোখে এশিয়া দেখা’ নীতি বহাল রাখে তাহলে সেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।নির্বাচনের পূর্বে গত ৩১ অক্টোবর ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘এক্স’ বাংলাদেশের হিন্দু ও সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নিয়ে মতামত শেয়ার করেছিলেন,যেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করবে।এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে তার হিন্দু ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে যাতে এটি নিয়ে ভুল তথ্যের মোকাবেলা করা যায়।তাই বাংলাদেশ সরকারের উচিত মার্কিন নীতি নির্ধারক ও আমেরিকান মিডিয়াকে জড়িত করার জন্য পদ্ধতি গ্রহন করা।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে সব থেকে বেশি দৃষ্টি থাকবে অর্থনীতিতে।বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বানিজ্য সম্পর্ক রয়েছে।বাংলাদেশ বছরে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি এবং ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আমদানি করে।তবে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বানিজ্য সম্পর্ক না থাকায় এক্ষেত্রে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে না।বরং চায়নার পন্যের উপর শুল্কহার বৃদ্ধি করলে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে বানিজ্য বৃদ্ধি পেতে পারে।তবে এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
এফডিআই,অর্থ সহায়তার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি শীর্ষ অংশীদার।বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও ইউএস এইড দেওয়া হয়েছে।তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি তার অভ্যন্তরীন অর্থনীতিতে মনোযোগী হয় তবে সেই সহায়তা কমে যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা রয়েছে।যেটি আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহ দেশের সার্বিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে।এছাড়াও বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সব থেকে বেশি সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে।যদি তারা এই খাতে অর্থ সহায়তা কমিয়ে দেয় তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা রক্ষণাবেক্ষণকে কঠিন করে তুলবে।যেটি আমাদের জন্য অনেক বড় একটি চ্যালেন্জ হয়ে দাড়াবে।
পরিবেশগত চুক্তির প্রতি অনীহা, অর্থ সহায়তা কমিয়ে দেওয়া,প্যারিশ জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেন্জ।জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্ব দায়ী হলেও এটির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের মতন তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর উপর।বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ঝুকিপূর্ণ দেশ গুলোর তালিকায় প্রথম সারিতে রয়েছে।এক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন যদি জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়,অর্থ সহায়তা কমিয়ে দেয় তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।বাংলাদেশ তার অভিযোজনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ পাবেনা।এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে ২৮% অর্থ সহায়তা করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।অর্থনৈতিক দূরাবস্থা কারনে যদি ট্রাম্প প্রশাসন অর্থ সহায়তা কমিয়ে দেয় তাহলে সেটিও হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেন্জ।কেননা বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী মিশনে সৈন্য পাঠানো দেশ গুলোর তালিকায় শুরুর দিকে অবস্থান করে।সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে তাই যদি অর্থপ্রবাহ কমে যায় তাহলে আমাদের অর্থনীতিতে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তাই বাংলাদেশের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আমাদের বিনিয়োগ নীতিমালা গুলো আরো সহজ করা।যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আমার বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া।চীনের সাথে প্রযুক্তিগত বিষয়ে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে।এবং কোন একক বলয়ে না গিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা।এছাড়াও যেহেতু ভারতের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বার্থগত জায়গা থেকে ভালো সম্পর্ক রয়েছে তাই ভারতের সাথেও আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
মোঃ- মেহেদী হাসান,আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।