ঢাকাশনিবার , ২০ এপ্রিল ২০২৪
  1. সর্বশেষ

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

আবু নাসের ইরফান :

হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর পরবর্তী সময়ে তার প্রচারিত ইসলামকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন সূফী সাধকরা। তারা নিজেদের জীবনকে সংকটাপন্ন করে সুদূরে পাড়ি জমিয়েছেন এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন যথাযথভাবে। আল্লাহর ইচ্ছাই তাদের ইচ্ছায় পরিণত হয়েছে। তেমনি এক মহান সাধক হলেন হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ)। তিনি ধর্মাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তার সাধনার মাধ্যমে এই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আল্লাহ ও রাসুলের ধর্মকে।

সুলতান-উল-হিন্দ, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী হলেন চিশতীয় ধারার ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি ১১৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন ও ১২৩৫ সালে পরলোকগমন করেন। তিনি গরিবে নেওয়াজ নামেও পরিচিত। মইনুদ্দিন চিশতীই উপমহাদেশে প্রথম এই ধারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেন। তিনি ভারতে চিশতী ধারার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ধারা বা সিলসিলা এমনভাবে পরিচিত করেন ; পরবর্তীতে তার অনুসারীরা যেমন, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, বাবা ফরিদ, নিজামুদ্দিন আউলিয়া সহ (প্রত্যেকে ক্রমানুযায়ী পূর্ববর্তীজনের শিষ্য) আরো অনেকে ভারতের ইতিহাসে সুফি ধারাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

প্রারম্ভিক জীবনঃ
ধারণা করা হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী ৫৩৭ হিজরী/১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পারস্যের শকস্থান রাজ্যের চিশতীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্যে বেড়ে উঠেন। পনেরো বছর বয়সে তার পিতা-মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার পিতার কাছ থেকে একটি বাতচক্র ও একটি ফলের বাগান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। একদিন তিনি তার ফলবাগানে জল দিচ্ছিলেন তখন তার ফলবাগানে আসেন বিখ্যাত সুফি শেখ ইবরাহিম কুন্দুজী। যুবক মইনুদ্দিন তটস্থ হয়ে যান এবং কুন্দুজীকে কিছু ফল দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এর প্রতিদানস্বরূপ কুন্দুজী মইনুদ্দিনকে এক টুকরা রুটি দেন ও তা খেতে বলেন। এর পর তিনি তার সম্পত্তি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করে দেন। এরপর তিনি বিশ্বের মায়া ত্যাগ করে জ্ঞানার্জন ও উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।তিনি ইরাকের বাগদাদে আবদুল কাদির জিলানীর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। তার জীবনীতে বর্ণিত আছে যে, এ সময় আব্দুল কাদির জিলানী তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েক শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। তিনি আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন।

সুফি দীক্ষাঃ
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। সেখানে চিশতীয়া তরীকার অপর প্রসিদ্ধ সুফি সাধক খাজা উসমান হারুনীর নিকট মুরীদ হন/শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার সেবায় ২০ বছর একাগ্রভাবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে উসমান হারুনী তাকে খিলাফত বা সুফি প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেন।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে কিংবদন্তিতুল্য একজন ঐতিহাসিক সুফি ব্যক্তিত্ব। তিনি স্বীয় পীর উসমান হারুনীর নির্দেশে ভারতে আগমন করে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তারই মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থ হল “আনিসুল আরওয়াহ”।

চিশতীয়া তরিকাঃ
হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ )-এর প্রতিষ্ঠিত তরিকাকে বলা হয় চিশতীয়া তরিকা। চিশতীয়া তরিকার আদি মুর্শিদ হলেন হযরত মুহম্মদ (দঃ)। রাসুল (দঃ)-এর আধ্যাত্মিক শিক্ষা হযরত আলী (কঃ) হয়ে হাসান-আল-বসরীর মাধ্যমে অধীনস্ত সিলসিলায় বয়ে এনেছে। চিশতীয়া তরিকার চিশতী উপাধি প্রথম শুরু হয় হযরত খাজা আবু ইসহাক শামী চিশতী থেকে। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী ছিলেন।

ভ্রমণঃ
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী বহু দেশ ভ্রমণ করেন। তৎকালীন বিভিন্ন জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য সুফি সাধকের সাথে সাক্ষাত করেন বলে নানা গ্রন্থে তথ্য পাওয়া যায়।
তিনি তাঁর মুর্শিদের আদেশে আফগানিস্তানের চিশতী নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। এখান থেকেই তিনি তাসাউফ ও সিলসিলার প্রচার-প্রসার শুরু করেন। চিশতীয়া উপাধি এখান থেকেই শুরু হয়। খাজা বাবা এই তরিকায় সূত্রবদ্ধ হয়ে তরিকার দায়িত্ব পালনের ভার নেন। তাই তিনি এই তরিকার ইমাম ও কুতুব। তিনি ১১৮৫ খ্রিঃ/৫৮১ হিঃ সালে ভারতবর্ষে আগমন করে ইসলামের তওহিদ, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রচার করেন। চিশতিয়া তরিকার ইমাম ও কুতুব হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) ১১৪২ খ্রিঃ /৫৩৬ হিঃ সালে ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী জেলার সানজারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ গিয়াস উদ্দীন সঞ্জরি (রহঃ) এবং মাতার নাম সৈয়্যেদা উম্মেওয়ারা বিবি (রহঃ)। তিনি পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয়দিক থেকেই ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের বংশধর। খাজাবাবা খাজা উসমান হারুনীর খেদমতে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘসময় তিনি তার মুর্শিদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন।
মুর্শিদের সান্নিধ্যে তিনি অনেক স্থান ভ্রমণ করেন এবং অনেক গুণী সাধক কামেলদের সান্নিধ্য লাভ করে মারেফতের তত্ত্ব সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞানলাভ করেন। খাজা বাবা (রহঃ) তাঁর মুর্শিদ কেবলার সঙ্গে হজব্রত পালন শেষে মদিনায় গমন করেন। মদিনায় স্বীয় মুর্শিদ হযরত খাজা ওসমান হারুনী তাঁকে রাসুলের হাতে সঁপে দেন। নবীজী খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ)-কে হিন্দুস্থানে গিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য নির্দেশ দেন। খাজা উসমান হারুনী (রহঃ) তাঁর প্রিয় শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে মদিনা থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশে মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় তরিকতপন্থীদের ইমাম, হাকিকত বিশারদ, আউলিয়াকুল করা হয়। পরে ওহাবি আন্দোলনে তাঁর মাজারসহ সকল মাজার নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। মুর্শিদের ওফাতের পর খাজাবাবা দারুণ ব্যথিত হৃদয় নিয়ে হিন্দুস্থানের পথে রওনা হন। খাজাবাবা হিন্দুস্থান আসার পথে লাহোরে হুজুর বেরীর (রহঃ) (দাতা গঞ্জে বখশ) মাজারে ধ্যান ও এতেকাফ ইবাদত করে কিছুকাল অবস্থান করেন। খাজাবাবা (রহঃ) হুজুর বেরীর (রহঃ) দরজায় দুছত্র ফারসি কবিতা লিখেছিলেন যা আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে সকলে পড়ে থাকেন। কবিতাটি হলো ‘গঞ্জে বখশ জগতের প্রেরণা ও খোদার নূরে। (তিনি অসামর্থ্যদের পীরে কামেল আর কামেলদের পথপ্রর্দশক।’) লাহোর ত্যাগ করে তিনি দিল্লি ও পরে রাজপুত শক্তির কেন্দ্রবিন্দু আজমিরে আস্তানা করেন। খাজা বাবার অপার মহিমায়, মানব প্রেম ও চারিত্রিক মাধুর্যে মোহিত হয়ে হিন্দু প্রভাবশালীদের প্রবল বাধা বিপত্তির মধ্যেও দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকে। এতে হিন্দু রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে খাজাবাবাকে আজমির ত্যাগের নির্দেশ দেন। খাজাবাবা ঐ সময় বলেছিলেন ‘আমি পৃথিবীর রাজকে জীবিত বন্দী করে শিহাবুদ্দীন ঘোরীর হাতে তুলে দিলাম।’ তাঁর এই ভবিষদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এভাবে ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্ব কায়েম হয়। ভারতবষের্র দিল্লি ও আজমির মুসলিম শাসনে আসার পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে সূফী সাধক, দরবেশ ফকিররা ভারতবর্ষে এসে ইসলাম প্রচার করেন। এঁদের মধ্যে প্রায় সবাই খাজাবাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর দোয়া ও অনুমতি নিয়ে দূর-দূরান্তের বিশেষ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন এবং বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করে জীবনপাত করেছেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) এক মহান মুবান্নিগ। যাঁর প্রচেষ্টার ফসল হলো ভারতবর্ষে ইসলামের সূর্যের উদয়। এবং উদয়ের ফলান্তে এদেশের মানুষ ইসলামের শান্তি লাভ করে। শরিয়ত-মারেফতের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সত্যিকারের পথ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ প্রাপ্তি হয়। চিশতীয়া তরিকার উত্থান বহুপূর্বে হলেও ভারতবর্ষে খাজাবাবা এই তরিকায় দিয়েছেন এক নতুন পরিচিতি। তিনি তরিকতের সাধনায় মানুষকে দিয়েছেন প্রকৃত মুসলমান হওয়ার শিক্ষা। খোদার পথের সাধনায় প্রথমে মানুষের ৩টি বিষয় রপ্ত করতে হবে ‘মানব প্রেম, সত্যিকারের মানবতা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, অন্তর্ধ্যানে স্মরণে রাখা।’ এই বিষয়ে সর্বদাই নিজেকে নিয়োজিত রেখে তরিকার সাধনা করতে হবে। হযরত মুহম্মদ (দঃ) থেকে হযরত আলী এবং হযরত আলী থেকে হাসান বসরী এই তালিম লাভ করেন। সিনা -ব-সিনায় চলে আসা এই তালিম হযরত ওসমান হারুনীও লাভ করেন। এই তালিমগুলো লিপিবদ্ধ ছিল না। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রহঃ) সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করেন।

চিশতীয়া তরিকার শাজরা শরিফঃ
* হয়রত মুহম্মদ (দঃ) ১) হযরত আলী (কঃ) ২) হযরত হাসান বসরী (রাঃ) ৩) হযরত আবদুল ওয়াহেদ (রঃ) ৪) হযরত খাজা ফজর (রঃ) ৫) হযরত ইব্রাহিম ইবনে আদম বালখী (রঃ) ৬) হযরত খাজা হোবায়ারা (রঃ) ৭) হযরত খাজা মোমশাদ (রঃ) ৮) হযরত আবু এহছাক (রঃ) ৯) খাজা আঃ এবনে ছামায়ান (রঃ) ১০) খাজা মোহম্মদ (রঃ) ১১) খাজা নাসিরউদ্দীন (রঃ) ১২) খাজা মওদুদ চিশতী (রঃ) ১৩) কাজা হাজি শরীফ জেন্দান (রঃ) ১৪) খাজা ওসমান হারুনী (রঃ) ১৫) খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ) এই তরিকা মতে আব, আতশ, খাক, বাদ (পানি, আগুন, মাটি, বায়ু, এবং নুর (জ্যোতি)-কে আনাসির-এ খামসা বা পঞ্চভূত বলে। সমুদয় জড়বস্তু ও জড়দেহে (প্রাণী দেহে) আনাসিরে আর্বা যেমন পানি, আগুন, মাটি ও বায়ুর সংমিশ্রণ ঘটেছে। আর চতুর্ভূতের মূলে রয়েছে নূর বা এক জ্যোর্তিময় সত্তা।

খেলাফত প্রদানঃ
তিনি কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকীকে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।

খাজা বাবার সিফাতঃ
প্রত্যেক আনাসির বা ভূতে পাঁচটি করে সিফাত অথবা গুণ বিদ্যমান রয়েছে। তা আবার তিন শ্রেণীতে বিভক্ত; যথা আহাদিয়াত, ওয়াহাদাত, ওয়াহেদিয়াত। নিজকে জানার তথা দেহতত্ত্বের তালিম থেকে এর পরিচিতি লাভ করা যায়। এই তালিমের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত না হওয়া পর্যন্ত কেউ চিশতীয়া তরিকায় সিদ্ধিলাভ করতে পারে না অথার্ৎ সূফী দরবেশ হতে পারে না। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী কাদেরিয়া তরিকায় কলেমার তালিম নিয়েছিলেন বলে কেউ কেউ চিশতীয়া তরিকার সঙ্গে সঙ্গে কাদেরিয়া তরিকার তালিমও রপ্ত করে থাকেন। নকতাবিহীন বার বর্ণ বিশিষ্ট কালেমা তাকওয়ার তাৎপর্য ও হাকিকতের পরিচিতি লাভই কাদেরিয়া তরিকার সার্থক তালিম। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী মানুষের মাঝে যে উপদেশের বাণী রেখে গেছেন তা শুধু তরিকতপন্থীদের নয় সকল মানুষের জীবনের পাথেয় হওয়া উচিত।

মহামুল‍্যবান বানীঃ
তিনি বলেছেন- * কোনো মুসলমান ভাইকে হেয় জ্ঞানে উৎপীড়নে যে ক্ষতি হয়, অন্য কোনো পাপ কাজে মানুষের সেই পরিমাণ ক্ষতি হয় না। *কেয়ামতের আজাব থেকে মুক্তি পেতে হলে বিপন্ন, দুস্থ ও উৎপীড়িতদের খেদমত করতে হবে। অভাবগ্রস্তদের অভাব মোচন করে এবং ক্ষুধার্তদের আহার প্রদান করে। * দানশীলতা নেয়ামতের চাবি। *তিনি প্রকৃত আরেফ যিনি কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে খালি হাতে ফেরান না। * নেককার ব্যক্তির সংশ্রব নেক কর্ম থেকে উত্তম। পক্ষান্তরে পাপকর্ম থেকে ব্যক্তির সংশ্রব অধিকতর মন্দ। * আ্ল্লাহ পাক যাদের ভালোবাসেন তাদের মাথার ওপর বারিধারার মতো বিপদ বর্ষণ করেন। * পৃথিবীতে প্রত্যেক জামানায় হাজার হাজার অলি-আল্লাহ বিদ্যমান থাকেন। তাদের অনেকেই থেকে যান দৃষ্টির আড়ালে। সুতরাং পৃথিবীকে কখনই আউলিয়া শূন্য মনে করো না। * সর্বাবস্থায় বদনে প্রশান্তি এবং হাসির আভা বিদ্যমান থাকা আরেফ ব্যক্তিদের অন্যতম লক্ষণ। * আরেফের মস্তকে বিরামহীনভাবে নূর বর্ষিত হয়। * নীরবতা আরেফের স্বভাব। * আরেফ ঐ ব্যক্তি যিনি নিজেরে হৃদয়কে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের আকর্ষণ থেকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর হাজার হাজার তাজাল্লি তার ওপর বিকশিত হয়। * তিনটি বস্তুর মাধ্যমে ইমানের পরিপূর্ণতা লাভ হয়। আল্লাহ ভীতি, আল্লাহপ্রাপ্তির কামনা, আল্লাহর প্রেম। * তারাই প্রকৃত প্রেমিক, যাদের হৃদয় প্রতি মুহূর্তে জিকিরে নিমগ্ন থাকে, কিন্তু মুখ দেখে তা বোঝা যায না। * তরিকতপন্থীদের জন্য ৫টি জিনিস দেখা এবাদত হিসেবে গণ্য মাতাপিতাকে দেখা, কুরআন শরিফ দেখা, আলেমে রব্বানীকে দেখা, বায়তুল্লাহ শরিফ দেখা, স্বীয় মুর্শিদকে দেখা।

কেরামাতঃ
খাজা বাবার প্রত্যেকটি কার্যক্রম ছিল অলৌকিকতায় ভরপুর। খাজা গরীবে নেওয়াজ (রঃ) এর জীবদ্দশায় আজমিরবাসীগণ হজ্জ সমাপনান্তে প্রত্যাবর্তন করে প্রায়শঃ বলতো “হুজুর, কা’বা শরীফ হতে কখন আজমিরে আগমন করেছেন?” উপস্থিত লোকজন প্রত্যুত্তরে বলতো “তিনি এ বছর হজ্জে গমন করেননি।” হজ্জ হতে প্রত্যাবর্তনকারীগণ বলতো, “তাকে আমরা অক্ষ খাজা বাবাকে কা’বা শরীফ তাওয়াফ করতে দেখেছি। উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তিনি রাতে সশরীরে খানায়ে কা’বা প্রদক্ষিণ করতেন এবং ভোরে আজমিরে উপস্থিত হয়ে বা জামায়াতে ফজরের নামাজ আদায় করতেন।
একদিন গরীবে নেওয়াজ (রহঃ) সফররত অবস্থায় সাতজন অগ্নি উপাসকের একটি দলকে অগ্নিকুন্ডের পাশে পুজারত অবস্থায় দেখেন, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। অগ্নি উপাসকগণ হযরতের নূরাণী চেহারা দেখামাত্র তার পায়ে জড়িয়ে ধরেন। খাজা সাহেব তাদের অগ্নিপুজার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, “হুজুর আমরা নরকের আগুন হতে রক্ষা পাবার জন্য, এর পুজা করে আসছি।” তাদের জবাব শুনে খাজা বাবা (রহঃ) বলেন, “ওহে বোকার দল। খোদার আদেশ ব্যতীত আগুনের কোনরূপ কর্মশক্তি নাই। যে প্রভূর আদেশে আগুন কর্মক্ষম, তার উপাসনা না করে কেন তার সৃষ্টির উপাসনায় মত্ত রয়েছ?” আগুনের পূজারিগণ খাজা বাবা (রঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, তাহলে আগুন কি আপনার ক্ষতি সাধন করতে পারে না? উত্তরে খাজা সাহেব বললেন, “মঈনুদ্দীনের কথা রাখ, খোদার হুকুম ব্যতীত তার পায়ের জুতারও কোনরূপ ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।” এ কথা বলার সাথে সাথে খাজা বাবা নিজের জুতা জোড়া অগ্নিকুন্ডে ফেলে দিলেন। কিছুক্ষণ পর সবাই দেখল যে খাজা সাহেবের জুতা জোড়া বহাল রয়েছে আগুনে স্পর্শ করেনি। উক্ত আগুনের পূজারিগণ খাজা সাহেবের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে গভীর আস্থার সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বহুদিন পর্যন্ত তারা খাজা সাহেবের কাছে অবস্থান করেন।
একবার এক বৃদ্ধ লোক খাজা সাহেবের দরবারে এসে নগরীর হাকিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলল, “হুজুর নগরীর হাকিম অন্যায়ভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করে আমাকে পুত্রহারা করেছে। তার বিয়োগ ব্যথা আমি সহ্য করতে না পেরে আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে এর একটা বিহিত ব্যবস্থা করুন। খাজা (রঃ) তখন ওজুরত অবস্থায় ছিলেন। বৃদ্ধের এ কথা শুনে তার দয়ার সাগর উথলিয়ে উঠল। নিজের লাঠিখানা হাতে নিয়ে বৃদ্ধের বাসগৃহে যান। মৃত যুবকের কাছে উপস্থিত হয়ে তিনি কিছুক্ষণ মৌণভাব অবলম্বন করেন। উপস্থিত জনগণ, সাথী খাদেমগণ এবং বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পরবর্তী ঘটনা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। অল্পক্ষণ পরে খাজা সাহেব মৌণতা ভঙ্গ করে খন্ডিত মস্তক শরীরের সাথে যুক্ত করে যুবককে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে যুবক! তুমি যদি সত্যিই নিরপরাধ হও, তবে খোদার হুকুমে জিন্দা হও।” উপরোক্ত বাক্য উচ্চারণের সাথে সাথে নিহত যুবক কালেমা শরীফ পাঠ করতে করতে দাঁড়িয়ে গেল। পিতার হাতে পুনরুজ্জীবিত ছেলেকে অর্পন করে তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে স্বীয় আস্তানায় ফিরে আসেন।

মৃত্যুঃ
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সুবহে সাদেকের সময় ইন্তেকাল করেন। তখন তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। গরীবে নেওয়াজের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী (রহঃ) তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার খাকী (রহঃ) কে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। প্রতিবছর ১লা রজব হতে ৬ রজব পর্যন্ত আজমির শরীফে খাজা বাবার মাজারে অনুষ্ঠিত হয় ওরস মোবারক।

কুরআন ও হাদীসঃ
আল কুরআনে বর্ণিত আউলিয়ায়ে কেরামের দুশমনদের প্রতি মহান রবের হুশিয়ারীঃ ‘‘জেনে রেখো! আল্লাহ’র অলি বা বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না।’’ সহিহ বুখারীতে বর্ণিত হুশিয়ারীঃ “যে ব্যক্তি আমার কোন অলি বা বন্ধুর সঙ্গে দুশমনি রাখবে, আমি (আল্লাহ) তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব।”

সূনানে ইবনে মাজাহ তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ ﷺ এঁর হুশিয়ারীঃ আল্লাহ্‌র কসম! কোন ব্যক্তির অন্তরে ঈমান প্রবেশ করতে পারে না যতক্ষণ সে আল্লাহ্‌’র সন্তুষ্টির জন্য এবং আমার সাথে তাদের আত্মীয় সম্পর্কের কারণে তাঁদেরকে (আহলে বাইতকে) ভালোবাসবে না।

সহিহ বুখারীতে বর্ণিত আবূ বকর সিদ্দিক (রাঃ) এঁর উপদেশবাণীঃ মুহাম্মাদ ﷺ এঁর পরিবার পরিজনের (আহলে বাইত) প্রতি তোমরা অধিক সম্মান প্রদর্শন করবে। মুহাম্মাদ ﷺ এঁর সন্তুষ্টি, তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্জন কর।

সূরা মায়িদাহ এর ৩৫ নং আয়াতে আমার আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ওহে যারা ঈমান এনেছ! আল্লাহকে ভয় কর, উসিলা (তাঁর নৈকট্য লাভের উপায়) অন্বেষণ কর এবং তার পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”

আজকের এই ওরশবার্ষিকীতে মহান রবের নিকট ফরিয়াদ, আল্লাহ তায়ালা যেন খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরি রাঃ এঁর উসিলায় আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন, উঁনার রুহানী ফুয়ুজাত হাসিল করার তাওফিক দান করেন এবং মৃত্যু অবধি কুরআন-সুন্নাহ-আহলে বাইত ও সুফিয়ায়ে কেরামের রশি আঁকড়ে ধরে থেকে পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার তাওফিক দান করেন।

বিদায় হজ্জে মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি গাদিরে খুম নামক স্থানে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ তোমাদের কাছে আমি এমন (দুটি) জিনিস রেখে যাচ্ছি যা তোমরা শক্তরূপে আঁকড়ে ধরলে আমার পরে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। তার একটি অন্যটির তুলনায় বেশি মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণঃ (একটি হল) আল্লাহ তা’আলার কিতাব যা আকাশ হতে মাটি পর্যন্ত দীর্ঘ এক রশি এবং (অন্যটি) আমার আহলে বাইত। এ দুটি কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না কাউসার নামক ঝর্ণায় আমার সঙ্গে একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত। অতএব তোমরা লক্ষ্য রেখ আমার পরে উভয়ের সঙ্গে কিভাবে আচরণ কর। (সূনান আত তিরমিজী ৩৭৮৮)

মাওলা আলী আঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেনঃ মাহ্দী (আ.) আমাদের আহলে বাইত থেকে হবে। আল্লাহ তা‘আলা তাকে এক রাতে খিলাফতের যোগ্য করবেন। (সূনানে ইবনে মাজাহ ৪০৮৫)

সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব রা. বলেন, আমরা উম্মু সালামাহ (রাঃ) এর নিকট বসা ছিলাম। আমরা পরস্পর মাহ্দী (রা.) সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বলতে শুনেছিঃ মাহ্দী ফাতেমা আঃ এঁর বংশধর। (সূনানে ইবনে মাজাহ ৪০৮৬)
হে আল্লাহ,

“আমাদেরকে সোজা পথে (সিরাতে মুস্তাকিম) পরিচালিত কর। তাঁদেরই পথে, যাঁদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছো। তাদের পথে নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

6,262 Views

আরও পড়ুন

রাবিতে গ্রীন ভয়েস এর ১৯ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

লেখক জুবায়েদ মোস্তফার নতুন কবিতা–“খরার দিনে আগমন”

নাগরপুরে প্রাণীসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত 

শেরপুরে কুড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদককে কুপিয়েছে প্রতিপক্ষ

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবি মহাপরিচালক !!

মহেশখালীর পঙ্গু নুর আলমের ভাতা হ্যাকারদের পেটে!

বুটেক্সে আন্ডারগ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি শুরু ৮ মে

মেহেরপুরে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উদযাপন

লোহাগাড়ায় বহুতল ভবন থেকে পড়ে শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু

বগুলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির নির্বাচন সম্পন্ন

মহেশখালীতে ভাইচ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জহির উদ্দিনের প্রার্থীতা স্থগিত

দেওড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ‘এক্স স্কাউট রি-ইউনিয়ন’ আয়োজিত