মো:গোলাম কিবরিয়া সিয়াম, বুটেক্স প্রতিনিধি
২০২০ সালের মার্চ মাস। দেশে হঠাৎ করে শুরু হয় কোভিড-১৯ জনিত লকডাউন। থেমে যায় শিক্ষা কার্যক্রম, পিছিয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের হাতে এসে পড়ে অফুরন্ত অবসর। সেই সময়েই মোবাইল স্ক্রল করতে করতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থী অন্বয় দেবনাথের নজরে আসে একটি নতুন উদ্যোগ—‘সায়েন্স বী’। সদ্য চালু হওয়া এই প্ল্যাটফর্মের সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে তিনি জানতে পারেন, এটি বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে কাজ করছে।
বাবার চাকরি সূত্রে অন্বয়ের শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন গ্রামে। সেই সময় কাছ থেকে দেখেছেন গ্রামীণ স্কুলগুলোর দুরবস্থা। পরবর্তীতে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে পড়তে এসে অন্বয় উপলব্ধি করেন ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে শহর ও গ্রামে শিক্ষার মানে কতটা পার্থক্য। অনেক স্কুলে প্রশ্ন করলে সন্তোষজনক উত্তর মেলে না, বইয়ের বাইরে পড়াশোনায় উৎসাহ নেই। এমনকি অনেকে স্কুলজীবনের শেষ পর্যন্ত কখনও বিজ্ঞান পরীক্ষাগার ব্যবহার করতেই পারেনি ল্যাব বন্ধ কিংবা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে।
এই অভিজ্ঞতা অন্বয়ের মনে দেশের জন্য কিছু করার বাসনা জাগায়। আর সে বাসনার সঙ্গেই যেন মিলে যায় সায়েন্স বী’র উদ্দেশ্য। তাই সময় নষ্ট না করে তিনি সদস্য হিসেবে যোগ দেন। সময়ের সঙ্গে কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও দক্ষতায় তিনিই এক সময় প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হন। চার বছর কনটেন্ট প্রোডাকশন হেড হিসেবে কাজ করার পর বর্তমানে তিনি হেড অব অপারেশন হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সায়েন্স বী: সূচনা থেকে সাফল্যের পথচলা
২০১৮ সালে ‘সায়েন্স বী’র সূচনা হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মবিন সিকদার। পরবর্তীতে অন্বয় দেবনাথ (বুটেক্স) এবং সাদিয়া বিনতে চৌধুরী (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী) সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত হন। বর্তমানে ‘সায়েন্স বী’ বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সবচেয়ে বড় এডটেক স্টার্টআপ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।”
মূল উদ্যোগ ও কার্যক্রম
তারা নিজেদের ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ১০০০+ বিজ্ঞানসংবাদ, ৭০০+ ব্লগ, ও ৩০,০০০+ প্রশ্নোত্তর সংযুক্ত করেছেন। প্রকাশিত ৫টি ইবুক সম্মিলিতভাবে পড়েছেন ৩ লাখেরও বেশি পাঠক। বর্তমানে তাদের ওয়েবসাইটে ৫ লাখের বেশি নিবন্ধিত সদস্য এবং প্রতি মাসে প্রায় ২ লাখ ভিজিটর রয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম:
৩টি ফেসবুক গ্রুপ:
“সায়েন্স বী – বিজ্ঞান গ্রুপ”
“এই পোস্টে বিজ্ঞান কই?”
“Science Bee – বিজ্ঞান ও গবেষণা”
এই তিনটি গ্রুপে সদস্য সংখ্যা মোট ১১ লাখেরও বেশি। এছাড়া ফেসবুক পেইজে ফলোয়ার ৫ লাখর অধিক এবং কনটেন্ট রিচ ৪ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
অন্বয় দেবনাথের কাজ ও কৃতিত্ব
অন্বয় দেবনাথ এখন পর্যন্ত ২০০০-এর বেশি ইনফোগ্রাফিক পোস্ট, ৫০টির বেশি সায়েন্টিফিক আর্টিকেল এবং ২০টির অধিক ভিডিও তৈরি করেছেন। এর পাশাপাশি ‘সায়েন্স বী’-র মাধ্যমে ৩০টির বেশি কনটেস্ট এবং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে ‘সায়েন্স বী’ গবেষণা, বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকেল, ফ্যাক্ট-চেক এবং বিদেশে গবেষণায় উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অনলাইন সেশন আয়োজন করে থাকে, যার পুরো পরিচালনার দায়িত্বই পালন করেন তিনি।
২০২৩ সালে অন্বয় দেবনাথ বাংলাদেশের সর্বপ্রথম এআই-নির্মিত কমিক বুক “মানবজাতির গ্রহণ” তৈরি করেন, যা প্রকাশের মাত্র ৭ দিনের মধ্যে ১ লাখের বেশি মানুষ ডাউনলোড করে পড়েন। এছাড়াও চ্যাটজিপিটি বিসিএসের মতো পরীক্ষায় কতটা দক্ষ—এই বিষয়েও গবেষণায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। বিজ্ঞান শিক্ষায় তার অবদানের জন্য ২০২৩ সালে তিনি “রাউন্ড টেবিল গ্লোবাল ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড”-এর চূড়ান্ত ২০ ফাইনালিস্টের মধ্যে স্থান করে নেন। এছাড়াও তিনি জাতীয় পর্যায়ে বেশ কিছু অলিম্পিয়াডে পুরস্কার জিতেছেন।
ব্যক্তিগত সাফল্যের বাইরে, ‘সায়েন্স বী’-কে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও ইনকিউবেশনে সাফল্য এনে দিতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন অন্বয়। ‘সায়েন্স বী’ ২০২১ সালে বিওয়াএলসি ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ডস এবং ওয়াইএসএসই গ্লোবাল এডুকেশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। এছাড়া “ফান্ডিং ফর বাংলাদেশ ১.০” নামক প্রতিযোগিতায় শিক্ষা ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়ে জিতে নেয় ১ লাখ টাকা।
এর পাশাপাশি, ২০২৩ সালে নেদারল্যান্ডস সরকার এবং বাংলাদেশের শীর্ষ ভেঞ্চার ফার্মগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত “অরেঞ্জ কর্নার বাংলাদেশ”-এর প্রথম ব্যাচের জন্য নির্বাচিত হয় ‘সায়েন্স বী’। পাশাপাশি, সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট গ্যালেন আয়োজিত সিমকিউবেটর চ্যালেঞ্জের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় ‘সায়েন্স বী’। এর জন্য তারা জিতে নেয় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকার গ্রান্ট। দুই জায়গাতেই ‘সায়েন্স বী’-কে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন অন্বয়।
একই বছর, “হলোনআইকিউ” কর্তৃক দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ১০০টি এডটেক স্টার্টআপের একটি এবং ফিনল্যান্ডের “হান্ড্রেড” কর্তৃক বাংলাদেশের সেরা ১৫টি শিক্ষা-সংক্রান্ত উদ্ভাবনের একটি হিসেবে নির্বাচিত হয় প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৪ সালে জাতিসংঘের ইউএনডিপি এবং সিটি ব্যাংক আয়োজিত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সর্ববৃহৎ সামাজিক উদ্যোগ “স্প্রিংবোর্ড প্রোগ্রাম”-এর জন্যও নির্বাচিত হয় তারা।
অদম্য যাত্রা: বিজ্ঞান সবার দোরগোড়ায় পৌঁছাক
গ্রাম হোক বা শহর, দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন সহজেই বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেটাই অন্বয় দেবনাথের মূল লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই গত পাঁচ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বিজ্ঞানের আলো প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে তাঁর এই অভিযাত্রা চলতেই থাকুক।