✍️ রফিকুল ইসলাম জসিম
ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই মিলনমেলা। আর পাঙালদের ঘরে ঈদের আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় একধরনের বিশেষ খাবারে—পিঠায়। তবে এ পিঠা কেবল খাবার নয়; এ যেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক চেতনার বাহক। ঈদের দিন কোরবানির মাংস যেমন ধর্মীয় অনুষঙ্গ, তেমনি ‘মারই তাল’ আর ‘চিনি তাল’ পাঙালদের ঘরে ঘরে হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
বাংলাদেশের একমাত্র মুসলিম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাঙালদের (মণিপুরী মুসলমান) ঈদ উদযাপন যেমন ধর্মীয় উৎসব, তেমনি তা হয়ে ওঠে সংস্কৃতির রঙে রঞ্জিত এক সামাজিক উৎসব। ঈদুল আজহা, যাকে পাঙালরা বলেন ‘বড় ঈদ’, সেই ঈদের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে দুই রকম পিঠা—‘মারই তাল’ এবং ‘চিনি তাল’।
‘তাল’ শব্দের অর্থ পিঠা, ‘মারই’ মানে ঝাল বা মসলা, আর ‘চিনি’ অর্থ মিষ্টি বা গুড়। নাম থেকেই বোঝা যায়—একটি ঝাল, আরেকটি মিষ্টি। চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো এই গোল পিঠাদুটির পেছনে লুকিয়ে আছে শতবর্ষের ঐতিহ্য, পারিবারিক বন্ধন এবং নারীর শ্রম-ভালোবাসার গল্প।
ঈদের দুই-তিন দিন আগেই শুরু হয় পিঠা তৈরির প্রস্তুতি। চাল ধোয়া, শুকানো, গুঁড়ো করা—এইসব কাজ একসময় ঢেঁকিতে চললেও এখন মেশিনে হয়। কিন্তু নারীদের দল বেঁধে হাসি-আড্ডা দিয়ে কাজ করার আনন্দ আজও অমলিন।
‘মারই তাল’ তৈরি হয় চালের গুঁড়োর সঙ্গে মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ নানা মসলা মিশিয়ে। এটি কাটা হয় রুটি আকারে, এরপর ভাজা বা সেদ্ধ করা হয়। খাওয়া হয় মাংস বা ভর্তার সঙ্গে। অন্যদিকে, ‘চিনি তাল’ হয় চালের গুঁড়োর সঙ্গে চিনি বা গুড় মিশিয়ে, মিষ্টি স্বাদের এক অপূর্ব উপাদান।
এই পিঠা শুধু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিবেশীকে দেওয়া, আত্মীয়-স্বজনকে পাঠানো, বাবার বাড়ি-মেয়ের বাড়িতে চালান হওয়া—সব মিলিয়ে ‘তাল’ এক সামাজিকতা, এক ভালোবাসার সেতু। ঈদের দিনে অতিথি আপ্যায়নে যখন ‘তাল’, সেমাই, নুডলস, শরবতের আসর বসে, তখন তা হয়ে ওঠে এক আনন্দঘন মিলনমেলা। পিঠা বানানোর মধ্য দিয়ে নারীরা নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করেন, এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা হস্তান্তর করেন।
বর্তমান সময়ে নগরজীবনের ব্যস্ততায় কিংবা প্রবাসী জীবনের একাকিত্বে হয়তো অনেকেই এই পিঠার সংস্কৃতি ভুলতে বসেছেন। কিন্তু পাঙাল সমাজে এখনও বহু পরিবার এই ঐতিহ্যকে ভালোবাসায় আগলে রেখেছেন। ‘মারই তাল’ ও ‘চিনি তাল’ এখন শুধু রেসিপি নয়—এটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, স্মৃতির স্বাদ, আর নিজস্ব পরিচয়ের প্রামাণ্য দলিল।
ঈদের দিনে যখন কোরবানির গোশতের গন্ধে মুখরিত হয় পাঙালদের বাড়িঘর, তখন ‘তাল’-এর ঘ্রাণও হয়ে ওঠে সমান তাৎপর্যপূর্ণ। এটি একাধারে খাবার, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের অনন্য বহিঃপ্রকাশ। ঈদুল আজহা তাই পাঙালদের কাছে কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়—এটি হয়ে ওঠে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের প্রাণস্পন্দন।