ঢাকারবিবার , ২৪ নভেম্বর ২০২৪
  1. সর্বশেষ

বিশ্ব শ্রমিক দিবস : একটি পর্যালোচনা

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
১ মে ২০২৪, ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

বছর ঘুরে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে ‘মে’ মাস। শ্রমিকের অধিকার আদায় আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এ মাসের ১ তারিখ সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘International Workers Day’। এ দিবসটি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার এবং মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক, দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা।

‘মে’ দিবসের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:

১৮৮৬ সালের পহেলা মে আমেরিকার মেহনতী শ্রমিকশ্রেণী দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীসহ আরো কয়েকটি ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। ১লা মে’র ঐ ধর্মঘট দিবসের আগে যুক্তরাষ্ট্র বা বিশ্বের কোথাও (ইসলাম ব্যাতীত) শ্রম আইন ছিল না। শ্রমিকদের মানবিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বলতেও কিছুই ছিল না। তারা ছিল মালিকদের দাস মাত্র। তাদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। ছিল না সাপ্তাহিক কোনো ছুটি। ছিল না চাকুরীর স্থায়িত্ব ও ন্যায়সঙ্গত মজুরীর নিশ্চয়তা। মালিকরা তাদের ইচ্ছামত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো। এমনকি দৈনিক ১৮-২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতেও বাধ্য করতো শ্রমিকদের। এ অন্যায়, বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা পর্যায়ক্রমে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার’-এর ১৮৮৫ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকা ও কানাডার প্রায় তিন লক্ষাধিক শ্রমিক শিকাগোর ‘হে মার্কেটে’ ঢালাই শ্রমিক, তরুণ নেতা এইচ সিলভিসের নেতৃত্বে এক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বাত্মক শ্রমিক ধর্মঘট পালন করে। শ্রমিকদের সমাবেশ চলাকালে মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী পুলিশ ও কতিপয় ভাড়াটিয়া গুন্ডা সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে অতর্কিতভাবে গুলি চালিয়ে ৬ জন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা ও শতাধিক শ্রমিককে আহত করে। কিন্তু এতেও শ্রমিকরা দমে যায়নি। শ্রমিকদের ইস্পাতকঠিন ঐ সফল ধর্মঘটের কারণে কোনো কোনো মালিক ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে শ্রমিকরা আরো উৎসাহী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরে ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবী প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে রবিবারের সাপ্তাহিক বন্ধের পরের দিন ৩ তারিখেও ধর্মঘট অব্যাহত রাখে।

ঐ নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত ৪ঠা মে শিকাগো শহরের ‘হে মার্কেট’র বিশাল শ্রমিক সমাবেশে আবারো মালিকগোষ্ঠীর গুন্ডা ও পুলিশ বাহিনী বেপরোয়াভাবে গুলি বর্ষণ করে। এতে ৪ জন শ্রমিক নিহত ও বিপুল সংখ্যক আহত হয়। রক্তে রঞ্জিত হয় ‘হে’ মার্কেট’ চত্বর। গ্রেফতার করা হয় শ্রমিক নেতা স্পাইজ ও ফিলডেনকে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এই নৃশংস হত্যাকান্ডের পর শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রীতিমতো ‘চিরুনী অভিযান’ চালিয়ে শিকাগো শহর ও এর আশপাশের এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ফিশার, লুইস, জর্জ এঞ্জেল, মাইকেল স্কোয়ারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শ্রমিক নেতাকে।

পরবর্তীতে শ্রমিকদের এই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতাকারী মালিকপক্ষের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ‘জুরি’ গঠন করে ১৮৮৬ সালের ২১ জুন শুরু করা হয় বিচারের নামে প্রহসন। একতরফা বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর ঘোষিত হয় বিচারের রায়। রায়ে বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে শ্রমিক নেতা পার্সন্স, ফিলডেন, স্পাইজ, লুইস, স্কোয়ার, এঞ্জেল ও ফিশারের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ প্রদান করা হয় এবং ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর সে আদেশ কার্যকর করা হয়। শ্রমিক নেতা ও কর্মী হত্যার এ দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে প্যারিসের সোশালিস্ট পার্টি প্রতিবছর ১লা মে ‘শ্রমিক হত্যা দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দৈনিক ৮ ঘণ্টা কার্য সময় ও সপ্তাহে এক দিন সাধারণ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করে প্রথম শ্রম আইন প্রণীত হয়। অন্যদিকে নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞ গোটা বিশ্বের শ্রমিকদের অধিকারে এনে দেয় নতুন গতি। শিকাগো শহরে সৃষ্ট এ আন্দোলন ক্রমশ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। পৃথিবীর সকল শ্রমজীবী মানুষ এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানটি। সেই সাথে ১৩৮ বছর আগে ঘটে যাওয়া সে ঘটনাটির কথা এখন প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করা হয়ে থাকে ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’ হিসেবে। (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)। পহেলা মে ‘বিশ্ব শ্রমিক দিবস’ বা ‘মে দিবস’কে সামনে রেখে এই প্রবন্ধে ইসলামে শ্রমনীতি, মালিক-শ্রমিকের পারস্পরিক সম্পর্ক, মর্যাদা, অধিকার এবং মালিক-শ্রমিকের একে-অপরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য’ সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই।

ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা:

নিজে পরিশ্রম করে যে স্বাবলম্বীতার পরিচয় দেয়, এমন শ্রমিক ও শ্রমজীবী আল্লাহর প্রিয়, তাঁরা নবীজী (সা.)-এর প্রিয়পাত্র। বায়হাকী শরীফে বলা হযে়ছে, “শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।” (বায়হাকী)। আল্লাহ নিজে এদের প্রশংসা করে বলেছেন, “এমন বহু লোক আছে যারা জমিনের দিকে দিকে ভ্রমণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়ায়।” (সূরা মুজ্জাম্মিল: ২০)। সূরা জুমুয়ায় নির্দেশনা রযে়ছে, “সালাত আদায় হয়ে গেলে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়াবে।” (সূরা জুমুয়াহ: ১০)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই খোঁজাখুঁজিকে সরাসরি জিহাদতুল্য ইবাদাত বলে আখ্যাযি়ত করেছেন (কানযুল উম্মাল- ৯২০৫)। হাদীসে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া হযে়ছে, “হালাল জীবিকা সন্ধান করা নির্ধারিত ফরজসমূহের পরে বিশেষ একটি ফরজ।” (কানযুল উম্মাল- ৯২০৩)। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই প্রক্রিয়াকে ইসলাম এত মূল্য দিযে়ছে যে, বাহনে থাকা অবস্থায় পডে় যাওয়া চাবুক উঠিয়ে আনতে অন্যের সাহায্য নেয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ- ১৭৬৪)।

নবীজী (সা.) নিজে বকরী চরিয়েছেন, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কূপ থেকে বালতিতে পানি উঠিয়েছেন, ব্যবসা করেছেন, মাটি খনন করেছেন, রান্নার কাঠ সংগ্রহ করেছেন, রান্নায় সাহায্য করেছেন, টুপি সেলাই করেছেন, জামার উকুন বাছাই করেছেন, রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তাঁরই (সা.) মেয়ে হযরত ফাতিমা (রা.), যিনি জান্নাতী নারীদের নেত্রী হবেন, তিনি বাঁদী বা কাজের লোকের শরণাপন্ন না হয়ে ঘরের সকল কাজ নিজেই করতেন। নিজে ঘর ঝাড়ু দিতেন। নিজ হাতে জাঁতা ঘোরাতেন; এতে তাঁর হাতে দাগ পড়ে গিয়েছিল। এমনিভাবে পানির মশক বহন করতে করতে তার বুকে দাগ বসে গিয়েছিল।

আল্লাহর পয়গাম্বর হযরত আদম (আ.) জমি চষে শস্য ফলাতেন, নূহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, ইদরীস (আ.) ছিলেন দর্জি। নবী দাউদ (আ.) ছিলেন কামার, যাকারিয়া (আ.) ছিলেন তাঁতী আর মূসা (আ.) ছাগলের রাখাল। সুতরাং কাজ যত ছোটই হোক, ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মানজনক। অন্যদিকে, পরের কাছ থেকে চেয়ে পাওয়া জিনিস (ভিক্ষা) তা যত সুন্দর ভঙ্গিরই হোক, অবাঞ্ছিত, আত্মসম্মান বিরোধী। নবীজী (সা.)-এর ভাষায় “নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ খায়নি; আল্লাহর নবী দাউদ নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।” (বুখারী- ২০৭২, ২০৭৩)। আর সৎ ব্যবসায়ীকে তো সুসংবাদ শোনানোর হযে়ছে এভাবে “সত্যবাদী, বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গী হবে।” (তিরমিজি- ১২০৯)।

ভালো শ্রমিক-এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য:

আল-কুরআনের ভাষায় যোগ্য শ্রমিকের মৌলিক বৈশিষ্ট্য দু’টি— (১) শক্তিশালী তথা সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য সামর্থ্যবান হওয়া, (২) আমানাতদারি বা বিশ্বস্ততা। সামর্থ্যবান শ্রমিক যদি বিশ্বস্ত না হয়, তাহলে মালিকের পক্ষে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকা থাকে। তাইতো মূসা (আ.) যখন মিশর থেকে মাদায়ানে হিজরত করেন ঘটনাক্রমে নবী শোয়াইব (আ.)-এর দরবারে নীত হন, তখন শোয়াইব (আ.)-এর এক মেয়ে তার বাবাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন “হে পিতা! আপনি তাকে (মূসাকে আ.) মজুর নিযুক্ত করুন, কারণ আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে এমন ব্যক্তিই, যে (একই সাথে) শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।” (সূরা ক্বাসাস: ২৬)। হযরত সুলায়মান (আ.)-এর এক ‘কর্মচারী-জ্বীন’-এর জবানবন্দীতেও বিষয়টি ব্যক্ত হয়েছে “সুলায়মান আরো বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা (রাণী বিলকিস ও তার সাথীরা) আমার কাছে আসার আগে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? এক শক্তিশালী জ্বীন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার আগেই আমি ঐ সিংহাসন নিযে় আসব; আর এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান ও বিশ্বস্ত।” (সূরা নামল: ৩৮, ৩৯)

ভালো মালিক-এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য:

আল-কুরআনের দৃষ্টিতে ভালো মালিকের মূল বৈশিষ্ট্য পাঁচটি–

এক: সে বুঝে-শুনে সচেতনভাবে শ্রমিক নিযে়াগ দেয়,

দুই: পারিশ্রমিক আগেই নির্ধারণ করে নেয়,

তিন: শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণ করে,

চার: শ্রমিককে অযথা কষ্ট দেয় না এবং

পাঁচ: শ্রমিকের সাথে সদাচরণ করে।

এই শিক্ষাই আমরা নিচের আয়াত ও তার দৃশ্যপট থেকে পাই “তাদের (শুয়াইব আ.-এর দুই মেযে়র) একজন বলল, “হে পিতা! আপনি তাকে (মূসাকে আ.) মজুর নিযুক্ত করুন, কারণ আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে এমন ব্যক্তিই, যে (একই সাথে) শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।”। সে (শুয়াইব আ.) মূসাকে বলল, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই, এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাইলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে।” (সূরা ক্বাসাস: ২৬, ২৭)।

শ্রমিকের অধিকার:

শ্রমিকের অধিকারকে আমরা মালিকের কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে ব্যক্ত করতে পারি। মালিক এই দাযি়ত্বপালন করে না বলেই পোশাক-শিল্পে অহরহ শ্রমিক-বিক্ষোভ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইসলাম মালিককে এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে–

এক: নিয়োগের আগেই শ্রমিকের মজুরী নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শ্রমিক না ঠকে এবং মালিককে ঝামেলার মুখোমুখি হতে না হয়। হাদিসের ভাষায় “মজুরের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না।”(বুলুগুল মারাম- ৯১৪) আল-কুরআনে মজুরি নির্ধারণের এই আদর্শ দেখতে পাই, হযরত শোয়াইব (আ.) কর্তৃক হযরত মূসা (আ.)-কে পারিশ্রমিক নির্ধারণের মধ্যে। (সূরা কাসাস: ২৭)।

দুই: শ্রমিককে মানবিক জীবনযাপনের উপযোগী ন্যায্য মজুরী পারিশ্রমিক দিতে হবে। হাদিসে সাবধান করে বলা হযে়ছে “নবী করীম (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন রকমের লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করবো, যাদের মধ্যে এক রকমের লোক হলো তারা, যারা শ্রমিকের কাছ থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে অথচ তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়নি।” (বুখারী- ২২৭০)।

তিন: যথাসমযে় শ্রমিকের পাওনা মিটিযে় দিতে হবে। রাসূল (সা.)-এর ভাষায় “ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পাওনা মিটিয়ে দাও।” (ইবনে মাজাহ- ২৪৪৩)

চার: শ্রমিকদের পক্ষে কষ্টকর বা অসাধ্য কোনো দায়িত্ব তাদের ওপর চাপাবে না। যদি কোনো কষ্টসাধ্য দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করো তবে তোমরা তা পালনে তাদেরকে সাহায্য করবে। (বুখারী- ২৫৪৫, ৬০৫০)

পাঁচ: শ্রমিকের ক্ষমারযোগ্য ত্রুটি ক্ষমার নজরে দেখতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) অধীনস্থকে ক্ষমার ব্যাপারে তাগিদ করলে এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাকে দৈনিক কতবার ক্ষমা করব? নবীজী বললেন, “প্রতিদিন ৭০ বার (বহুবার)।” (তিরমিজি- ১৯৪৯) তাছাড়া আল কুরআনে ক্রোধ দমন, দোষত্রুটি উপেক্ষা (ক্ষমা) এবং সদয় ব্যবহারের প্রতিদান আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও জান্নাতের ওয়াদা করে বলা হযে়ছে, “(ক্ষমা ও মহামূল্য জান্নাত ঐসব আল্লাহভীরুদের জন্য) যারা সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করে, ক্রোধ হজমকারী, মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সদয় ব্যবহারকারীদেরকে (সৎকর্মশীলদেরকে) ভালবাসেন।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩, ১৩৪)

ছয়: শ্রমিককে অযথা কষ্ট দেওয়া যাবে না। তার ওপর বাড়তি বা দুঃসাধ্য কাজ চাপানো যাবে না। কঠিন কাজ দিলে তাকে সাহায্য করতে হবে। তার খাদ্য ও পোশাকের মানানসই অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তারা (চাকর-বাকর-শ্রমিক বা দাসশ্রেণি) তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন ও দায়িত্বাধীন করেছেন। কাজেই তোমরা যা খাও তা থেকে তাদেরকে খাওয়াবে এবং তোমরা যা পরিধান করবে তা থেকে তাদেরকে পরিধান করাবে। তাদের পক্ষে কষ্টকর বা অসাধ্য কোনো দায়িত্ব তাদের ওপর চাপাবে না। যদি কোনো কষ্টসাধ্য দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করো তবে তোমরা তা পালনে তাদেরকে সাহায্য করবে। (বুখারী- ২৪৪৫, ৬০৫০)। তাছাড়া শ্রমিকের (মূসা আ.) প্রতি একজন মালিকের (হযরত শোয়াইব আ.) বক্তব্য লক্ষ্য করুন “আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না; আল্লাহ চাইলে (ইনশা আল্লাহ) তুমি আমাকে সদাচারী হিসেবেই পাবে।” (সূরা ক্বাসাস: ২৭) আর বাংলা কবিতায় বলা হযে়ছে, ‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ এক সাথে গাঁথা/ নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।’

সাত: দান-সদকা মানুষের বালা-মুসীবাত দূর করে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। সুতরাং সাধ্য থাকলে গরিব শ্রমিককে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দান করা উচিত, যাতে তার জীবন কিছুটা সুন্দর হয়। কিন্তু মানুষের আচরণ ঠিক উল্টো, যা আল্লাহর কাছে তিরস্কৃত হযে়ছে এভাবে “আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকেও কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিযে়ছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হযে়ছে তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?” (সূরা নাহল: ৭১)

আট: শ্রমিক ও অধীনস্থ যে কারোর ব্যাপারেই খুব বেশি হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কারণ, অধীনস্থের সাথেই অসতর্ক আচরণ সংঘটিত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। নবীজী (সা.) ইন্তেকালের সমযে়র অসহ্য কষ্টের মধ্যেও দু’টি মাত্র জিনিসের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে গেছেন তার একটি সালাত, অন্যটি অধীনস্থ। নবীজীর (সা.) ভাষায় “সাবধান! সালাত এবং অধীনস্থের ব্যাপারে সাবধান!!” (ইবনে মাজাহ- ২৬৯৭, ২৬৯৮; আবু দাউদ- ৫১৫৬; আহমদ- ৫০৮৬, ১১৭৫৯)

মালিকের অধিকার:

শ্রমিকের যেটা করণীয় সেটাকেই বলা হয় মালিকের অধিকার। এই অধিকার আদায়ে শ্রমিকের করণীয় হচ্ছে–

এক: যে কাজ সহজে বা কিছুটা বাড়তি কষ্ট করে সম্পন্ন করা সম্ভব এমন কাজই নেবে; অসাধ্য সাধনের ঝুঁকি নিয়ে জীবন ও সুনামকে বিপন্ন করবে না। যে কাজ সম্পাদনের শক্তি-সামর্থ্য নেই, তাতে জড়িত হওয়ার মানে হয় না। (সূরা কাসাস: ২৬)

দুই: স্বীয় কাজ বা দায়িত্বকে আমানাত (অবশ্য পরিশোধ্য অন্যের প্রাপ্য) মনে করে তা সম্যকভাবে আদাযে় সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশনা রযে়ছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে।” (সূরা নিসা: ৫৮)

তিন: শ্রমিককে অবশ্যই দায়িত্বশীলের সাথে কাজ সম্পাদন করতে হবে। কেননা তোমাদের প্রত্যেককেই কিয়ামতের দিন নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (বুখারী- ৮৯৩)।

শেষকথা:

সমস্ত সমস্যার সমাধান হচ্ছে দায়িত্বজ্ঞান; আর দায়িত্বজ্ঞানের পথে প্রেরণার উৎস হচ্ছে আল্লাহ ও পরকালের ভয়। আমরা প্রত্যেকে যদি একটি হাদিস মনে রাখি, অসংখ্য সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে অবলীলায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। আর (কিয়ামতের দিন) তোমাদের প্রত্যেককে তার দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং–

১. জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি; কিয়ামতের দিন তার দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে,

২. পুরুষও তার পরিবারে একজন দায়িত্বশীল; তাকেও তার এই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে,

৩. স্ত্রীও তার স্বামীর ঘর-সংসার এবং সন্তানের ওপর দায়িত্বশীলা; (কিয়ামতের দিন) তাকেও এই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে,

৪. এমনকি কোনো ব্যক্তির গোলাম বা দাস (চাকর-চাকরানীও) তার প্রভুর সম্পদের ব্যাপারে একজন দায়িত্বশীল; সেদিন তাকেও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অতএব, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই কিয়ামতের দিন এই দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সহিহ বুখারী- ৮৯৩, ২৪০৯, ২৫৫৪, ২৫৫৮, ২৭৫১, ৫১৮৮, ৭১৩৮)।

লেখক: আলী ওসমান শেফায়েত
শিক্ষাবিদ ও গবেষক
ইমেল: aliosmansefaet@gmail.com

477 Views

আরও পড়ুন

দোয়ারাবাজারে এফআইভিডিবি’র স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ

বোয়ালখালীর নব যোগদানকৃত শিক্ষা অফিসার হারুন উর রশীদকে বরণ

জামালপুরে মৃত আইনজীবী হলেন অতিরিক্ত জিপি

তানযীমুল উম্মাহ হিফয মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড শাখার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

সাইফুল ইসলামের কবিতা : শীতের আমেজ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ইসলামি বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

পাবনার হেমায়েতপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ : নিহত ১

কাপাসিয়ায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন

কাপাসিয়ায় ইসলাম শিক্ষা শিক্ষক পরিষদের উদ্যোগে সিরাতুন্নবী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন

কক্সবাজারের ঈদগাহতে ফুলকুঁড়ি আসরের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন

জবিস্থ শরীয়তপুর জেলা ছাত্রকল্যাণের নেতৃত্বে সৌরভ – মনির

কাপাসিয়া প্রেসক্লাবের কারা নির্যাতিত সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটনকে সংবর্ধনা ও ফুলেল শুভেচ্ছা