——জিয়া হাবীব আহসান এডভোকেট
মেঘে ঢাকা এক সূর্য, একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ কে নিয়ে লিখছি । তিনি হলেন মরহুম প্রফেসর অধ্যক্ষ ড.এম এ সবুর চৌধুরী, সাবেক প্রফেসর রসায়ন বিভাগ ও প্রিন্সিপাল, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রামের একজন কিংবদন্তী শিক্ষাবিদ । স্যারের জন্ম ১ লা ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ ইং এবং মৃত্যু ১৯/১২/১৯৯৩ ইং সনে । চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানাধীন ৬নং কুসুমপুরা ইউনিয়ন বোর্ড অফিস সংলগ্ন পারিবারিক গোরস্থানে উনাকে দাফন করা হয় । তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আকস্মিক মৃত্যুবরন করেন ।
শিক্ষা ক্ষত্রে উনার অবদান, সততা, দক্ষতা, অসাধারণ প্রশাসনিক যোগ্যতার জন্য চট্টশ্বরী রোডে অবস্থিত চট্টগ্রাম কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নাম উনার নামে সবুর হোস্টেল করা হয় । এপ্লাইড রসায়নের ওপর তাঁর বহু গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ড ওয়ার্ক, রিসার্চ ওয়ার্ক, ট্রেনিং ও গবেষণাপত্র রয়েছে । প্রচার বিমুখ এ মহৎপ্রাণ গুণী মানুষটি একেবারে আলোচনার আড়ালেই রয়ে গেলেন । সবুর স্যার ১৯৫৩ সালে প্রথম বিভাগে ইস্ট বেঙ্গল এডুকেশন বোর্ড থেকে মেট্রিক, ১৯৫৫ সালে সাইন্স থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ক্যামিস্ট্রিতে ২য় বিভাগে এবং এম.এস.সি ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ হন । ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ১৯৬৭ সালে এনালাইটিকেল কেমিস্ট্রি থেকে এম.এস এবং ১৯৭০ সালে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন । এই গুণী শিক্ষাবিদ ঢাকা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান ও ঢাকা কলেজের হোস্টেল সুপারের দায়িত্বও পালন করেন । তিনি ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯/১২/৯৩ ইং দুপুরে মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন । পটিয়া কুসুমপুরা বিনিনিহারা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী বুনিয়াদী ধর্মপ্রাণ সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেন । যতোদূর জানি তিনি একজন মেধাবী চরিত্রবান পরহেজগার আদর্শ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন । প্রফেসর আলহাজ্ব এম.এ সবুর চৌধুরী আংকেল আমার মরহুম শ্বশুর আব্বা চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক কৃতি ছাত্র ও চট্টগ্রাম আইন কলেজের সাবেক শিক্ষক বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ব্যারিস্টার আমিনুল হক এর চাচাতো ভাই । অর্থাৎ সম্পর্কে তিনি আমার জেঠা শ্বশুর মরহুম সবুর জেঠার বাবার নাম মরহুম আলহাজ্ব আলী আকবর চৌধুরী । মরহুম সবুর সাহেবের স্ত্রীর নাম মিসেস মমতাজ সবুর । আসকারদীঘি পাড়ে বিশাল আবাসিক ভবন, সলিমা সিরাজ মহিলা মাদ্রাসা ও পাশে বানিজ্যিক ভবনগুলো মমতাজ সবুর এর ভাই মরহুম এডভোকেট আলহাজ সিরাজুল ইসলাম সাহেবের সম্পত্তি ছিল । যিনি বিশিষ্ট আইনবিদ প্রফেসর মহিউদ্দিন খালেদ মুকুলের আপন মামা । সবুর জেঠার স্ত্রী মমতাজ সবুর মহিউদ্দিন মুকুল সাহেবের ছোট খালা । মমতাজ সবুরের বড় ভাই মরহুম সিরাজুল ইসলাম একজন নামজাদা এডভোকেট ছিলেন । সবুর জেঠির বোনের ছেলে এড মহিউদ্দিন খালেদ আমেরিকা যাওয়ার পর মুকুল ভাই এক সময় ওনাদের সম্পত্তিগুলো দেখা শুনা করতেন । প্রফেসর মহিউদ্দীন খালেদ মুকুল ভাই মেহেদীবাগে থাকেন এবং তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রফেসর । সবুর জেঠারা আপন তিন ভাই ছিলেন । তাঁরা হলেন যথাক্রমে বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ডাঃ শামসুল আলম চৌধুরী, মরহুম প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর এবং মরহুম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও চাক্তাইয়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী) । তাঁর একজন সৎ ভাই ছিলেন, নাম মরহুম অদুদ মিয়া । এলাকার সালিশ বিচারে অত্যন্ত দক্ষ ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন । সবুর আংকেলের একমাত্র পুত্র সন্তান নওশাদ আমেরিকায় সেটেল্ড । তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন । তিনি এস.এস.সি তে স্ট্যান্ড করেন ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর্বর্তীতে আমেরিকা চলে যান । মরহুমের দুই মেয়ে, বড় মেয়ে নাসরিন ও ছোট মেয়ে শান্তা তাঁদের মা মমতাজ সবুর সহ পরিবারের সবাই দীর্ঘদিন যাবৎ স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাসকারী হন । শান্তা একজন ডাক্তার ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ । ওনাদের দাদার নাম আনচুর আলী । আর আমার শ্বশুর আব্বা ব্যারিষ্টার আমিনুল হকের দাদা মরহুম আমচুর আলী । আমচুর আলী ও আনচুর আলী দুইভাই বিনানীহারা গ্ৰামে প্রবেশ করতেই যে বিশাল পুকুর তা কাজী পুকুর নামে পরিচিত । এই পুকুরের পূর্ব পাশে মরহুম আনসুর আলীর বাড়িভিটা আর পশ্চিম পাশে মরহুম আমচুর আলীর বাড়িভিটা । কাজী পুকুর ঘিরে ওনাদের কয়েক পুরুষের বসবাস । মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক আত্মীয়-অনাত্মীয় স্বপরিবারে এই বাড়িগুলোতে আশ্রয় নেন । অনেকে দীর্ঘ নয় মাস এই বাড়িতে অবস্থান করেন।আশ্রয়দানকারি পরিবার সহ অন্যান্যরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উনাদের গ্ৰহন করেন এবং যাবতীয় সেবাযত্ন দিয়েছেন । এই বাড়ি দুটির অনেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন । তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সবুর আংকেলের বড় ভাই মরহুম ডাক্তার শামসুল ইসলাম ও ভাইপো রফিকুল ইসলাম চৌধুরী । আমার শ্বশুর আব্বাও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তাঁকে পাক সেনারা হত্যার জন্য নিয়ে যায়, পরে কৌশলে তিনি প্রাণে রক্ষা পান । এইজন্য তাঁকে (ব্যারিস্টার আমিনুল হক) চট্টগ্রাম বার এসোসিইয়েশন এর পক্ষে থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্মাননা পদক দেয়া হয় । এই পুকুরের পূর্ব পাশে আনচুর আলীর বসত ভিটা আর পশ্চিম পাশে আমচুর আলীর বসত ভিটা মানে আমার শ্বশুর মরহুম আমিনুল হক সাহেবদের বাড়ী ভিটা । প্রফেসর ড. সবুর শ্রেষ্ঠ কলেজ অধ্যক্ষ নির্বাচিত হলে তাঁকে নগরীর লাভলেনস্থ মেট্রোপোল কমিউনিটি সেন্টারে চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন, ‚চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী পরিষদ” সংবর্ধনা প্রদান করে । ১৯৯৩ সনে চট্টগ্রাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি বক্তব্য রাখেন । প্রফেসর সবুর জেঠার এক সময়ের স্নেহধন্য গুনমুগ্ধ সহকর্মী চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক প্রফেসর (অর্থনীতি) ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আহমদ হোসেন স্যার মরহুম প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর সম্পর্কে স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বলেন, ড. সবুর চৌধুরী একজন অত্যন্ত প্রথিতযশা রসায়নশাস্ত্রের প্রফেসর ছিলেন । তিনি চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদানের পূর্বে দীর্ঘ দিন ঢাকা কলেজের রসায়ন বিভাগের রসায়ন বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং শিক্ষক হিসাবে ঈর্ষনীয় সুনাম অর্জন করেন । তৎকালিন সময়ে তাঁর ঢাকা কলেজের বাসায় আমার বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয় । পরবর্তীতে তাঁকে চট্টগ্রাম কলেজে পাই । আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক । তাঁকে ঘিরে আমার অনেক সুখস্মৃতি আছে । এর কিছু এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি । কেন জানিনা, তিনি আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন । তাঁর মত মহৎ ব্যক্তি, উদার মনের মানুষ এবং খাঁটি ইমানদার এ দুনিয়ায় মেলা ভার । তিনি কলেজের নানান সমস্যা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করতেন (প্রসংগতঃ উল্লেখ্য, আমি তাঁর আমলেও আমি শিক্ষক পরিষদ সম্পাদক ছিলাম) । তিনি সহকর্মীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন । তাঁর রুমে কেউ গেলেই আপ্যায়নের জন্য প্রায়ই পকেট থেকে এক শতি নোট বের করে দিতেন । তিনি কিন্তু সারা মাস-বছর রোজা রাখতেন । ১৯৯১ সালে আমাকে সরকার সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দিয়ে সরকারী সিটি কলেজে পদায়ন করার বিষয়টি (চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকের শুন্য পদ থাকা সত্বেও) তিনি মেনে নিতে পারেন নি; তাই তিনি পুরো একমাস আমাকে রিলিজ না করে শিক্ষা সচিবের সাথে জোর দেনদরবার শুরু করে দেন । সচিব সাহেব, আমাকে এক মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম কলেজে ফিরিয়ে আনবেন প্রতিশ্রুতি দেয়ায় তিনি আমায় সিটি কলেজে যেতে দেন । অবশ্য ঠিক মাস পরে চট্গ্রাম কলেজে আমার বদলীর অর্ডার হয় এবং আমি ফিরে আসি এবং পরবর্তীতে প্রফেসর হয়ে হাজী মহসিন কলেজে যোগদানের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজ আমার চাকরি কাল ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ( সিটি কলেজের ১ মাস বাদে) ২৪ বছর । আমি অতিথি পরায়ন সুমহান ব্যক্তিত্ব প্রফেসর সবুর সহেবের স্নেহ-ভালবাসার ঋণ কখনো ভুলতে পারবো না । এ মূহুর্তে আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল । একদিন তিনি আমাকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, ‚আহমদ হোসেন, ইংরেজিতে দুই পৃষ্ঠার একটা রিপোর্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠাতে হবে । খুব জরুরী । বিষয়টা বুঝে নাও এবং রেডি করে কাল আমাকে দেবে।” আমি কিছুটা অবাক হলাম এবং বললাম, স্যার আপনি এ কাজটা কোন ইংরেজীর শিক্ষককে দিলেই ভাল হয় । তিনি তখন বললেন, ‚না, তুমিই করবে।” পরদিন, আমি বহু কষ্টে একটা ড্রাফট তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম । তিনি দেখবেন বলে তা ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন । তার দুদিন পরে তিনি নিজ হস্তে লেখা একটা রিপোর্ট আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‚বাজি, আঁই একখান লেখ্খি, চঅ’ত কেন অইয়ে?” আমি যথারীতি পড়লাম এবং অবাক হলাম তাঁর অতি উচ্চমানের ইংরেজি ড্রাফটটি দেখে । আমি খুব লজ্জা পেলাম, কারণ আমারটা উনারটার ধারে কাছেও যায় না । আমি বললাম, স্যার, আপনি এত সুন্দর ইংরেজি জানেন, অথচ আমাকে লিখতে বললেন । তখন তিনি বিনয়ের সাথে বলেন, ‚ওবা, আঁই, কেমেস্ট্রীর মানুষ, ইংরেজি তোড়ামোরা জানি, কোন মতে কাম চালাই । ‚আসলে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও গুনীজন, এতে কোন সন্দেহ নেই । আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ‚উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মোকাম দান করুণ ।” প্রফেসর মরহুম ড. এম এ সবুর সম্পর্কে তাঁর এক কালীন ছাত্র ও পরবর্তীতে সহকর্মী প্রফেসর চৌধুরী মঞ্জুরুল হক (সাবেক বিভাগীয় প্রধান, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ ) স্যার বলেন, ড. এম এ সবুর চৌধুরীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার শিক্ষক হিসেবে দেখেছি ১৯৬১ সালের আগস্ট মাস থেকে চট্টগ্রাম কলেজে একাদশ বিজ্ঞানে এবং অনার্স শ্রেণীতে । প্রথমে ছাত্র হিসেবে পরবর্তীতে সহকর্মী হিসেবে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি । একাদশ বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার পর রসায়ন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয়ে প্রথম থেকেই আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না । রাসায়ানিক বাষ্পীকরনের সমতা করা আমার খুব জটিল মনে হতো, রাতে ঘুম হতো না । মনে করেছিলাম বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে দিয়ে মানবিক বিভাগে চলে যাবো । কিন্তু রসায়ন বিভাগের স্মার্ট, তরুণ, সুন্দর গঠনের অধিকারী শ্রদ্ধেয় লেকচারার জনাব এম.এ সবুর চৌধুরীর সাথে আমার চিন্তা ভাবনা নিয়ে কথা বললে তিনি মনোযোগ সহকারে আমার সমস্যা সম্পর্কে শুনলেন এবং আমাকে স্নেহের ভাষায় বললেন নিজেই বিষয়টি দেখবেন । তাঁর আন্তরিক মনোভাবের জন্য আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম । তাঁর পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে শেষ পর্যন্ত রসায়নে ভীত আমিই রসায়নের শিক্ষক হিসেবে চার যুগের বেশি শিক্ষকতা করলাম । আমার বিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীরা দেশে বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদে সুনামের সাথে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, আল্লাহর কাছেই সকল প্রশংসা । ছাত্র জীবনের প্রথম সপ্তাহ থেকে মৃত্যুর ১ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত সবুর স্যারের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল, ঘনিষ্ঠতা ছিল । তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান করলে তাঁর সহকর্মী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি বিভিন্নভাবে । তিনি খুব সম্ভব ১৯৭৫ সালে রসায়নে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদন্নোতি পেয়ে ঢাকা কলেজে যোগদান করেন এবং ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ঢাকা কলেজেই সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন । ঢাকা গেলেই স্যারের সাথে দেখা করতাম । উনার শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান ব্যাপক । তিনি বহু শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ করে দেন । তাঁর উন্নত মানবিক আচরণ, অন্যায়কে সমর্থন না করার দৃষ্টিভঙ্গি, আল্লাহ্র প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর একান্ত আচরণ, তাঁর বিনয়ী ও সুন্দর ব্যবহার, সুঠাম দেহ গঠন, পরিপাঠি পোষাক, হাস্যজ্জ্বল চেহারা সবাইকে মুগ্ধ করতো । অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় কোন রকম অহংকারী মনোভাব, উদ্ধতপূর্ণ আচরন তাঁর কাছ থেকে কেউ পায়নি । ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে, শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্কে কয়েকটি আন্দোলনের সন্তোষজনক ও সম্মানজনক সমাধান করেন তিনি ধীর স্থিরভাবে ও শান্তভাবে থাকার জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন । তাঁর কাছে আমি এবং আমার সহকর্মীরা শিখতে পেরেছিলাম অনেক কিছু । ড. এম এ সবুর চৌধুরী ঢাকা কলেজে প্রায় পনের বছর চাকুরীকালীন সময় সরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন । সততার সাথে পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক সরকারী কলেজের জন্য লেকচারার নিয়োগের সময় রসায়ন বিষয়ে সাবজেক্ট এক্সপার্ট হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি ১৯৯০ সালের ২৮ আগস্ট তারিখ চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন । তিনি নিজেও এই কলেজের একজন প্রাক্তন কৃতি ছাত্র । তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিন পর শ্রেষ্ট শিক্ষক নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন । বিভিন্ন সংগঠন তাঁকে সংবর্ধনা দেন । চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদও তাঁকে সংবর্ধনা দেন । তাঁর বক্তব্যে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য নির্দেশনামূলক অনেক কিছু ছিল । তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আমি একজন সহকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বিভিন্ন কমিটিতে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে । তাঁর অভিজ্ঞতাপূর্ণ প্রশাসনিক নির্দেশনা, নৈতিকতা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সকল সহকর্মীদের কিছু উন্নত চারিত্রিক গুনাবলী অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল । ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের প্যারেড মাঠে কুমিল্লা বোর্ডের আন্তঃ কলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অধ্যক্ষ আব্দুস সবুর চৌধুরী প্রধান অথিতি হিসেবে বিজয়ীদের পুরুষ্কার বিতরণ করেন । ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে আমি পদন্নোতির কারণে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অন্যত্র বদলীর কারণে প্রদত্ত বিভাগীয় বিদায় সংবর্ধনায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি বক্তব্য দেন । তিনি ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সাল দুপুর পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে চাকুরী করেন এবং তিনি বেশ উৎফুল্লই ছিলেন যা তাঁর স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৩ তারিখ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর ৩০/৪০ মিনিট আগে আমি তাঁর কক্ষে দেখা করতে গেলে তিনি খুব খুশী হন এবং আমার চট্টগ্রাম কলেজে পুনঃ বদলীর বিষয়ে জানতে চান । তখনও বুঝতে পারিনি তাঁকে ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পাবো । ১৯৬১ সাল থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল । আমাকে খুব স্নেহ করতেন তিনি । আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস উত্তম স্থান দান করুন – আমীন । সবাই তাঁর জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করবো প্রতিদিন । আমরা যেন স্যারের উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিজেরা অর্জন করতে সক্ষম হতে পারি । চট্টগ্রাম কলেজের রসায়ন বিভাগের একজন প্রাক্তন ছাত্রী আমার সহধর্মিণী মিসেস আশফা খানম থেকে তাঁর অনেক মহৎ কর্ম ও গুন সম্পর্কে শুনে তাঁর সম্পর্কে দুটি কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ লিখাটির অবতারণা করেছি । আল্লাহ্তাআলা এ মহান শিক্ষাবিদকে জান্নাতুল ফেরদৌসের চিরস্থায়ী বাসিন্দা করে দিন-আমিন । কৃতজ্ঞতা শিকারঃ শাহীনুল ইসলাম লিটু ভাই যিনি মরহুমের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহিনুল ইসলাম লিটু ।
লেখকঃ আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।