জুলিয়াস সিজার তালুকদার
সেই মোঘল আমল থেকেই রমনা ও লালবাগের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বহু জাতি-ধর্মের বাসের ইতিহাস রয়েছে। আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঐ জনপদের মূল অংশেই গড়ে উঠেছে। বহু জাতি-ধর্মের মানুষের মধ্যে শিখ, গ্রীক, আর্মেনীয়, হিন্দু ও মুসলমানদের সহাবস্থানের স্পষ্ট ইতিহাস পাওয়া যায়। সেই সব জাতি ও ধর্মের মানুষদের বসতবাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয় নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই অঞ্চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত এই গ্রীক সমাধিসৌধটি সেইসব স্মৃতিচিহ্নের একটি অংশ।
ঢাকার সিভিল সার্জন জেমস টেলর তার বই ‘টপোগ্রফি অফ ঢাকা’ তে ঢাকায় চল্লিশটি আর্মেনীয় পরিবার ও বারটি গ্রীক পরিবারের কথা উল্লেখ করেছেন। এইসব গ্রীক পরিবারের সদস্যরা অধিকাংশই লবণ, বস্ত্র, সুপারি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। জেমস টেলরের মতে, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় ইংরেজ, এ্যাংলো এন্ডিয়ান, পর্তুগিজ আর্মেনীয়, ফরাসি ও ডাচদের মিলিয়ে মোট ৩০৪ জন ব্যক্তি ঢাকায় বাস করতেন। ওয়ালটার্সের তথ্যসূত্রে, ১৮৩২ সালে ঢাকায় মোট গ্রীক বাড়ির সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ টি৷ কিন্তু এসব বাড়িঘরের অধিকাংশই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। সেন্ট থমাস নামক যে গির্জাটির মিডফোর্টে ১৮২১ সালে স্থাপিত হয়েছিল তা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে যায়।
কর্নেল ডেভিডসনও রমনায় (বর্তমান টিএসসি) গ্রীকদের সমাধি সৌধের কথা তার ভ্রমণকাহিনিতে উল্লেখ করেছেন।
বিশ্ব ব্যাংক সদর দপ্তরে প্রফেসর হিসেবে নিয়োজিত হেলেনাবাদ আবাদাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত এই সমাধি সৌধ সম্পর্কে তার উল্লেখ করেন, “A small yellow building that looks a little like a Greek Temple faces the campus wall near the Teacher-Student Centre of Dhaka University. it looks old and was in very bad state until the 1960 s when University authorities renovated it. A mysterious inscription is written on the frieze above the entrance to the building. ”
কার্নিশ এর নিচে আশ্চর্যজনক কারুকাজপূর্ণ লেখাগুলো অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম। গ্রীক লেখাগুলো অনেককের পক্ষেই পাঠোদ্ধার করা কঠিন হবে। সমাধি-৷ সৌধটির সম্মুখভাগেও এমন একটি লেখা রয়েছে যার সম্ভাব্য অর্থ, “Happy are those whom you choose and took with you” অর্থাৎ, তারাই ভাগ্যবান তুমি যাদের পছন্দ করে কাছে টেনেছ। তবে লেখাটি মোটেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্কিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১২০ বছর পূর্বে এই সমাধিসৌধটি স্থাপিত হয়েছিল।
সমাধিসৌধের কার্নিশের লেখা ছাড়াও এর ভেতরে নয়টি এপিটাফ রয়েছে। ধারণা করা হয় প্রতিটি এপিটাফ একেকটি কবরের জন্য ছিল। এই এপিটাফের পাঁচটি গ্রীক ভাষায় লিখিত এবং চারটি ইংরেজি ভাষায় লিখিত।প্রথমে পিটাপিটি লেখা হয়েছে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮০০ সালে ৩৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা আলেকজান্ডারের স্ত্রী ইস্তাম্বুল থেকে আগত সুলতানার নামে। গ্রীক ভাষায় লেখা দ্বিতীয় এপিটাফটি ইস্তাম্বুল থেকে আগত থিওডোরের স্ত্রী ১৮০৫ সালের ১০ এপ্রিল লোকান্তরিত হওয়া থিওডোরসিয়ার। তৃতীয় এপিটাফটি ১৮১৯ সালের ২২ জুন ৪৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা মিস্টার জোসেফ জর্ডানের স্ত্রী মিসেস ম্যাগডালেন সুফিয়া জর্ডানের। ষষ্ঠ এপিটাফটি ঢাকা কলেজের শিক্ষকের, ১৮৬০ সালে ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সপ্তম এপিটাফে আছে ১৮১০ এর মার্চে লোকান্তরিত হওয়া পাদ্রী ন্যাথানিয়েল এর কথা। অষ্টম এপিটাফটি ১৮০৬ এর ২৪ জুলাই মৃত্যুবরণ করা ব্যবসায়ী কনষ্টানটাইনের কথা। নবম এপিটাফটি জন ডিমেট্রিয়াস ইলিয়াসের, ১৮৩৬ সালে লোকান্তরিত হন।
সমাধিসৌধে গ্রীকদের লিখনরীতি দেখে বোঝা যায় যে তারা বর্তমান খ্রিস্টীয় সালের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মূল খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডারের তারিখ কোথাও কোথাও ব্যবহার করেছেন। এই স্মৃতিস্তম্ভের লেখাগুলো গ্রীকদের অসবর্ণের মধ্যে বিবাহরীতিও একটি প্রমাণ।
গ্রীক স্থাপত্যের এই বিরল নিদর্শনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত এখনই সংস্কার করে সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ।
সাধারণ সম্পাদক
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ