ঢাকামঙ্গলবার , ২৫ মার্চ ২০২৫
  1. সর্বশেষ
  2. বিশেষ সংবাদ

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংকট সম্ভাবনা

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
২৪ মার্চ ২০২৫, ২:২৭ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

শিক্ষা মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রধান স্তম্ভও বটে। এই শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পৃথিবীব্যাপী গড়ে উঠেছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত চারটি স্তরে বিভক্ত—প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা। শিক্ষার এই ধারাবাহিক পথ পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের জন্য।একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই পাঠদানের স্থান নয়, বরং এটি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এমনকি একটি শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা একটি দেশকে বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশের এই মূল্যবান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ অবহেলার শিকার হচ্ছে ।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বর্তমানে ৫৭টি পাবলিক,১১৫টি প্রাইভেট ও ৩টি আন্তর্জাতিকসহ সবমিলিয়ে ১৭৫ টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেখে আনন্দিত হলেও, এসবের মান নিয়ে রয়েছে চরম হতাশা।শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, শিক্ষার সঙ্গে কর্মের দূরত্ব, ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা, শিক্ষা বাজেটের অপ্রতুলতা, শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতির বিস্তার, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ইত্যাদি বিষয় বহুলাংশে দায়ী। ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুসারে, একটি দেশের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অথবা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬ শতাংশ।আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলা হলেও গত বছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির তুলনায় মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১:২০।অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এক জন করে শিক্ষক থাকতে হবে। শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১ এর মতে,বাংলাদেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৬০ টি, যার ৫০ টি সরকারি, ১০৮টি বেসরকারি ও ২ টি আন্তর্জাতিক। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৩৩৫২৯ এবং শিক্ষক সংখ্যা ৩০৯৭৬, যার শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত প্রায় ১:৪০।আর শুধু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনুপাত ১:৫৮।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে সেখানে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭০১৮ এবং শিক্ষক সংখ্যা ১৯৯২।যার গড় অনুপাত ১:১৮ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এ অনুপাত ঠিক থাকলেও সকল বিভাগে এ অনুপাত রক্ষা পায়নি।ব্যাবসায় শিক্ষা অনুষদেরসবচেয়ে প্রথম সারির তিন বিভাগে ১:২৫ এবং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এ অনুপাত প্রায় ১:৩৩, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এ অনুপাত প্রায় ১:৪২।এছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক -শিক্ষার্থী অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নেই বললেই চলে।অন্যদিকে,আমেরিকার এক শিক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০২২ সালের সেখানে শিক্ষক ছাত্র গড় অনুপাত ১:৫।যেখানে MIT ও University of California এর অনুপাত ১:৩।

দেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও গবেষণার অন্যতম বাধা প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ।এ প্রসঙ্গে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল।তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য শর্ত ছিল পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে।কিন্তু সত্যেন বোস তখন জগদ্বিখ্যাত আইনস্টাইনের সাথে গবেষণায় মত্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল সব হিসাব -নিকাশ নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপ্তি দিলে তাঁর বন্ধু মেঘনাদ সাহা তাঁকে আবেদন করতে বলেন।জনাব বোস তখন তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি নেই বলে জানিয়ে আবেদন করতে অস্বীকৃতি জানান নিয়মানুযায়ী, যদিও পরে আইনস্টাইনের রেফারেন্সে তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন। আর বিগত সরকারের আমলে পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপকতো বটেই হয়েছিলেন উপাচার্য এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ ইউজিসির চেয়ারম্যানও।

বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা জ্ঞান সৃষ্টির আধার হিসেবে গণ্য করি, সেখানে উপযুক্ত গবেষণা থাকতেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যতটা আগ্রহী, গবেষণার বিষয়ে ততটাই অনাগ্রহী।বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রমে বাংলাদেশ যে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে, তারও অন্যতম কারণ যে গবেষণায় দুর্বলতা ও অপ্রতুলতা, তা–ও আমাদের শিক্ষার অভিভাবকেরা বুঝতে চান না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার বরাদ্দের ২ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও ১ শতাংশের কম ব্যয় করে থাকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমপর্কে তাই আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণাপত্র নেই, যা আছে ;তাকে কেবল প্রমোশনপত্রই বলা যায়।’

দেশে পঞ্চাশের অধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্বেও আবারও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কেন? পড়াশোনার মান নির্ধারণে কোনো প্রতিষ্ঠান কলেজ না বিশ্ববিদ্যালয় সেটি মুখ্য বিষয় নয়। বরং মূখ্য বিষয় হলো শিক্ষার গুণগত মান, গবেষণার সুযোগ, শিক্ষকদের যোগ্যতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোর ওপর।বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, যা ২০২৫ সালে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে ৯ম , কিংস কলেজ ৩৬তম,লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (LSE), যাকে বলা হয় ‘ইকোনমিক্সের মক্কা’ ৫০ তম। বহু নোবেলজয়ী ও প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। নামের মধ্যে “University” শব্দ না থাকলেও, এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।পৃথিবীর অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান MIT (Massachusetts Institute of Technology)-এর নামেও “University” শব্দটি নেই, তবু এটি গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা।ভারতের সেরা ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টি কলেজ বা ইনস্টিটিউট, যার মাত্র ২টি বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের শিক্ষার্থীরা তো কখনো কলেজ বা ইন্সটিটিউট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে রাস্তা অবরোধ করে, জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে আন্দোলন করেনি? তবে আমাদের এখানে কেন!

উচ্চশিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের অভাবও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সংকট। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তারা রাত-দিন পড়াশোনা করেও চাকরির নিশ্চয়তা পান না। অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে ঈদেও বাড়ি যেতে পারেন না। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন তাকিয়ে থাকেন সুসংবাদের অপেক্ষায়। গ্রামের মানুষ প্রশ্ন করে, “বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পড়লে, চাকরি কবে হবে?” এই তীক্ষ্ণ বাস্তবতাই বুঝতে পারে একজন হতাশ স্নাতক।যেখানে গোটা দেশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে, সেখানে শুধুমাত্র “বিশ্ববিদ্যালয়” তকমা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করা কি শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন নিয়ে ছদ্মবেশী হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়?

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নানা সংকটের মুখোমুখি। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন, গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি এবং দক্ষ শিক্ষকের নিয়োগ নিশ্চিত করাই হবে সত্যিকারের উন্নয়নের পথ। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যের মূল চাবিকাঠি গবেষণা ও উদ্ভাবন, যেখানে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এখনও পিছিয়ে আছে।অতএব, শিক্ষাকে শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যম না ভেবে, সেটিকে সত্যিকার অর্থে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করতে হবে। নতুবা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেবলমাত্র ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হয়েই রয়ে যাবে।

মোছা: জেসমিন আক্তার
শিক্ষার্থী (এমবিবিএস) : দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ, দিনাজপুর

34 Views

আরও পড়ুন

হামজার অভিষেকে ভারতকে আটকে দিল বাংলাদেশ

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের স্থান বাংলার জমিনে হবেনা– নুরুল বশর আজিজী

জাতীয় সাংবাদিক মঞ্চ সিলেট বিভাগীয় কমিটির পক্ষ থেকে পথচারীদের মাঝে ইফতার বিতরণ

নাগেশ্বরীতে বেকার মুক্ত পরিষদের ইফতার ও দোয়া অনুষ্ঠিত

শান্তিগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ১৭

শান্তিগঞ্জে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে শহীদ তালেব ও কৃপেন্দ্র দাশের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান যুবদলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

সুনামগঞ্জে আইএফআইসি ব্যাংকের উদ্যোগে ইফতার ও দোয়া মাহফিল ::

বিআরটিসি’র ডিপোতে সাংবাদিকদের উপর হামলা, ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম

২৬শে মার্চকে ঘিরে অজানা এক আতঙ্ক বিরাজমান-নিজাম উদ্দিন

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টাকে সহকারী শিক্ষা অফিসার এসোসিয়েশন নেতৃবৃন্দের স্মারকলিপি

শান্তিগঞ্জ প্রেসক্লাবের দোয়া ও ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত