——–
সমাজকর্ম আজ সাহায্যকারী পেশা হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। বিশেষ করে পৃথিবীর উন্নতদেশসমূহ যেমন: যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড,বেলজিয়াম, জার্মানি এবং আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও আধুনিক সমাজকর্ম বা পেশাদার সমাজকর্মের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশ্বায়নের এই যুগে সমাজকর্মের বিভিন্ন শাখার প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান সমস্যায় জর্জরিত দেশসমুহ উপলব্ধি করছে! আজকের আধুনিক সমাজকর্ম তার যাত্রা প্রাক্কালে কেবল মনো-সামাজিক সমস্যা সমাধানে কাজ করত কিন্তু বিশ্বায়ন এবং আধুনিকায়নের এই যুগে ক্রমাগত মানুষের সমস্যা বাড়ছেই, সমস্যার ধরন,প্রকৃিত, পদ্ধতির পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজকর্মের শাখা যুগোপযোগী হয়ে বাড়তে শুরু করেছে ফলে সমাজকর্মের অনুশীলনের ক্ষেত্র উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রতিমুহূর্তেই পরিবর্তনশীল বিশ্বায়নের এই যুগে এসে আজকের সমাজকর্ম আধুনিক সমাজকর্মে রুপান্তরিত হয়েছে, লাভ করেছে পেশাগত মর্যাদাও। আধুনিক সমাজকর্ম এখন আর সনাতনী সমাজসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেনা। বরং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে,সেনাবাহিনীতে,বিভিন্ন অফিস-আদালতে,সরকারি বিভিন্ন সংস্থায়, বিভিন্ন জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থায়, বিভিন্ন এনজিও তে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থায়, ব্যাক্তিগত,পারিবারিক ও বৈবাহিক সমস্যায়, হাসপাতালে,মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়, বিভিন্ন সংশোধনাগারে, প্রবীণ হিতৈশী সেবায় ইত্যাদি ক্ষেত্রেই আধুনিক সমাজকর্ম জ্ঞান অর্জন এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্বায়নের এই যুগে শিক্ষার বিচরন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে বিদ্যালয় সমাজকর্ম। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানো এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিবাকদের সাথে সমন্বয় করে থাকে বিদ্যালয় সমাজকর্মী। বিদ্যালয় সমাজকর্মীরা সাধারনত ব্যাক্তি কেন্দ্রিক সমাজকর্ম, এবং প্রয়োজনে দল সমাজকর্ম পদ্ধতি ব্যাবহার করে স্কুলে যাওয়ার উপযোগী শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা, পারিবারিক ও মনো-সামাজিক কারণে স্কুলে উপস্থিত না থাকা, স্কুলে পড়াশুনায় মনোযোগী না হওয়া , বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া এবং স্কুলের দায়িত্ব পালনে অপরাগ বা উদাসীন শিশুদের নিয়ে কাজ করে এবং শিশুর শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের সঠিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিদ্যালয় সমাজকর্মের প্রথম যাত্র শুরু যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক,বোস্টন এবং শিকাগো শহরে স্কুলগামী শিশুদের মানসিক বিকাশ, উপযুক্ত পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান নানাবিধ সমস্যা দূর করে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার মাধ্যমে শিশুর সঠিক বিকাশে ১৯০৭-০৮ সালের দিকে বিদ্যালয় সমাজকর্ম চালু হয়এবং বেতনভুক্ত বিদ্যালয় সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পর ৭০ এর দশকে জার্মানিসহ অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও বিদ্যালয় সমাজকর্ম নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতেও ১৯৭০ সালের দিকে পেশাদার বিদ্যালয় সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া শুরু করে এবং সেখানকার প্রায় ৮০০টিরও বেশি অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যালয় সমাজকর্মীর নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়।
আজকের শিশুই আগামি দিনের ভবিষ্যত। আজকের শিশুই আগামি দিনে দেশ ও জাতির কান্ডারী হিসেবে কাজ করবে।এরাই নেতৃত্ব দিবে আগামির বিশ্বকে। এরাই একদিন হয়ে উঠবে কেউ কবি, কেউ সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ শিক্ষক,ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, লেখক কিংবা চিকিৎসাবিদ। এভাবেই আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিবে দেশকে, তাদের ঘাড়েই ন্যস্ত হবে বিশ্ব পরিচালনার দায়িত্ব। আর এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা খুবই জরুরি। শিশু পরিচর্যার মধ্যে লক্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে শিশুর সঠিক ও গুনগত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির প্রতি খেয়াল রাখা।
বাংলাদেশে প্রাথমিকও মাধ্যমিক স্তরে শিশুদের পড়াশুনার দিকটি অনেকাংশে কম গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। আমাদের দেশের স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি, নবম-দশম থেকে একাদশ শ্রেণি এ সময়গুলোতেই বিভিন্ন আর্থিক,সামাজিক, মানসিক কারণসহ নানা কারণে শিশুদের পড়াশুনার পথ বন্ধ হয়ে যায় অথবা করে দেওয়া হয়। এখানে বন্ধ হওয়া মানে এখানেই তাদের শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে। আমাদের দেশে অল্প বয়সে শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়া শিশুদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই! কি কারণে কারণে শিশুটি স্কুলে যাচ্ছে না, শিশুটির স্কুলে না যাওয়ার পেছনে কোন কোন কারণগুলো দায়ী, শিশুর শিক্ষার সাথে জড়িত যাবতীয় পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ইত্যাদি সমস্যার কি সমাধান হতে পারে এসব নিয়ে ভাবার মতো বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যাক্তি আমাদের দেশে নেই। এসব বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছেনা বলেই আমাদের দেশের শিশুরা অন্যান্য দেশের শিশুদের মতো গুনগত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেনা। শিশুর শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান এবং পরামর্শ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিদ্যালয় সমাজকর্মী যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশে শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বৃদ্ধি এবং জ্ঞানগত বিকাশের অন্যতম অন্তরায় এবং প্রতিবন্ধকতা হলো ৫৬ ভাগ পিতা-মাতাই তাদের সন্তানদের ঠিকভাবে বুঝতে পারেনা। তাছাড়া শিশুদের বড় একটা অংশের কোনো বন্ধু থাকেনা যা তাদের মানসিক ও জ্ঞানগত বিকাশের অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু একজন বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিশুদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের বুঝার চেষ্টা করে এবং তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে যা বিদ্যালয় সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। তাছাড়াও, আমাদের দেশের শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো পিতা-মাতার আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলনামুলকভাবে খারাপ হওয়ার কারণে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনা।
আজকাল অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের প্রত্যাশিত বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকেনা আর থাকলেও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ -সুবিধা দেওয়া না। এক্ষেত্রে তাদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং সুবিধা সৃষ্টিতে বিদ্যালয় সমাজকর্মী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশে আরেকটি সমস্যা যা অনেকেই চিন্তা করেন না সেটি হলো দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তি করানোর সুযোগ খুবই নগণ্য কিন্তু তারাও এদেশের নাগরিক। তাদেরও তো শিক্ষার প্রয়োজন।তবে তারা তাদের অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবে? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার নিশ্চিত করণে একজন বিদ্যালয় সমাজকর্মী বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, সরকার এবং তাদের পরিবারেরর সাথে যোগাযোগ করে তাদের শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করণেও ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই আমাদের দেশেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক ও জ্ঞানগত বিকাশে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতোই পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
লেখক:
রাজু আহমেদ;
শিক্ষার্থী:-সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।