——
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শিমুল পারভিন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি হাসপাতালটিতে করোনা, ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন। রোগী হাসিমুখে বাড়ি ফিরলে নিজেও হাসিমুখে বাড়ি ফিরতেন। তবে ডেঙ্গুতে বড় ছেলেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) থেকে নিয়ে বাসায় ফিরতে পারলেও এই মা ছোট ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ঢাকার টঙ্গীতে থাকেন শিমুল পারভিন। তাঁর স্বামী মো. তাজুল ইসলাম গাজীপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এই দম্পতির বড় ছেলে অয়ন ইসলাম টঙ্গীর সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে আলিফ ইসলাম বেঞ্চমার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কেজিতে পড়ত। তাকে বাসায় সবাই আদর করে সায়ন নামে ডাকতেন। সায়নের জন্ম হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩ জুন, মারা যায় ১৩ সেপ্টেম্বর। ১০ সেপ্টেম্বর জ্বর আসে, ১১ সেপ্টেম্বর তাকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা খারাপ হলে তাকে লালমাটিয়ার আল মানার বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনটি হাসপাতাল ঘুরে তিন দিনের মধ্যেই হারিয়ে গেল সায়ান।
আজ রোববার মুঠোফোনে কথা হয় শিমুল পারভিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে নিতেই অ্যাম্বুলেন্সে বসেই বুঝতে পারি, ছোট ছেলের অবস্থা খারাপ। মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। পরে ছেলের লাশ কুর্মিটোলা হাসপাতালে এনে হিমঘরে রাখি। তখনো তো বড় ছেলে আইসিইউতে। ছোট ভাই মারা গেছে, তা বড় ছেলেকে জানানো ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। চিকিৎসক বললেন, “আপনি মা, এই সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।” তারপর আমি হাসিমুখেই আইসিইউতে ঢুকি। স্বামী সঙ্গে ছিলেন। আইসিইউতেই ছেলের বিছানায় বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম। জানালাম কঠিন কথাটা। বড় ছেলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি স্বপ্ন দেখেছি ভাই মারা গেছে।”’
গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার বেঞ্চমার্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের কেজির ছাত্র আলিফ ইসলামের আঁকিবুঁকির এসব খাতাই এখন মায়ের কাছে ছেলের স্মৃতিচিহ্নছবি: সংগৃহীত
সায়নের জীবনটা সংক্ষিপ্ত হলেও পুরো বাসায় তো অনেক স্মৃতি। স্কুলের খাতায় তার ঝকঝকে লেখা। এইটুকু বয়সেই সে খবর শুনত। রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করত। খাতায় রাজনৈতিক নেতা–নেত্রীদের ছবিও আঁকত। বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা হয়েছিল। দেখতেও খুব সুন্দর ছিল। সেই ছেলের এভাবে মৃত্যু নিয়ে শিমুল পারভিন বলেন, ‘আমি তো মা, ছেলে মারা যাওয়ার আগে যে দৃশ্য দেখেছি, ছেলের যে কষ্ট দেখেছি, তা এই জীবনে কেমনে ভুলব!’
শিমুল পারভিন জানান, ২০২১ সালে করোনা হলে বড় ছেলে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে যায়। তখন বাসার অনেক কাজের দায়িত্ব সাত বছরের সায়নই সামলাত। বৃষ্টি এলে দরজা–জানালা বন্ধ করতে হবে, বাইরে থেকে কাপড় ভেতরে আনতে হবে—এ ধরনের কাজগুলোর কথা তাকে বলে দিতে হতো না।
ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই ছেলেকে নিয়ে নার্স মায়ের হৃদয় ছোয়া সংগ্রাম
শিমুল পারভিন সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকে তাঁর সংগ্রামের কথা বলছিলেন। তিনি জানালেন, প্রথমে তাঁর স্বামীর ডেঙ্গু হয়। চিকিৎসককে দেখিয়ে বাসাতেই স্যালাইন দেওয়াসহ অন্যান্য ব্যবস্থাপনায় দ্রুত ভালোও হয়ে যান। তবে স্বামী ভালো হতে না হতেই ৫ সেপ্টেম্বর ১৪ বছর বয়সী বড় ছেলে অয়নের অস্বাভাবিক জ্বর আসে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে আইসিইউ পাওয়া যায়নি, পরে সহকর্মীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চেষ্টায় আইসিইউতে একটি শয্যা পাওয়া যায়। তখন ছোট ছেলে সায়নকে রাজধানীর কল্যাণপুরে তার ফুফুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে মশা আছে, আবার ডেঙ্গু রোগীও আছে, তাই ছোট ছেলেকে হাসপাতালে এনে রাখতে মন সায় দেয়নি।
বড় ছেলে আইসিইউতে যাওয়ার আগে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নেয়। মুঠোফোনে সে সময়ের একটি ভিডিও করেছিলেন শিমুল পারভিন। তিনি বলেন, দুই ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে সেই মুঠোফোনও হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ছোট ছেলের শেষ স্মৃতিটুকুও হারিয়ে গেছে। এই মুঠোফোনেই ছেলের সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ছবি ছিল।
শিমুল পারভিন বলেন, তিনি ছোট ছেলেকে ‘আম্মু’ বলে ডাকতেন। বড় ছেলের অবস্থা খারাপ, ফুফুর কাছে থাকা ছোট ছেলের সঙ্গে পুরো এক দিন কোনো কথা বলারই সুযোগ পাননি। পরে ফোন করলে জানায়, সে ভালো আছে, ফুফুর হাতে ভাত খেয়েছে, ফুফুর মুঠোফোনে গেম খেলছে। কিন্তু পরে ফুফুর বাসা থেকে খবর এল, সায়নের জ্বর হয়েছে এবং তার জ্বরও অস্বাভাবিক মাত্রার। বমিও করছিল। শিমুল পারভিন ভয় পেতে শুরু করলেন। ননদের স্বামীকে বললেন, ছেলেকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। চিকিৎসক দেখলেন। তখন ছেলের রক্তের ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়নি বলে প্রথম দিন ওকে আর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। পরে ডেঙ্গু পজিটিভ হলে ছেলেকে ভর্তি করা হয়।
শিমুল পারভিন জানান, এক ছেলে আইসিইউতে, আরেক ছেলেও হাসপাতালে ভর্তি। দুই জায়গায় যাওয়ার জন্য লিফটের জন্য অপেক্ষা করারও সময় পাননি। নিজের দুই পা ফুলে যায়। স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়, সহকর্মী পাশে ছিলেন সব সময়।
‘কিন্তু আমি যেহেতু নার্স, তাই ছেলের জন্য রক্ত লাগবে, ওষুধ লাগবে—এসব ব্যাপারে আমাকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছে,’ বলেন তিনি।
হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় ছোট ছেলেকে প্রস্রাব করিয়ে, খাবার খাইয়ে শিমুল পারভিন যখন বড় ছেলের কাছে যেতে চান, তখন ছোট ছেলে বলে, ‘আম্মু, আমি তোমার পাশে একটু ঘুমাতে চাই।’ শিমুল পারভিন বললেন, ছেলেকে পাশে নিয়ে আর ঘুমানো হয়নি। বড় ছেলের কাছে থাকা অবস্থাতেই স্বামী ফোন করে জানান, সায়নের খিঁচুনি হচ্ছে। অস্বাভাবিক মাত্রায় আবার জ্বর শুরু হয়েছে। খিঁচুনির ফলে নিজের চুল নিজে টানছে। ওই অবস্থাতেই সে তার বাবা ও ফুফুকে বলছিল, ‘তোমরা আমাকে বাঁচাও।’
শিমুল পারভিন বলেন, ‘আমি ছোট ছেলের কাছে যাওয়ার পর আমার বুকে মাথা রেখে ছেলে একটু ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু আবার খিঁচুনি শুরু হয়। কিন্তু হাসপাতালে শিশুদের পিআইসিইউ না থাকায় কোথায় পিআইসিইউ আছে, তার খোঁজ শুরু হয়। কুর্মিটোলা থেকে লালমাটিয়ার আল মানার বিশেষায়িত হাসপাতালে রওনা দিই রাত দেড়টার দিকে। সেই রাতেও আমার দুই সহকর্মী সঙ্গে ছিলেন।’
ছেলেকে হাসপাতালটির পিআইসিইউতে নেওয়া হলেও চিকিৎসক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তার অবস্থা ভালো নয়। শিমুল পারভিন বলেন, ‘পিআইসিইউতে ঢুকে দেখি ছেলের চোখ বন্ধ, পানি পড়ছে। খিঁচুনি হচ্ছেই। চিকিৎসক বললেন, “আপনারা দোয়া পড়েন, ছেলের কষ্ট হয়তো একটু কমবে।” ছেলেকে এই হাসপাতালে অনকলে যে দুজন চিকিৎসক দেখছিলেন, তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। তাই ছেলেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল।’
দুই ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার ছিল মো. তাজুল ইসলাম ও শিমুল পারভিন দম্পতির; ডেঙ্গুর হানায় সেখানে এখন সন্তান হারানোর ব্যথাছবি: সংগৃহীত
শিমুল পারভিন বলেন, ‘ছোট ছেলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে বড় ছেলের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ছোট ছেলেকে অন্যদের দেখতে বলে কুর্মিটোলায় গেলাম বড় ছেলেকে দেখতে। ছেলে যাতে কিছু বুঝতে না পারে, তাই হাসিমুখেই ঢুকলাম আইসিইউতে। দেখলাম বড় ছেলে একটু অভিমান করেছে। সে যে কী অভিজ্ঞতা, তা বলে বোঝানো যাবে না।’
বড় ছেলে বাসায় ফিরে এখন খুব বেশি একা হয়ে গেছে। শিমুল পারভিন বলেন, ‘দুই ভাইয়ে খুব বেশি ভাব ছিল। খুনসুটিও করত। চোখের সামনে থেকে ছোট ভাইটা নাই হয়ে গেছে, বড় ছেলে তা মানতে পারছে না। আইসিইউতে থাকার ফলে তারও নানা শারীরিক জটিলতা যাচ্ছে।’
১৯ বছরের সংসারজীবনে স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে শিমুল পারভিন খুবই সুখী ছিলেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘ছেলেদের সামনে স্বামী–স্ত্রী কখনো ঝগড়া করেননি, যাতে ছেলেদের মনের ওপর চাপ না পড়ে। এত কিছু করে বড় করার পরও ছোট ছেলেটা ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।’
নিজে নার্স, কুর্মিটোলা হাসপাতালসহ যে হাসপাতালেই গিয়েছেন, সেখানেই ছেলের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসাসুবিধা পেয়েছেন বলে মনে করছেন শিমুল পারভিন। তবে ছেলে মারা গেছে, তাই ‘যদি, তবে, তাহলে’—এমন অনেক আফসোস তো থাকবেই। নিজের অভিজ্ঞতায় শিমুল পারভিন বলেন, জেলা পর্যায়সহ সব হাসপাতালে আইসিইউ ও পিআইসিইউ থাকা জরুরি, যাতে রোগী নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে না হয়।
শিমুল পারভিন এত কষ্টের পরও নিজেকে গুটিয়ে নেননি। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে শিমুল পারভিন নাম বললে অনেকেই আমাকে চেনেন। পারতপক্ষে রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর ভেবেছি, আগের চেয়ে রোগীদের ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করব। সবাই আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন।’
লেখক : মানসুরা হোসাইন
প্রথম আলো থেকে নেওয়া সেবিকা মায়ের হৃদয় ছোয়া সংগ্রাম