রফিকুল ইসলাম জসিম: একটি আদর্শ জাতি গঠনে একজন আদর্শ নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা একজন পুরুষের জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, একজন নারীর জন্যও ঠিক ততটুকুই অপরিহার্য। জাতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারী শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নেপোলিয়নের উক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়- ‘ আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।
বাংলাদেশের বসবাসরত মুসলিম মণিপুরী পাঙাল সম্প্রদায়ের দ্বীনি ইলম নারীশিক্ষা একেবারে কম৷ অভিবাভকেরা মনে করে নারী শিক্ষা অলাভজনকভাবে দেখে। কারণ- মেয়েদের লেখাপড়া করাতে খরচ হবে, বিয়ে দেওয়ারও খরচ আছে – এসবের বিবেচনায় নারীদের উচ্চ শিক্ষায় এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
মুসলিম মণিপুরী সম্প্রদায়ের একমাত্র মেয়ে সালেহা বেগম ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পাস করেছেন। মাদ্রাসা লাইনে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনিই একমাত্র উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে। তার এই সাফল্যে মুসলিম মণিপুরী সমাজকে গর্বিত করে। তার মেধার কৃতিত্বের মাধ্যমে মুসলিম মণিপুরি সমাজে মাদ্রাসা নারীদের পড়াশোনা চর্চাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আলেমা মুহাদ্দিস সালেহা বেগম তার শিক্ষা জীবনের কয়েকটি ধাপে মুখোমুখি হয়েছিলেন ব্যতিক্রমী সব অভিজ্ঞতার কথা। তার জীবনের গল্প লিখেছেন রফিকুল ইসলাম জসিম।
সালেহা বেগমের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়৷ ১৯৯৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন আদমপুর ইউনিয়নের ঘোরামারা (বন্দর গাঁও) গ্রামের একটি মুসলিম মণিপুরী সম্প্রদায়ের পরিবারে। তার বাবা ডাক্তার জুমেরআলী, পরিবার তাঁকে মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়। কারণ- একজন আলেম হলে দুনিয়াবিও ঠিক থাকে, আবার আখিরাতেও ঠিক থাকে। এই নিয়তেই মাদ্রাসা শিক্ষায় পড়া। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে ২০০৭ সালে ওসমান আলী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা ভর্তি করেন৷ এই মাদ্রাসা থেকে ২০১৩ সালে দাখিল উত্তীর্ণ হন। এরপর সফাত আলী সিনিয়র ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায় ২০১৭ আলিম ও একই মাদ্রাসায় ২০২০ সালে ফাজিল উত্তীর্ণ হন৷ এরপর ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এর অধীনে মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসা হতে ২০২৪ সালে হাদিস বিভাগ থেকে কামিল পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
রফিকুল ই. জসিম: মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরুর গল্প জানতে চাই৷
সালেহা বেগম: আমার পরিবারের চাওয়া ছিল আমি আলেমা হলে দুনিয়াবিও ঠিক থাকে, আবার আখিরাতেও ঠিক থাকে। এই নিয়তেই আমার মাদ্রাসা শিক্ষায় পড়া। আমাদের সকলের জীবনেই জীবনেই শিক্ষাজীবন শুরুর দিনটি একটি স্মরনীয় দিন৷ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করব, তাই আমি খুব উত্তেজনার করছিলাম। একটি সুন্দর সকালে মাদ্রাসার জন্য বানানো নতুন জামাটি পড়ে আমার মাদ্রাসা ওসমান আলী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা আসার যাত্রা শুরু হয়েছিল। একটি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নতুন মানুষগুলোর কথা ভেবে একটু মনে করে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। যদি ও গুটি গুলি পায়ে যখন মাদ্রাসায় পৌছাহ সেখানে নতুন নতুন সহপাঠিদের সাথে পরিচিত হয়ে আমার সকল জড়তা কেটে গিয়েছিল। আমার মাদ্রসায় শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তের পর। মাদ্রাসার শুরুর এ দিনটি আমার জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
রফিকুল ই. জসিম: পড়াশোনা সময়ে ফেলে আসা স্মৃতি সম্পর্কে থাকলে জানতে পারেন?
সালেহা বেগম: এই চলমান জীবনে আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই স্মৃতির পাতায় গিয়ে জন্ম হয়। কিছু কিছু স্মৃতি থাকে চির অমলিন। যা কখনো ভুলা যায়না। ঠিক তেমনি মাদ্রাসার পড়ার সময় অনেক ঘটনাই স্মৃতির পাতায় অমলিন হয়ে আছে। স্রোতের বিপরীতে যেখানে সবাই জেনারেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়, সেখানে আমি ভর্তি হয়েছিলাম মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার পড়াশুনার সময় শিক্ষকদের পাঠদান, কোন ভুল করলে শিক্ষকদের কড়া অনুশাসন,পড়াশুনা শেষ যা হাওয়ার পর এই সকল অতীত মন দুয়ারে বারবার কড়া নারে সোনালী আর বারংবার সনে হয় যদি ফিরে যেতে পারতাম সেই সোনালী অতীতে।
রফিকুল ই. জসিম: নারী আলেমা হিসেবে গড়তে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন কি না?
সালেহা বেগম: আলোকিত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত এবং রাষ্ট্রকে সামনের দিকে অগ্রসর করার প্রধান হাতিয়ার হলো নারীশিক্ষা, আমাদের দেশে নারী সমাজ ইসলামী শিক্ষা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। যদিও আমি অনেক ভাগ্যবতী যে আমার পরিবার, আমার সমাজে আমার নারী আলেমা হিসেবে গড়ে উঠতে কোন প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়নি। একজন নারী আলেমা হয়ে আমি যেন আমার পরিবার আমার সমাজে ইসলামী পরিবেশ বাজায় রাখতে সাহায্য করতে পারি আল্লাহ পাক আমাকে যেন কবুল করেন আমীন।
রফিকুল ই. জসিম: জেনারেল শিক্ষিত, মাদ্রাসা শিক্ষিত এই দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য কি?
সালেহা বেগম: জেনারেল শিক্ষা থেকে- মাদ্রাসায় যাওয়া বা ( SSC ও HSC শেষে ভতি করা যায় না। কিন্তু মাদ্রসা শিক্ষা থেকে (দাখিল, আলিম শেষে) কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেডিকেলে যায় বা ভর্তির সুযোগ রয়েছে। যেহেতু মাদ্রসা ও জেনারেল উভয় শিক্ষা সমান তাই সাদ্রসায় শিক্ষায় আমাদের জন্য লাভবান।
রফিকুল ই. জসিম: একজন আলেমা হয়েছে সেটা কি সফল হয়েছে বলে কি মনে হয়? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি
সালেহা বেগম: হ্যাঁ আমি নিজেকে অবশ্যই সফল হয়েছে মনে করি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো: নিজে, পরিবার, সমাজ-ইসলামী বিধি বিধান চর্চা করা, ধর্মীয় কুসংসকার দূর করা, ইসলামী সমাজ গঠন করা, ইসলামিক শিক্ষা সমাজ উন্নয়ন করা ইত্যাদি।
রফিকুল ই. জসিম: বর্তমান সমাজ ও পরিবারকাঠামোতে নারীর স্বাধীনতা বা মুক্তি কতটা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন?
সালেহা বেগম: নারীদের স্বাধীনতা বলতে ইসলামী বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা সমাজ ও পরিবার কল্যানে শালীনতা বজায় রেখে যে কোন কাজ করতে কোন বাধা থাকেনা। আগের তুলনায় বর্তমানে নারীর স্বাধীনতা শত ভাগ অর্জিত হয়েছে বলে মনে করি।
রফিকুল ই. জসিম: আলেমা, মুহাদ্দিস হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা বেশি? বা আপনার পড়াশোনা সময় সমর্থন, অনুপ্রেরণা দিয়েছিল কারা?
সালেহা বেগম: আলেমা মুহাদ্দিস হিসেকে গড়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা বেশি বা আপনার পড়াশোনার সময় সমর্থন, অনুপ্রেরণা দিয়েছিল যাবা-উত্তরঃ পিতা- মাতা, ভাই, বোন শিক্ষকমন্ডলী গুনী ব্যক্তিত্ব গন।
রফিকুল ই. জসিম: নারীরা মাদ্রাসা পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সাধনা বা ধৈর্য্য থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
সালেহা বেগম: মনের ইচ্ছা শক্তিই হলো প্রকৃত সাধনা। আমি বাংলা, ইংরেজী, গণিত, ছাড়া ও কুরআন হাদিস, আরবী, ফেকাহ, সহ আরো অনেক বই- অতিরিক্ত পড়তে হয়েছে। তাই ধর্য্যের সাথে অধ্যয়ন করতে হয়েছে।
রফিকুল ই. জসিম: নারীরা আলেমা তৈরি হলে ব্যাক্তি ও সমাজের পরিবর্তনে কতটা প্রভাব ফেলবে বলে কি মনে করেন?
সালেহা বেগম: সমাজের নারীরা আলেমা হলে ব্যক্তি ও সমাজ অবশ্যই পরিবর্তন হবে। কারণ জাতিকে শিক্ষিত করতে শিক্ষিত মানেই-যথেষ্ঠ। আর না। যখন আলেমা হবে তখন ইসলামী সমাজে সমাজ- পরিবর্তন ইনশাআল্লাহ।
রফিকুল ই. জসিম: আপনার/ আমাদের সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নারীদের উদ্দেশে কী বার্তা/ পরামর্শ কি দেবেন?
সালেহা বেগম: ইসলামের সোনালি যুগে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও নারীগণ নিজ আগ্রহে অথবা পারিবারিক ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে ঘরোয়া পরিবেশে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করে নিতেন। তবে যুগ বদলের সাথে বর্তমানে অনেক মহিলা মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, যেখানে অনেক নারী শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। মাদ্রাসার নারী শিক্ষার্থীদের কাছে চাওয়া কুরআন ও হাদীসের গুণাবলির আলোকে তারা যেন তাদের জীবন পরিচালনা করে। সমাজের সবাই যেন বলতে পারে মাশাআল্লাহ একজন মাদরাসার ছাত্রী।