সমাজের অলিতে-গলিতে, শহর থেকে প্রান্তরে আজ যেন একটিই মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে—“জিপিএ ৫ পেলেই জীবনের জয়গান।” অভিভাবকের চোখে সন্তানের সফলতা মাপা হয় সেই একটিমাত্র অঙ্কে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—একটি ফলাফল, একটি সংখ্যাই কি সত্যিই নির্ধারণ করতে পারে একজন মানুষের মেধা, মানসিকতা কিংবা ভবিষ্যৎ?মানুষের জীবনের গল্প কখনোই কেবল একটি রেজাল্টশিটে সীমাবদ্ধ থাকে না। জীবন হচ্ছে এক বহুমাত্রিক অভিযাত্রা—যেখানে সৃজনশীলতা, মনন, দক্ষতা, মূল্যবোধ, পরিশ্রম এবং মানবিকতা মিলেই গড়ে ওঠে প্রকৃত সফলতা।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় “জিপিএ ৫” যেন এক পৌরাণিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। পত্রিকার প্রথম পাতায়, ব্যানার পোস্টারে, সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়—“অমুক বোর্ডে সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ প্রাপ্তির রেকর্ড!” অথচ এর আড়ালে থেকে যায় হাজারো কিশোর-কিশোরীর চাপ, দুশ্চিন্তা, হতাশা এবং আত্মবিশ্বাস হারানোর গল্প।
শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এবার সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন। গত বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন।
অথচ পরিতাপের বিষয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দেখা যায়, তাদের অনেকেই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। এই পরিসংখ্যান একটাই কথা বলে—আমরা সংখ্যার পেছনে ছুটেছি, জ্ঞানের নয়।
জ্ঞানের চেয়ে মুখস্থ সংস্কৃতি:- বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সময় শেখার চেয়ে মুখস্থ করার নীরব প্রতিযোগিতা চলে। শিক্ষার্থী জানে না কেন এই সূত্র, কীভাবে এই তত্ত্ব জন্ম নিয়েছে—তবুও পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য মুখস্থ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এর প্রতিফলন হিসেবে ফলাফলও আসে চমকপ্রদ: জিপিএ ৫।কিন্তু যখন বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ আসে—সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যার সমাধান, সৃজনশীল চিন্তায়—তখন সেই জিপিএ ৫ তার দীপ্তি হারায়।
বিখ্যাত মনীষী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন,
“Education is not the learning of facts, but the training of the mind to think.”
অর্থাৎ, “শিক্ষার লক্ষ্য হলো মনকে চিন্তা করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া, আনুগত্য করার জন্য নয়” এবং “শিক্ষা হলো যা স্কুলের পরে মনের মধ্যে থেকে যায়”। এছাড়াও তিনি বলেছেন, “কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ” কারণ জ্ঞান সীমিত হলেও কল্পনা বিশ্বকে আলিঙ্গন করতে পারে এবং বিবর্তনকে জন্ম দেয়।
অন্য প্রান্তের গল্পগুলো:- একবার ভেবে দেখুন—স্টিভ জবস, বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ তাঁদের সাফল্যের পথ কোথায় জিপিএ ৫ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? স্টিভ জবস কলেজও শেষ করেননি, অথচ তাঁর সৃষ্ট “Apple” আজ প্রযুক্তি বিপ্লবের প্রতীক।
অন্যদিকে, আমাদের সমাজে এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা হয়তো জিপিএ ৫ পাননি, কিন্তু তাঁদের দক্ষতা, সততা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারায় কর্মক্ষেত্রে অর্জন করেছেন অসাধারণ সাফল্য।
একজন মাঝারি ফলাফলের শিক্ষার্থী ব্যাংকার হয়েছেন, কেউ উদ্যোক্তা হয়ে শত মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন, কেউ হয়তো শিল্পী হয়ে ছুঁয়ে গেছেন মানুষের হৃদয়।
জিপিএ ৫—পরিশ্রমের প্রতীক, কিন্তু গন্তব্য নয়:- এ কথা মানতেই হবে যে জিপিএ ৫ পাওয়া সহজ নয়। এটি পরিশ্রমের প্রতিফলন, শৃঙ্খলার প্রতীক। কিন্তু এটিকে জীবনের শেষ সীমা ভেবে নেওয়াই ভুল। কারণ জীবন কোনো গাণিতিক সমীকরণ নয়—এটি অনুভূতির, অভিজ্ঞতার, এবং সিদ্ধান্তের সমষ্টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রায়ই দেখা যায়—যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ ৪.৫ পেয়েছে, তারাই টিকে যায় সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতায়। কারণ তারা শুধুমাত্র বইয়ের জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের বিশ্লেষণ, যুক্তি ও প্রয়োগে দক্ষ।একজন অধ্যাপক একবার বলেছিলেন—“Exam result shows your preparation, not your potential.” অর্থাৎ ফলাফল বলে আপনি কতটা প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু আপনার সক্ষমতা কতদূর যেতে পারে তা নয়।
সামাজিক মানসিকতার বিপজ্জনক দিক: আমরা এমন এক সমাজ তৈরি করছি যেখানে জিপিএ ৫ না পাওয়া মানেই ব্যর্থতা। অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রতিবেশীরাও একজন শিশুকে বিচার করেন কেবল একটি রেজাল্ট দিয়ে।ফলে শিশুটি নিজের মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। অনেক সময় এ চাপ থেকে জন্ম নেয় মানসিক অবসাদ, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, “Overemphasis on grades creates underdeveloped minds.” অর্থাৎ, নম্বরের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব মানুষকে মানসিকভাবে অপরিপক্ব করে তোলে।
প্রয়োজন মূল্যবোধনির্ভর শিক্ষা:- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত কেবল নম্বর নয়, মানুষ তৈরি করা। শিক্ষার্থী যেন বুঝতে শেখে, চিন্তা করতে শেখে, প্রশ্ন করতে শেখে। শিক্ষা যদি হয়ে ওঠে জীবনের প্রয়োগের হাতিয়ার, তবে জিপিএ ৫ না পেলেও একজন শিক্ষার্থী তার স্বপ্নের দিগন্ত ছুঁতে পারবে।
ফিনল্যান্ড বা জাপানের মতো দেশে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয় সৃজনশীলতা, দলগত কাজ, সমস্যা সমাধানের দক্ষতার ওপর। আমাদেরও সেই পথে হাঁটতে হবে।
কারণ ভবিষ্যৎ সেই প্রজন্মের—যারা কেবল প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে না, বরং নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়।
জিপিএ ৫ পেলে অভিনন্দন প্রাপ্য—এটি নিশ্চয়ই অধ্যবসায়ের স্বীকৃতি। কিন্তু যদি কেউ তা না পায়, তবে সে ব্যর্থ নয়। ভবিষ্যৎ গড়ার মাপকাঠি কখনোই কেবল একটি গ্রেড হতে পারে না।সমাজের উচিত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তার নিজস্ব প্রতিভা ও গুণ অনুযায়ী মূল্যায়ন করা। কেউ বিজ্ঞানী হবে, কেউ লেখক, কেউ উদ্যোক্তা, কেউ শিক্ষক—সবাই মিলে গড়ে তোলে একটি দেশ, একটি সভ্যতা।
লেখক: জুবায়েদ মোস্তফা
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।