ঢাকাবৃহস্পতিবার , ১৯ জুনe ২০২৫
  1. সর্বশেষ

কবি ফররুখ আহমদ এর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ও আমাদের ভাবনা

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
১৯ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫০ অপরাহ্ণ

Link Copied!

——————————–
আজ প্রিয় কবি ফররুখ আহমদ এর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯১৮ সালের ১০ই জুন থেকে ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই ছোট্ট জীবনে আমাদের দিয়ে গেছেন অনন্তকালের কিছু অনন্য সৃষ্টি। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে তার পদার্পণ। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক দৈব সুর, ছন্দ আর প্রেম নিয়ে আবির্ভাব। এই নিষ্প্রাণ বাংলার অধঃপতিত উপক্রমে তিনি এসেছিলেন মুসলিমদের রেনেসাঁর কবি হয়ে।
তার কবিতায় কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো যা শুধু কাব্যেকে মর্যাদাপূর্ণ করেনি; বরং মুসলিম সমাজে এনেছিলো আমূল পরির্বতন। একটি নিষ্প্রাণ,পত্রহীন, শাখাহীন বৃক্ষকে যেনো গগনতুল্য পত্র আর শাখায় পরিপূর্ণ করে গেছেন।
আবুল ফজল লেখেন, ‘একটা সুনির্দিষ্ট মতাদর্শে প্রবল বিশ্বাসী হয়েও ফররুখ আহমদ বিশুদ্ধ কবি ছিলেন। এ কারণে আপন লক্ষ্যে সনিষ্ঠ থেকেও কবিতার নানা স্রোতে বিচরণ তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে। আদর্শনিষ্ঠ কবিতা সাধারণত একচোখা হয়ে থাকে। সুখের বিষয়!ফররুখ আহমদের বেলায় তা হয়নি। ’
“জীবন আমার করে যেন / দুঃস্থ জনে সমর্থন করে
দুঃখি এবং বৃদ্ধ জয়ীফ / যেন আমার হয় আপন।”
এই পঙক্তি দিয়ে ফররুখ আহমেদের যেনো অন্য এক সতত প্রমাণিত। ভালোবাসা দিয়ে প্রত্যেক আত্মাকে যেনো ধারন করেছেন হৃদয়ে।
সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ফররুখের কাব্যপ্রক্রিয়ায় যেহেতু একটা বিশ্বাসের উন্মুখরতা ছিল, তাই তার পাঠকের সংখ্যা আমাদের মাঝে সর্বাধিক। সে বিশ্বাসের একটা কল্লোলিত সমর্থন পেয়েছে। আবার ব্যবহৃত শব্দের পরিধির সার্থক বিবেচনায় এবং ধ্বনি সাম্যের কারণে অবিশ্বাসীরাও তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। ’ ফররুখের কাব্যে ছিলো ইসলামের আলোর তীর্যক রশ্মি। তাই আজও সমাদৃত।
মনে পড়ে “ঝরোকা” কবিতার মুক্তির উচ্ছ্বাস –
“সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও,খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।
আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো আর উচ্ছল আনন্দের মত বাগে..”
“সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা, আজাদ কর পাকিস্তান, কাফেলা, হে বন্য স্বপ্নেরা, মুহূর্তের কবিতা” কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা আমাদের দেয় মানবপ্রেম, শোষিত – বঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতি, ক্ষুধাতুর জীবের প্রতি মহানুভবতা, স্বজাতির প্রতি দায়িত্বের বিশালতা।অত্যন্ত সফল মহাকাব্য ফররুখ আহমদের ‘হাতেম তা’য়ী। দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্য সাধনায় সৃষ্টি করেছিলেন প্রায় অর্ধ- শতাধিক কাব্যগ্রন্থ। প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দশৈলী যেনো মানবধর্মের মুক্তির সুরে গাঁথা। মুসলিম রেনেসাঁর এই কবি মুসলমানদের জন্য দিয়ে গেছেন মুসার সমুদ্র পথের ন্যায় এক বিস্তীর্ণ গতিপথ। কিন্তু তার হস্তের লাঠির ন্যায় মুসলিম জাতি তাকে আগলে রাখতে পারেনি;ফলে তার গড়ে দেওয়া রাস্তা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে পুনরায়!
মানবের তরে তার ভালোবাসা, দুঃখ, কষ্ট, অভিযোগ সবই কবিতার প্রতিটি পঙক্তি চিৎকার করে করে বলে,
“কবিতার জন্য মোরা আরো একটি ফররুখ চাই”!
তার “হে বন্য স্বপ্নেরা” কাব্যের কিছু পঙক্তিতে বোঝা তার মানুষের জন্য কত মমতা, কত কষ্ট, কত বেদনার মহীধর —
“পথে পথে বাঁধা পড়ে। পলাতক সে ভগ্ন মিছিল
দেখে দ্বার রুধিয়াছে বহুদিন আগে এ নিখিল
তাহাদেরি অত্যাচারে। তারপর অদ্ভুত জনতা
মুখ গুঁজে পড়ে আছে শুধু ওঠে অশ্রু-আকুলতা
কণ্ঠতট চেপে ধরা শব্দহীন দুর্বোধ্য ভাষাতে
রাত্রি নেমে এ প্রান্তরে ক্রমাগত আশঙ্কার সাথে,
দুর্ভেদ্য, নিবিড় তার অন্তস্থল নাহি যার দেখা,
সূচি-চিহ্নহীন সেই তিমিরের, শেষ তটরেখা
শুধু দূরে সরে যায়; অবিরাম হেথা আর্তস্বর;
বাঁকা শিরদাঁড়া, ম্লান, মানুষের শিয়রে পাথর।”
আপন জাতির দুর্দশাপন্ন জীবনের জন্য তার দুঃখ, আর্তনাদ, ক্লেদ রয়েই ছিলো। মু্ক্তির জন্য বার বার আহ্বান করেছিলো তার অমর সৃষ্টির মাধ্যমে–
“কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানিনা তা
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?”
কবি শুধু কবিতার মাধ্যমে আমাদের কিছু ছন্দ আর সুরই দিয়ে যাননি; দিয়ে গেছেন কিছু স্বর্ণলিপি। কিন্তু আমাদের থেকে কিছুই নেয়নি। আমাদের মতো অধম জাতি তার কাছে চির ঋণী হয়ে রয়েছি তার অমর সৃষ্টির নিকট।
কিন্তু আমাদের নিকট তার প্রাপ্তি ছিলো ক্ষুধাতুর আত্মার হাহাকার যার ঋণ এ জাতিকেই শোধ দিতে হবে। তার এই করুণ পরিণতি দেখে আহমদ ছফা লেখেন- “আজকের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের মত একজনও শক্তিশালী ¯স্রষ্টা নেই। এমন একজন ¯স্রষ্টাকে অনাহারে রেখে তিলে তিলে মরতে বাধ্য করেছি আমরা। ভবিষ্যত বংশধর আমাদের ক্ষমা করবে না।”
হংকং থেকে প্রকাশিত ঋধৎ ঊধংঃবৎহ জবারবি পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ৮ নবেম্বর কবির মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর প্রখ্যাত সাংবাদিক মার্টিন ডেভিডসন লেখেন : ‘কিছুদিন আগে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ অনাহার। কর্তৃপক্ষের অনেকেই তাঁর মৃত্যুতে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
ইসলামী আদর্শ, কুরআনের আলো আর নিম্ন শ্রেণীর মানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন।
এজন্যই সাহিত্য সমালোচক ড. আহমদ শরীফ ফররুখ আহমদের এই চেতনাবোধ সম্পর্কে বলেন,
“আমাদের বাংলা ভাষায় স্বকীয় আদর্শে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, আদর্শ হবে কোরআনের শিক্ষা, আধার হবে মুসলিম ঐতিহ্যানুগ, বিষয়বস্তু হবে ব্যক্তি বা সমাজ অথবা বৃহদর্থে জগৎ ও জীবন।এভাবে আমাদের জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় জীবন গড়ে উঠবে। তরুণ কবি ফররুখ আহমদ একান্তভাবে মুসলিম ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাব্য সাধনা করে পথের দিশারির গৌরব অর্জন করেছেন।”
তাছাড়া তার কবিতায় ছিলো মুক্তির ডাক, আত্ম-নির্ভরতার প্রেরণা, নিষ্কৃতির অপেক্ষার প্রতিপাদন–
“পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের গান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
কবি ফররুখ আহমেদ শুধুমাত্র মানুষের দুঃখ দুর্দশা কিংবা মানব মুক্তি নিয়েই লেখেননি। লিখেছেনে প্রেমের কথা; তার কবিতায় পাওয়া যায় ভালোবাসার নিদর্শন। এজন্যই কবি আবু রুশদের ভাষায়, ‘ফররুখ আহমদ রোমান্টিক কবি। …তাঁর কাব্যে সৌন্দর্যের জয়গান অকুণ্ঠ। সুদূরের প্রতি আকর্ষণও তাঁর কাব্যের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তবু তিনি নিঃসন্দেহে আধুনিক কবি। তাঁর একটি বলিষ্ঠ সজাগ তীক্ষ অনুভূতিশীল মন আছে, যা সৌন্দর্যের অস্তিত্বকে স্বীকার করার সাহস রাখে; কিন্তু রোমান্টিসিজমের বিপদ সম্পর্কে যা সর্বদা সচেতন। ’
তার একটি কবিতার কিছু অংশে–
“পুরানো মাজারে শুয়ে মানুষের কয়খানা হাড়
শোনে এক রাতজাগা পাখীর আওয়াজ। নামে তার
ঘনীভূত রাত্রি আরো ঘন হ’য়ে স্মৃতির পাহাড়।
এই সব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে। জানি; – মুসাফির”
আমাদের এই রেনেসাঁর কবি শুধু আপন মানুষদের জন্য কবিতাই লেখেননি; কলম সঞ্চার করেছিলেন বায়ান্নের মাতৃভাষার জন্য। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। ’
মুক্তির প্রত্যাশী এক রত্নকে হারিয়ে আমাদের বাঙালী মুসলিম জাতির প্রেমপত্রে এক কালিমা লেগে গেলো; যা কোনোদিন মুছে যাবার নয়।
তার সম্পর্কে কবি শামসুর রহমান লিখেছেন, ‘তিনি মারা গেছেন একেবারে নিঃস্ব অবস্থায়। না, ভুল বললাম, নিঃস্ব কথাটা তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর মানসিক ঐশ্বর্যের কোনো কমতি ছিল না। তিনি রেখে গেছেন এমন কয়েকটি গ্রন্থ, যেগুলো পঠিত হবে দীর্ঘকাল। ’
তার “মুহূর্তের কবিতা” কাব্যের “ক্লান্তি” কবিতায় রেখে গেছেন এক অমর কৃর্তি —
“আমার হৃদয় স্তব্ধ, বোবা হ’য়ে আছে বেদনায়,
যেমন পদ্মের কুঁড়ি নিরুত্তর থাকে হিমরাতে,
যেমন নিঃসঙ্গ পাখী একা আর ফেরেনা বাসাতে;
তেমনি আমার মন মুক্তি আর খোঁজেনা কথায়।”
তিনি দৃঢ়ভাবে ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং গভীর নিষ্ঠার সাথে তাঁর জীবনে ও প্রতিটি শিল্পকর্মে এর প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মুসলিম ভাবধারায় তিনি তার বিশাল সৃষ্টিকর্ম শুধুমাত্র মানুষের ভালোবাসায় বিলিয়ে দিয়েছেন। আর সে কারনেই তিনি মুসলিম নবজাগরণের নকীব ও মানবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রবক্তা। কিন্তু তার সৃষ্টিকর্মে সরাসরি ইসলামের কথা আসেনি। রূপকল্প, প্রতীক, ভাবধারায় এসেছে মানবমুক্তির অন্যতম পথ।তার প্রতিটি কাব্যের বিচিত্র রূপরীতি, নিজস্ব ভাব-বিষয়, রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্পের অভিনব ব্যবহার, শিল্প-নৈপুণ্য, ও নিজস্ব কাব্য-ভাষা নির্মাণের মধ্য দিয়েই তিনি আজ মুসলিম নবজাগরণের কবি, ইসলামী রেনেসাঁর কবি, মানবতাবাদী কবি হিসেবে আমাদের নিকট প্রিয়মুখ।
“সিন্দবাদ” কবিতায় রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপ­কল্পের ব্যবহার —
কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ায় ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ।
আমি শেষে একটি কথাই বলবো,
কবি ফররুখ আহমেদ ছিলেন দুর্ভিক্ষের খরায় শক্ত ফাঁটা মাটিতে জম্মানো এক বটবৃক্ষ, যার ছায়াতলে সর্ব শ্রেণীর মানুষ আশ্রয় নেয়। কিন্তু দুর্ভিক্ষ কেটে গেলে এক শ্রেণীর লোক সেই হিতকর বটবৃক্ষ কেটে ফেলে। এ ঋণ আমাদেরই শোধ করতে হবে।

ফারজানা জান্নাত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

221 Views

আরও পড়ুন

টেকনাফে মাদক মামলার সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম মতলিবের ইন্তিকাল
ইসলামী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল বাতিঘরের চিরপ্রস্থান

রোজার সময় তুষার আমাকে আপত্তিকর কথাটি বলে: নীলা ইসরাফিল

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টে একমত রাজনৈতিক দলগুলো

ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি : ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লো উত্তর কোরিয়া

জাতি হিসেবে আমরা অত্যন্ত বেহায়া এবং নির্লজ্জ: শবনম ফারিয়া

ইসলামের রাষ্ট্রীয় ভিত্তি গড়ে ওঠা পবিত্র শহর

২০২৬ সালের হজের রোডম্যাপ ঘোষণা করল সৌদি আরব

নাফনদীতে জেলের ছদ্মবেশে মাদক পাচারকালে১লাখ২০হাজার ইয়াবাসহ দুই মিয়ানমার নাগরিক আটক

সন্ধান মিলছে না মাদ্রাসা শিক্ষার্থী লাবিবের

বরকলে বাহাদুর খাঁন চৌধুরী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ইছালে ছাওয়াব মাহফিল

মৌলভীবাজার জামায়াতের সাবেক আমীরের ইন্তিকালে ডা. শফিকুর রহমানের শোকবার্তা