———-
আত্মসমালোচনা হলো নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা। ইংরেজিতে একে self-criticism বা self-accountability বলা হয়।
আত্মসমালোচনা বলতে বুঝায় সচেতনভাবে কোন কাজ সম্পন্ন করা বা পরিত্যাগ করা। যাতে কৃতকর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। আত্মসমালোচনা শুধু ব্যাক্তি নিজেকে নিয়ে সমালোচনা করবে এমনটিও নয়। বরঞ্চ নিজের পরিবার, সমাজ এবং স্বজাতি কিংবা স্বদেশ নিয়েও হতে পারে আত্মসমালোচনা।
ময়লাযুক্ত চেহারার কোন মানুষ যদি আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, লোকটির চেহারার কোন পাশে কোন দাঁগ কেমন দেখাচ্ছে তা ফুটিয়ে তুলে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আত্মসমালোচনাও দর্পনের মত ব্যক্তির ভুলভ্রান্তিগুলোকে ফুটিয়ে তুলে এবং নিজেকে সুধরানোর সিদ্ধান্ত তৈরি করে দেয়।
এই বিশ্বেলোকে কোন মানুষই ত্রুটিবিচ্যুতির উর্দ্ধে নয়। যেহেতু অনেকগুলো মানুষের সামষ্টিক পরিচয় বহন করে ‘জাতি’ শব্দটি দ্বারা, সেহেতু কোন জাতিও দোষত্রুটির উর্দ্ধে হতে পারেনা। ভুল কিংবা অপরাধ করলে কোন জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি হয়ে যায় না। বিরাট ক্ষতি তখনই হয়- যখন অপরাধকে অপরাধ মনে না করে একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর সেই অপরাধ পুনরাবৃত্তি ঘটার পেছনে আত্মসমালোচনার অভাবই হলো মুখ্য কারণ। বিশেষত- জাতির নেতৃস্থানীয়দের থেকে অপরাধের সূচনা হয় যখন ঠিক তখনই জাতির উন্নয়ন পরিকল্পনায় ধস নেমে আসে। এতেকরে, সাধারণ জনগণের সবচেয়ে কঠিন ভোগান্তির মধ্যে থাকতে হয় এবং স্বজাতীয় সম্পদের উন্নতির চেয়েও অধঃপতিত হয় বেশি।
জাতীয় সমস্যার সবচেয়ে নিদারুণ সমালোনা করতে পারেন উক্ত জাতির লেখক ও সাহিত্যিকবর্গ। লেখকগণ লেখনীশিল্পলের মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাসহ শাসকশ্রেনীকে সংশোধন-বার্তা স্ফুলিঙ্গের মত পরিষ্কার করে দিতে পারেন। অন্যদিকে শাসকশ্রেণী যদি সমালোচনা সহিষ্ণু হয় তাতে জাতির ভাগ্যসুপ্রন্নতা নিশ্চিত। অন্যথায়, শাসকশ্রেণী যদি সমালোচনা-সহিষ্ণু না হয় তখন স্বজাতীর অনাগত ভবিষ্যত হুমকির মুখে দাঁড়ায় এবং জাতীয় অধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। প্রতিনিয়ত ব্যক্তি স্বাধীনতাও খর্ব হতে থাকে। জাতি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর খুব নামডাক যদিও আমরা করি- তবে এটি সত্য যে, তাদের দেশের শাসকবর্গ কেমন তা জানার চেষ্টা খুব কমই করে থাকি। সেই দেশগুলোর শাসকশ্রেণী রীতিমত অত্যন্ত সমালোনা-সহিষ্ণু। সমালোচনার মুখেমুখি হয়ে সরকার প্রধানও ক্ষমতা থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিয়েছে এরকম নজির অসংখ্য। লেখকবর্গেরও অবাধ স্বাধীনতা আছে স্বজাতীয় সমস্যাগুলো সকলের কাছে বার্তা হিসেবে পৌঁছে দেয়ার। জাতীর আত্মসমালোচনা করে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী! রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করো নি’ তিনি বাঙালীদের কোন অশুভ দিকটি ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন তা আমার প্রাসঙ্গিক বিষয় নয়। প্রসঙ্গত বিষয় হলো- তিনিও আত্মসমালোনা করেছের নিজের জাতিকে সুধরানোর উদ্দেশ্যে। যা থেকে বাঙ্গালী এখনো শিক্ষা গহণ করে নিজেদের সুধরাতে পারবে।
১৮ই জানুয়ারী ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর আত্মসমালোচনা সম্পর্কিত অমিয় বাণীটি সম্প্রতিকালের বাঙ্গালীদের আমলে আনা উচিত। দেশ ও স্বজাতির উন্নতির লক্ষ্যে তিনি সেদিন বলেছিলেন ”দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া-কথায় চলেনা দেশ। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাদের বলেছিলাম আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চেনতে পারবে না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবে” স্বাধীনতার মহান স্থপতির এই বাণীর মর্মার্থ হলো- আত্মসমালোচনার মাধ্যমে আত্মপরিচয় আবিষ্কার করা যায়। নিজেকে চেনার ফলে দেশ ও স্বজাতিকে নির্মাণ করা যাবে।
নিজের দোষের বিষয়ে কোন জাতি যতদিন অন্ধ থাকবে ততদিন পর্যন্ত সুগুণের আলো পলাতক থাকবে।
সুতরাং- আত্মসমালোনা দেশ বা জাতির জন্যে বয়ে আনতে পারে উন্নতির সোনালি পায়রা।
শিক্ষার্থীঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।