রফিকুল ইসলাম জসিম
মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল) জনগোষ্ঠীর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতি ও জ্ঞানভিত্তিক উদ্যোগ হিসেবে মাতৃভাষায় কুরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করতে প্রকাশিত হয়েছে “তাযকিরুল কুরআন”। এটি মণিপুরি ভাষায় প্রথম ধারাবাহিক, সহজবোধ্য ও আধুনিক কুরআন তাফসির। সম্প্রতি এর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে, এবং তৃতীয় ও শেষ খণ্ড প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে।
এই গ্রন্থে কুরআনের অনুবাদের পাশাপাশি রয়েছে আধ্যাত্মিক, ফিকহি ও প্রাসঙ্গিক দিকসমূহের সংক্ষিপ্ত ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা। এটি রচিত হয়েছে মণিপুরি ভাষায় (মৈতৈলোন, বাংলা লিপিতে), যাতে করে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা আরও সহজ ও প্রবেশযোগ্য হয়।
দীর্ঘদিন ধরে পাঙাল সমাজে বাংলা, উর্দু ও আরবি ভাষায় কুরআন তাফসির পাঠের প্রচলন থাকলেও, মাতৃভাষায় তাফসির না থাকায় সাধারণ মানুষ তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারছিলেন না। “তাযকিরুল কুরআন” সে অভাব পূরণের একটি সাহসী ও সময়োপযোগী প্রয়াস। এটি কেবল অনুবাদনির্ভর নয়; বরং আয়াতভিত্তিক সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠকের চিন্তা, চেতনা ও ধর্মীয় অনুভূতিকে জাগ্রত করতে সহায়ক।
প্রতিটি সূরার শুরুতে রয়েছে “পরিচিতি” অংশ, যেখানে সূরাটির সারসংক্ষেপ, নামকরণের প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিক ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে আয়াতসমূহের মণিপুরি অনুবাদ এবং সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রকাশিত খণ্ডসমূহ:
প্রথম খণ্ড: সূরা আল-ফাতিহা থেকে সূরা আত-তাওবা পর্যন্ত দ্বিতীয় খণ্ড: সূরা ইউনুস থেকে সূরা আল-আনকাবূত পর্যন্ত তৃতীয় খণ্ড (প্রকাশের অপেক্ষায়): সূরা আর-রূম থেকে সূরা আন-নাস পর্যন্ত।
তাফসিরে ব্যবহৃত ভাষা অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সাবলীল ও হৃদয়গ্রাহী। আয়াতের ব্যাখ্যায় যথাযথ ফিকহি ও আকীদাগত দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এটি শুধু ধর্মীয় ব্যাখ্যাগ্রন্থ নয়, বরং একটি চিন্তাশীল ও দাওয়াতি প্রয়াস হিসেবেও বিবেচিত।
এই তাফসির রচনায় একক কোনো ব্যক্তির অবদান নয়; বরং “আলিমশিংগী জামাআত আমা” নামক একদল অভিজ্ঞ আলেম, গবেষক ও ভাষাবিদের দলবদ্ধ প্রচেষ্টায় এটি প্রণীত হয়েছে।
প্রকাশক: শুভবহ নমার র ইশাঅং
প্রকাশনা সংস্থা: দারুল উলূম (মারকাজ), মণিপুর
ধরণ: কুরআন তাফসির, ধর্মীয় ব্যাখ্যামূলক
গ্রন্থভাষা: মণিপুরি (বাংলা লিপিতে)
জামাআতভিত্তিক উদ্যোগ হিসেবে এই তাফসিরে পরিলক্ষিত হয় পরিশীলিততা, ভারসাম্য ও সুসংগত ব্যাখ্যা—যা মণিপুরের বিভিন্ন স্তরের পাঠকের কাছে সহজবোধ্য ও গ্রহণযোগ্য।
মণিপুরি ভাষায় ইসলামি সাহিত্য বরাবরই অপ্রতুল। এই প্রেক্ষাপটে “তাযকিরুল কুরআন” কেবল একটি ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, বরং একটি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের কণ্ঠস্বর। ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এটি পাঙাল মুসলিম সমাজে আত্মিক জাগরণের বাতিঘর হয়ে উঠতে পারে।
গ্রন্থটির কভার ডিজাইন, ছাপার মান ও বাঁধাই অত্যন্ত উন্নত। পরিষ্কার হরফ, ছকবদ্ধ বিন্যাস ও আরামদায়ক পাঠযোগ্যতা পাঠকের দৃষ্টি ও মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম।
ইতোমধ্যে এই বই মণিপুরের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম, ইসলামি শিক্ষার্থী ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। শুধু মণিপুর নয়—বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ও আসামের মণিপুরি ভাষাভাষী মুসলমানদের মধ্যেও বইটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
“তাযকিরুল কুরআন” কেবল একটি তাফসিরগ্রন্থ নয়—এটি একটি নবযাত্রার নাম। মাতৃভাষার মাধ্যমে কুরআন বোঝা এবং সমাজে তার শিক্ষা বাস্তবায়নের আহ্বান এতে প্রতিফলিত হয়েছে। এই তাফসির যেন ঘরে ঘরে পৌঁছায় এবং হৃদয়ে জায়গা করে নেয়—সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।