
কুবি প্রতিনিধি:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) বাংলা বিভাগের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী ‘বাংলা নাটকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য প্রভাব ও জন্মশতবর্ষে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। বুধবার (২৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সম্মেলন কক্ষে এই সম্মেলনের উদ্বোধন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শামসুজ্জামান মিলকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাসুদা কামাল এবং কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. বনানী বিশ্বাস উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আজম, ভারতের যাবদপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সেলিম বক্স মন্ডল। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী ও শহীদ মুনীর চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তান আসিফ মুনীরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সম্মেলনের প্রথমদিন দুইটি অধিবেশনে মোট ৬৭ প্রবন্ধ পাঠ করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় দিনে ১০ টি প্রবন্ধ পাঠ করা হবে।
সংস্কৃতিকর্মী ও শহীদ মুনীর চৌধুরীর কনিষ্ঠ সন্তান আসিফ মুনীর বলেন, 'আমার জানামতে মুনীর চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে সবচেয়ে বড় আয়োজন এটি। মুনীর চৌধুরী শুধু নাট্যকার নয়, তিনি নাটকের বাহিরে আরও কাজ করেছেন, যেগুলো বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের এখন এমন অবস্থা হয়েছে মুনীর চৌধুরী মানে মনে করি শুধু 'কবর' নাটক। কবর ছাড়াও তার আরও নাটক আছে, ছোটগল্প আছে সেগুলো সম্পর্কে মানুষ তেমন অবগত না। আমরা বুদ্ধিজীবীদেরকে যেভাবে স্মরণ করি তেমনভাবে তাদের কাজগুলোও সামনে নিয়ে আসা দরকার। আমি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর একটি আয়োজনের মাধ্যমে মুনীর চৌধুরীকে স্মরণ করার জন্য। মুনীর চৌধুরীসহ আরো যারা বুদ্ধিজীবী আছে তাদেরকে এবং তাদের সৃষ্ঠিকর্মগুলো আমাদেরকে ধারণ করতে হবে।'
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড.মোহাম্মদ আজম বলেন, 'নাটকে পাশ্চাত্য প্রভাব বললে আপনার দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না, আপনার দায়িত্ব আরো বাড়ছে, বাড়ছে আবিষ্কার করার দায়িত্ব কিভাবে নাট্যাঙ্গনে আমাদের মর্ডানিটি পাশ্চাত্যের প্রভাবকে অঙ্গীকৃত করে রূপান্তরিত করেছে। আমাদের এই নাট্যঙ্গনে পাচ্য এবং প্রাশ্চাত্য প্রভাব চরম ভাবে ধরা দিয়েছিল সেমি মাউন্টেনের সময়ে। একই সময়ে উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই কাজটা করেছিলেন দেবেশ রায়।
তিনি আরও বলেন, 'মুনীর চৌধুরী আসলে আধুনিক নাট্যধারার মধ্যে থাকতে চেয়েছেন, তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার আধুনিকায়নের বিশিষ্ট অভিব্যক্তি। তার পশ্চিমা নাটকের ব্যাপারে আগ্রহ ঐ কালে যতটুকু থাকার কথা ততটুকুই ছিল। এই ব্যাপারটাকে তিনি বিশেষভাবে সন্দেহের চোখে দেখেননি। ঐখানে আমরা দেখব তিনি কিভাবে একটা উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব করছেন, কিভাবে একটি যোদ্ধাবিরোধী চেতনা ফুটিয়ে তুলছিলেন।'
উপ-উপাচার্য ড. মাসুদা কামাল বলেন, 'নাটক শুধু বিনোদন নয় এতে সমাজের দর্শন, মানুষের অনুভূতি ও অন্তর্জগতের ভাষা প্রকাশ পায়। বাংলা নাটকের বিকাশে প্রাচ্যের ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্যের আধুনিকতা- এই দুই ধারার সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। লোকসংস্কৃতি, মঙ্গলকাব্য, যাত্রা ও পালাগান বাংলা নাটকের মূল শক্তি। আর পাশ্চাত্য প্রভাব এনেছে নতুন কাঠামো, আধুনিক মঞ্চায়ন ও নান্দনিক বৈচিত্র্য।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলা নাটকে মুনীর চৌধুরী এক উজ্জ্বল নাম। তিনি ছিলেন ভাষা সৈনিক, সমাজচেতনার প্রবক্তা এবং আধুনিক নাট্যধারার পথিকৃৎ। তাঁর ‘কবর’ নাটক প্রতীকী নাটকের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি, তিনি নাট্যচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে শহীদ হয়ে তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অনন্য প্রতীক হয়ে আছেন।'
উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী বলেন, 'বর্তমান যুগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক কিছুই নকল করতে পারে। সঠিকভাবে নির্দেশনা দিলে সৃজনশীল প্রবন্ধ বা নাটকও লিখে দিতে পারে। তবে এই টুলসগুলো সবসময় ভালো মানুষের হাতে থাকে না; খারাপ কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছুই এক ধরনের ভঙ্গুরতার মধ্যে রয়েছে। তোমরা যারা ভবিষ্যতে শিক্ষক হবে, তাদের সামনে রয়েছে বড় চ্যালেঞ্জ। আর তোমরা তরুণরা যারা সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবো তাদের ভাবনার জন্যও রয়েছে বহু ক্ষেত্র। আমি আশা করি, তোমাদের প্রবন্ধ ও নাটকের মাধ্যমে সমাজের রীতিনীতি, পরিবর্তন এবং বাস্তবতা ফুটে উঠবে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। পরিশেষে, আমি এই দুই দিনব্যাপী কনফারেন্সের সফলতা কামনা করছি।'
সম্মেলনের সভাপতি ও বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শামসুজ্জামান মিলকী বলেন, 'আজকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ যারা উপস্থিত হয়েছেন তারা আজকে আমাদের কনফারেন্সে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। সকলের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের সবার এক মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজকের অনুষ্ঠানটি সফলভাবে হচ্ছে। দুইদিনের এই কনফারেন্সে মোট ৭৭টি প্রবন্ধ উপস্থাপিত হবে। একটি বিভাগের আয়োজন হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।'
সম্পাদক ও প্রকাশক: রফিকুল ইসলাম
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা-১৩১০