ঢাকারবিবার , ২৪ নভেম্বর ২০২৪
  1. সর্বশেষ

সেই ঈদ এই ঈদ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি!

প্রতিবেদক
নিউজ ডেস্ক
১১ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪১ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

“প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ উৎসব আছে, আর আমাদের আনন্দ উৎসব হলো দুই ঈদ” (আবু দাউদ- ১১৩৪; নাসায়ী- ১৫৫৬)। বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর এমন ঘোষণার মাধ্যমেই দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদ উৎসবের গোড়াপত্তন হয়। সেই ঈদ এখন বিশ্বের সবচেয়ে শুদ্ধতম আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। প্রতি বছর দুই বার এই আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে গোটা মুসলিম বিশ্ব। ঈদুল ফিতর পালন করা হয় শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে। পবিত্র রমযান মাসের পরিসমাপ্তির পর পশ্চিম আকাশে যখন ঈদের বাঁকা চাঁদ ভেসে ওঠে তখন ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মুসলিমদের হৃদয়ে ঈদের আনন্দ দোলা দেয়। এ যেন নতুন কিছু প্রাপ্তির মহা আনন্দ। প্রকৃতপক্ষে রমজানের কঠোর সাধনা, ইবাদত-বন্দেগী ও রোজার প্রতিদান স্বরূপ মহা পুরস্কার ঘোষণার দিন হচ্ছে এ আনন্দময় দিন। আর জিলহজ্ব মাসের দশ তারিখে পালিত হয় ঈদুল আযহা।

মহান আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অসংখ্যবার পরীক্ষা করেছিলেন। একবার তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানী করার জন্য স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হন। তিনি যখন ইসমাইল (আ.) কে কুরবানী করছিলেন তখন ফেরেশতা মারফত তাকে সরিয়ে দুম্বা কুরবানী করানো হয়। সেই স্মৃতিকে ধারণ করে এ দিনে ঈদুল আযহা তথা কুরবানীর ঈদ পালন করা হয়।

ইসলামে দুই ঈদের গুরুত্ব ও মর্যাদা সমান। তবে ঈদ শব্দটি উচ্চারণ করার সাথে সাথেই আমাদের মানসপটে যে ঈদের চিত্র ভেসে ওঠে তা ঈদুল আযহার নয়, ঈদুল ফিতর তথা রোজার ঈদের। কারণ, ঈদুল ফিতর অনেক দিন পর আসে এবং এটি শুধু একটি দিনের ঈদ নয়, যেন পুরো এক মাসের ঈদ। আর ঈদ শব্দটি কখনো একা আসে না, সাথে নিয়ে আসে স্মৃতির ‘সমুদ্দুর’। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় হৈ-হুল্লোড় করে চাঁদ দেখা, ঈদের দিন ফজরের নামাযের পর সবাই মিলে ঈদগাহ সাজানো, ফুল টানানো, রং লাগানো, পুকুরে গিয়ে হল্লা করে গোসল, নতুন জামা কাপড় পরে, আতর মেখে ঈদগাহে নামায, নামায শেষে কোলাকুলির হিড়িক, কবর জিয়ারত, বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাওয়া-দাওয়া, বিকাল হলে মা-বাবার সাথে নানা বাড়ি যাওয়া, আরো কত কী। এরকম স্মৃতির কোন শেষ নেই।

প্রত্যেকের জীবনের প্রত্যেক ঈদই যেন স্মৃতির নক্ষত্র খচিত আকাশ। ১৪৩৬ বছর আগে তখন আরবের মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিচ্ছিলেন বিশ্বমানবতার দিশারি, মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স.)। এক পর্যায়ে মক্কার কুরাইশরা বুঝতে পারলো যে, এটা বিশ্বমানবতার জন্য কল্যাণকর হলেও তাদের কর্তৃত্ব বা রাজত্বের জন্য হুমকি। ফলে তারা ইসলামের অনুসারীদের উপর শুরু করলো অসহ্য নির্যাতন। নির্যাতনের মাত্রা দিনকে দিন বাড়তে থাকলো। জীবন ধারণ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো রাসুল (স.) ও সাহাবায়ে আজমাইন (রা.)-দের।

অগত্যা সিদ্ধান্ত হলো- হিজরতের। জমি-জমা, ধন-সম্পদ, ঘর-বাড়ি সব ছেড়ে পাড়ি জমালেন মদীনায়। অন্যের জমিতে বসবাস করতে থাকলেন সবাই। জাগতিকভাবে বলা যায় কষ্টেই ছিলেন তাঁরা। সুখ-শান্তি-আনন্দ ছিল তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মদীনাবাসীরা তখন শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মিহিরজান নামে দু’টি উৎসব পালন করতো। উৎসব দু’টি প্রথমে ৬ দিনব্যাপী এবং পরবর্তীতে ৩০ দিনব্যাপী পালন করা হতো। নওরোজ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব। মিহিরজান ছিল পারসিকদের অনুকরণে আনন্দ উৎসব। জাহেলি ভাবধারা, স্বভাব, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যানুযায়ী এ দু’টি উৎসব উদযাপিত হতো।

অশালীন আনন্দ-উল্লাস, কুরুচিপূর্ণ রঙ-তামাসা ও হৈ-হুল্লোড় হতো এসব অনুষ্ঠানে। সমাজের বিত্তশালীরা নানা ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে এ উৎসব পালন করতো। নারী-পুরুষের অবাধ মিলনকেন্দ্র ছিল এসব উৎসব। রাসূলুল্লাহ (স.) এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখে দারুণভাবে ব্যথিত হন এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মদীনাবাসীদেরকে এসব অশালীন অন্তঃসারশূন্য ও লক্ষ্যহীন উৎসব পালন করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানান। এর পরিবর্তে তিনি স্বমহিমা ও নির্মল আনন্দে ভাস্বর পবিত্র স্পর্শমন্ডিত বহুবিধ কল্যাণধর্মী ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামে দু’টি উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দেন। সেদিন থেকে জাহিলিয়াতপূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী নওরোজ ও মিহিরজান উৎসব চিরতরে বন্ধ করা হয় এবং তদস্থলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা উৎসবের প্রচলন করা হয়।

এ সম্পর্কে হাদীস শরীফের ভাষ্য হলো, আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী করীম (স.) যখন মদীনায় উপস্থিত হলেন, তখন তিনি দেখতে পেলেন মদীনাবাসীরা (যাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক লোক পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছেন) দু’টি জাতীয় উৎসব পালন করছে। আর তারা খেল-তামাসার আনন্দ-অনুষ্ঠান করছে। নবী করীম (স.) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এই যে দু’টি দিন উৎসব পালন কর, এর মৌলিকত্ব ও তাৎপর্য কি? তারা প্রতি উত্তরে বললো, ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ উৎসব এমনি হাসি-খেলা ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমেই উদযাপন করতাম, এখন পর্যন্ত তাই চলে আসছে। এ কথা শুনে নবী করীম (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এ দু’টি উৎসবের দিনের পরিবর্তে তদপেক্ষা অধিক উত্তম দু’টি দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা দান করেছেন। অতএব পূর্বের উৎসব বন্ধ করে এ দু’টি দিনের নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানাদি পালন করতে শুরু কর।” (আবু দাউদ- ১১৩৪; নাসায়ী- ১৫৫৬)

নওরোজ-মিহিরজান আর আমাদের দুই ঈদের মধ্যে মূল যে পার্থক্য তা হলো- ওদের অনুষ্ঠান দু’টি ছিল অশ্লীলতায় ভরপুর আর ধনিক শ্রেণির জন্য পালনীয়। অপর দিকে আমাদের ঈদ হলো অশ্লীলতামুক্ত এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান মুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, পৃথিবীর আর কোন ধর্মে কিংবা জাতি-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উৎসবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকে এমন গুরুত্ব দেয়া হয় নাই।

অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবে অপেক্ষাকৃত ধনিক ও বণিক শ্রেণির মানুষের মনোরঞ্জনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। আর এই সব সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিত্তশালীরা আরও বিত্তবান হয়। গরীবেরা হয় আরও গরীব। গরীবেরা ধনীদের মনোরঞ্জন আর পুঁজি পুঞ্জায়নের ক্ষেত্রে সহায়ক মাত্র।

অথচ ঈদ উৎসব গরীবদের সাথে নিয়ে পালন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঈদুল ফিতরের নামাযের পূর্বেই তাদের পাওনা তথা ফিতরা আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর ঈদুল আযহায় তাদেরকে কুরবানীর গোশত দেয়া হয় ধনীদের পক্ষ থেকে। বলা যায়- ঝর্ণা যেমন পাহাড়ের উচ্চতা থেকে নেমে অপেক্ষাকৃত নিচু ও সমতল ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে; ঠিক তেমনি ঈদের মাধ্যমে বিত্তবানদের নিকট থেকে অর্থসম্পদ গরীব মিসকিনদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রশমিত হয় ও ক্রমান্বয়ে দূরীভূত হয়। যার প্রদর্শন আমরা দেখেছি খোলাফায়ে রাশেদার ৩২ বছরের শাসনামলে। সেখানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, যাকাত নেয়ার মত উপযুক্ত কোন গরীব মিসকিনকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এ হলো ইসলামী সংস্কৃতির সোনালী ইতিহাস।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, রাসূল (স.) -এর সেই অশ্লীলতামুক্ত ও ধনী-দরিদ্রের সেতুবন্ধনের ঈদ কি আমাদের সমাজে আছে? বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী তাঁর ‘অভিঘাতের মুখে ঈদ সংস্কৃতি : চাই নবজাগরণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে আমাদের দেশে ঈদের নামে প্রচলিত অপসংস্কৃতির এক সুনিপুণ চিত্র এঁকেছেন সুন্দরভাবে। তিনি লিখেছেন,

“এখন শোনা যাচ্ছে ঈদের নাটক, ঈদের নাচ, ঈদের গান, ঈদের কনসার্ট, ঈদের ফ্যাশন শো, ঈদের রেসিপি, ইত্যাকার বিচিত্র সব বিষয়ের কথা। ঈদের সাথে এসবের আদৌও কোন যোগসূত্র নেই। তবুও ঈদ উপলক্ষে এসব হাজির হয় কোটি দর্শকের সামনে। ঈদকে তার আপন মহিমা থেকে হটিয়ে ভিন্নতর এক মাত্রায় উপস্থাপন করা হয়। বিশেষভাবে নবীণ প্রজন্মের সামনে ঈদকে একটা হৈ-হুল্লোড়, রং-তামাশা, গান-বাজনা, গলাগলি, ঢলাঢলির উপলক্ষ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত কতক উৎছিষ্টভোগী মিডিয়া। তাদের বিবেচনায় ‘ঈদ মানে জোছনা রাতে হাসনাহেনার গন্ধে’ ফষ্টিনষ্টি করার মাহেন্দ্র সুযোগ।”

ঈদ যে রমজানের শিক্ষা- সংযম, ত্যাগ ও তৌহিদী চেতনার পরিসীমার মধ্যে সম্পাদ্য একটি ধর্মীয় আচার ও ইবাদতের অংশ তা ভুলিয়ে দিয়ে নবীণ প্রজন্মকে ভিন্নদিকে ধাবিত করানো হচ্ছে। ঈদ দীর্ঘ রমযানের শেষে, রোজা-ইফতার-ইতেকাফ বিশেষ ইবাদত বন্দেগীর সমাপ্তিতে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও আগামী এগারো মাস রমজানের ধারাবাহিকতায় চলার অঙ্গীকার শাণিত করার দিন, তা ভুলিয়ে দেয়া হয় ঢোল-তবলা-বাঁশী বাজিয়ে, নাচে-গানে মাতোয়ারা করে।

শাওয়ালের চাঁদ-ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রমযানের মর্মবাণী ত্যাগের শিক্ষা, সংযম, শ্লীলতা প্রভৃতিকে ঝেড়ে ফেলে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল যেন গাঝাড়া দিয়ে ওঠে। চটুল আমোদ-প্রমোদের নানা পসরা সাজিয়ে বসে। অনুষ্ঠান ঘোষিকা, উপস্থাপিকারা মুহূর্তে ঘোমটা ফেলে স্বরূপে নড়ে চড়ে ওঠে। অবিলম্বে নাটকের নামে, নাচ-গানের মাধ্যমে রমযানকে অস্বীকার করার, তার শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য এরা সকলে যেন কোমর বেঁধে নেমে পড়ে।

বিজ্ঞাপনদাতা সংস্কৃতিকর্মীরাও যেন চাঁদ উঠবার ঘোষণার মুহূর্তটির অপেক্ষাতেই থাকে। ঘোষণার পর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে দৃশ্যপটে। ত্রিশ দিনের সংযম-শ্লীলতার বাঁধ যেন সহসা ভেঙ্গে পড়ে, কত দ্রুত রমযানের বার্তাকে পরিহার করা যায়, তারই প্রতিযোগিতা বুঝি শুরু হয়। লাখো ডলার পাউন্ডের বস্তা নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানীর লোকেরা দু’পায়ে খাড়া। দেশীয় কর্পোরেট হাউজগুলোও কম যায় না। মেয়েদের চুল চামড়া মনমত মেরামত করার, আরো কামাদ্র করে তোলার পসরা নিয়ে ওদের লালিত মডেল কন্যারা কলকলিয়ে ওঠে। উদ্বাহু হয়ে এগিয়ে আসে নায়িকা গায়িকা শিল্পী সেলিব্রেটিরা। চ্যানেলে চ্যানেলে ভাঁড়ামি নষ্টামি, প্রেমপীরিতি নিয়ে চলে মাতামাতি। রাজ্যের সব কথা-বার্তা, গান-বাজনা, রং-তামাশা চলতে থাকে নিশিদিন।

শুধু বলা হয় না ইসলামের কথা, ইসলামী মূল্যবোধের কথা। ইসলামের শিক্ষা সংস্কৃতির বিষয়ে হয়না কোন আলোচনা। রমযানের প্রাপ্তি বা ত্রুটি বিচ্যুতির বিষয়ে কোন কথার্বাতা কেউ বলেনা। ইসলামের নবী-রাসূল, ওলি-আউলিয়াগণের প্রসঙ্গ কখনো তোলা হয় না। মুসলমানদের অতীতের গৌরব গাঁথা, মুসলিম চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, বীর মুজাহিদ, মহাকবি, ধর্মতাত্ত্বিকদের ধ্যান, জ্ঞান, কর্ম, বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প সাধনার কথা, জয়-পরাজয়ের ইতিবৃত্ত কোথাও উচ্চারিত হয় না। সাম্প্রতিককালে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের উপর চলমান হামলা ও ষড়যন্ত্রের কথা উচ্চারিত হয় না।

অথচ হাস্যকরভাবে ‘ঈদের ৭ম দিন’ বলেও প্রোগ্রাম দেখানো হয়। তাতে কাতুকুতু দিয়ে মানুষকে জোর করে হাসানোর কারসাজি চলে। ঈদের দোহাই দিয়ে অভিনব নর্তনকুর্দন, মেটালিক, মিউজিক, আজগুবি নাটক এবং নট-নটিনিদের বেলেল্লাপনার উন্মাদনায় মুহূর্তে রমযান ও ঈদ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ঈদের পূতপরিমার্জিত সাংস্কৃতিক প্যাটার্নের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সব বিষয় হাজির করে সাধারণ মানুষকে নানা উৎকট অশ্লীল ধাঁধাঁর মধ্যে ফেলা হয়।

এক কথায় আয়োজনটা ঈদের নামে কিন্তু ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি সাধনা ও ইতিহাসের কোন কিছুই এর কোন উপজীব্য হয়ে ওঠে না। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এটা প্রতিপন্ন করার সূক্ষ্ম চেষ্টা চলছে যে, এসব রঙ্গতামাশা নাটক থিয়েটার নাচানাচি হচ্ছে ঈদের সংস্কৃতি, ঈদের অনুষঙ্গ। একশ্রেণির সংবাদপত্রও কম যায় না। ঈদের আগে থেকেই ঈদের নামে বিজ্ঞাপন বাণিজ্যের বিপুল ফায়দা তোলে এরা। এরা সপ্তাহে সপ্তাহে বের করে রঙিন ক্রোড়পত্র। তাতে ডবগা মডেল মেয়েদের নানা ঢংয়ের উগ্র ছবি ছাপা হয়। শাড়ি, চুড়ি, রঙ্গিন চশমা লেহেঙ্গা আর বেহায়াপনার মহড়া দেওয়া হয় ঈদকে সামনে রেখে। আর শেষত কেউ কেউ বের করে কথিত ঢাউস ‘ঈদ সংখ্যা’। এরা ‘ঈদ সংখ্যা’ নামে যা ছাপে তাতে ঈদ বা ইসলামের কোন রেশ খুঁজে পাওয়া যায়না। বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া ঈদের কোন আলোচনা, ইসলামের মহিমা, সাধনা, শিক্ষা ও দর্শনের কোন বিবরণ বর্ণনা এসব ঈদ সংখ্যায় থাকে না। আমাদের নতুন প্রজন্মের মগজে এহেন কলমি আবর্জনা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে ঈদের নামে; ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে ঈদের মহিমা মহত্বকে।”

ঈদ নিয়ে বা ঈদের আনন্দ-ঊৎসব নিয়ে কথার তো শেষ নেই। তবে বাঙালি মুসলিমরা একটু বেশী মাতামাতি করে, অন্যদেশের মুসলিমরা এতো হইচই করে না। কিন্তু কেন? এর হয়তো অনেক ব্যাখ্যা আছে। সব ব্যাখ্যা বা সব জবাব হয়তো আমাদের জানা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু আমাদের জানা দরকার যে, ঐতিহাসিক ও মানসিক কারণে বাঙালি মুসলিমরা ঈদকে বরাবর জাতীয় উৎসব এবং সার্বজনীন উৎসব হিসাবে পালন করে আসছে। কেউ উদ্যোগ নিয়ে ঈদকে জাতীয় বা সার্বজনীন বানায়নি। এটা হয়েছে সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

আমরা সবাই জানি, হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা মুসলিম ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন নানা ধর্মের অনুসারী। বিশেষ করে পৌত্তলিক বা সনাতন ধর্মের অনুসারী। সনাতন ধর্মে পালা-পার্বণের অন্ত ছিল না। বলা হয়ে থাকে- বারো মাসে তের পার্বণ। এখন অবশ্য সনাতন ধর্মে আগের মতো সে অবস্থাটি নেই। তবুও কম নেই। অবস্থাটা এমন যে, আনন্দ উৎসবের নামই যেন সনাতন ধর্ম। সে ধর্ম থেকে আমাদের সাহসী ও বীর পুরুষেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যাদের রক্তে ও মজ্জায় ছিল আনন্দ উৎসব, তারা তা ছাড়া বাঁচে কী করে? ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও আনন্দ উৎসবকে আমাদের পূর্বপুরুষরা পরিত্যাগ করতে পারেননি। ফলে তারা শুক্রবার, মহররম, রমযান, শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা থেকে শুরু করে ঈদে মিলাদুন্নবী, আখেরী চাহার শোম্বা, উরস, মিলাদ, এগার শরীফ, জলসা, খতনা, চল্লিশা ইত্যাদি ডজন-ডজন উৎসব মুসলিমরা নিজেদের জন্য বানিয়ে নিয়েছে। ধর্মের সাথে স্থানীয় রসম-রেওয়াজ এবং জীবনাচারকে তারা একাকার করে ফেলেছে। ইসলাম স্থানীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে কখনো বাতিল করেনি। যা শুভ, কল্যাণ ও মঙ্গলময়, ইসলাম সেসবকে আদর ও সোহাগ ভরে ধারণ করেছে। ইসলাম শুধু দেখেছে, বিষয়টি আল্লাহর একত্বের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা এবং ধর্মে নতুন কোন প্রথা প্রচলন করা হচ্ছে কিনা। এসব না থাকলে এবং বিজাতীয় অশ্লীল, নোংরা ও কুৎসিত বিষয় না থাকলে ইসলাম মানুষের স্বচ্ছ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক প্রবণতার পথে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, স্বাভাবিক ধর্ম। সে কারণে বাঙালির উৎসব প্রবণতার পক্ষে ইসলাম বাধা সৃষ্টি করেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎসাহ জুগিয়েছে। আবহমান কাল ধরে বাঙালিরা উৎসবপ্রবণ, প্রাণবন্ত। উচ্ছ্বল এবং উজ্জ্বল আনন্দ তাদের জীবনের উৎস। সুখ ও শান্তি তাদের নিত্যসঙ্গী। অল্পে তুষ্ট এ ব-দ্বীপের মানুষগুলো আনন্দের অনুসঙ্গ পেলে অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে যায়। সে কারণেই আমাদের কাছে ঈদ এতো আনন্দের এবং এতো উৎসবের। তাই বলে অশ্লীল আর নিষিদ্ধ পথে তো পা বাড়ানো যায় না। কেননা, প্রত্যেকটি জাতি-গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা আচার অনুষ্ঠান সে জাতির পরিচায়ক। এটা বলাই যেতে পারে দুর্গাপূজা দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়কে চেনা যায়, বড়দিন দিয়ে খৃস্টানদের চেনা যায়, মাঘিপূর্ণিমার মাধ্যমে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে চেনা যায়। এমনিভাবে ঈদ দিয়ে মুসলিমদের চেনা যায়। সুতরাং ঈদ উৎসব পালনে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার।

পরিশেষে বলা যায়, আমরা যদি ইসলামের সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে ঈদ উৎসব পালন করতে পারি, তবে বাস-ট্রেন-লঞ্চে হুড়োহুড়ি করে বাড়ি ফেরা সফল হবে। সফল হবে আমাদের ঈদকার্ড, সফলতা পাবে ঈদের এসএমএস আর ফেসবুকের স্ট্যাটাসগুলো। তাই কামনা করছি, ঈদ আমাদের ঘরে ঘরে বয়ে আনুক শান্তি ও সমৃদ্ধির স্পন্দন। ঐক্য, সংহতি ও ঈমানের আলোকোজ্জ্বল পথ ধরে আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি। ঈদের আনন্দ হোক সবার আনন্দ।

আলী ওসমান শেফায়েত
শিক্ষক ও গবেষক
ইমেইল: aliosmansefaet@gmail.com

1,132 Views

আরও পড়ুন

বোয়ালখালীর নব যোগদানকৃত শিক্ষা অফিসার হারুন উর রশীদকে বরণ

জামালপুরে মৃত আইনজীবী হলেন অতিরিক্ত জিপি

তানযীমুল উম্মাহ হিফয মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড শাখার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

সাইফুল ইসলামের কবিতা : শীতের আমেজ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ইসলামি বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ

পাবনার হেমায়েতপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপে সংঘর্ষ : নিহত ১

কাপাসিয়ায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে বিএনপির বিশাল শোভাযাত্রার আয়োজন

কাপাসিয়ায় ইসলাম শিক্ষা শিক্ষক পরিষদের উদ্যোগে সিরাতুন্নবী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন

কক্সবাজারের ঈদগাহতে ফুলকুঁড়ি আসরের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন

জবিস্থ শরীয়তপুর জেলা ছাত্রকল্যাণের নেতৃত্বে সৌরভ – মনির

কাপাসিয়া প্রেসক্লাবের কারা নির্যাতিত সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটনকে সংবর্ধনা ও ফুলেল শুভেচ্ছা

দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করতে জাতীয় ঐক্যমত্যের বিকল্প নেই–মিয়া গোলাম পরওয়ার