কাজী আশফিক রাসেল
গত দুদিন আগে চিরকুট লিখে ঢাবি ভর্তিপরীক্ষায় ব্যর্থ মৌমিতা মৌ নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আর আজ চিরকুটে ‘স্বেচ্ছায় মৃত্যু’ লিখে রাবিতে তানভীর নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
ভর্তি পরীক্ষার্থী মৌমিতা মৌ না হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন ভঙ্গের হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, কিন্তু অনেক স্বপ্নময় জীবনের আশা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অসীম সম্ভবনার মধ্যেও দাঁড়িয়েও রাবি শিক্ষার্থী তানভীর কেনো এবং কোন যুক্তিতে আত্মহত্যা করলো বিষয়গুলো অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একের পর এক আত্মহত্যা তাদের অমূল্য জীবনের মূল্য নির্ধারণে অনুদারতার পরিচয়,যা দেশের মানুষকে বিব্রত, শঙ্কিত ও আতঙ্কিত করছে।
আত্মহত্যা অবশ্যই অনৈতিক,আত্মবিধ্বংসী ও কাপুরুষোচিত কাজ ; এর পক্ষে সাফাই গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে একথা সত্য, এর দায় আমাদের সমাজ এবং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কোনমতেই এড়াতে পারেনা।
প্রত্যেকটা আত্মহত্যার আলাদা কারণ থাকতে পারে। আমার মতে প্রত্যেকটা কারণই একইসূত্রে গাঁথা; হতাশা থেকেই এই আত্মহননের সূত্রপাত। কিন্তু এই হতাশা কোথা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে?
একজন শিক্ষার্থী যখন স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তার স্বপ্নের সাথে পরিবারের স্বপ্নগুলো যেন নতুন মাত্রা যোগ করে; আর একটা সময় পর সকলের প্রত্যাশার চাপ যখন সে বুঝতে শেখে, তখন এই শিক্ষা ব্যবস্থা তাঁকে চরম ভাবে হতাশ করে। যেমন, আমাদের সমাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় সরকারি চাকরী ব্যতীত জীবন মূল্যহীন। কিন্তু বাস্তবে একটা সরকারি চাকরী দিয়ে কখনোই জীবনের মূল্য নির্ধারিত হতে পারেনা।
পরিবার এবং সমাজের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা, প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্ষীয়মাণ সুযোগ তাঁদের বিষন্নতাকে হতাশায়, হতাশাকে ভয় আর ভয় ভবিষ্যতকে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে পরিণত করে। প্রত্যেকটা আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আমাদের অসচেতন পরিবারগুলো। প্রেম বিষয়ক জটিলতা, প্রত্যাশিত চাকুরি না পাওয়ার আক্ষেপ, অন্যান্য যেকোন সমস্যায় একজন মানুষ যখন ব্যর্থ হয় তখন সে পরিবারের উপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাহিরের প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করতে তাঁকে তাঁর পরিবার সাহায্য করবে, তাঁকে মনোবল জুগিয়ে মন শক্ত করে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিবে এই আশায় থাকে। কিন্তু যখন পরিবার তাঁকে আরো অবহেলা করে, বিপরীত কথা শোনায় তখন সে আর তা সহ্য করতে পারেনা। সে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে। নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমাদের প্রত্যেকটা পরিবারে অন্তত এমন একজন সদস্য থাকা উচিত যাকে নিঃসঙ্কোচে সবকিছু বলা যায়। পুরো পৃথিবী বিপক্ষে দাঁড়ালেও অন্তত পরিবার পাশে দাঁড়াবে, এমন ভরসা থাকা খুব দরকার।
আমরা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে যতোই অগ্রসর হচ্ছি আমাদের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব ততোই বাড়ছে। আমাদের পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কের বন্ধন কমতে শুরু করেছে। এতে করে আমাদের নিজেদের সমস্যাগুলি একে অন্যকে মনখুলে বলতে পারছি না। ফলে এক প্রকার হতাশা থেকে আত্মহত্যার জন্ম হয়। একজন আত্মহত্যা করলে আশেপাশে থাকা ব্যক্তিরা একই ধরনের সমস্যার জন্য আত্মহত্যাকে সমাধান হিসেবে বেছে নেয়। যার কারণে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে ।
আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সঠিক সমাধান নয়।জীবন আপনার। আপনি আপনার জীবন রাখবেন কি রাখবেন না তা একান্তই আপনার ব্যাপার; তর্কের খাতিরে এটি মেনে নিলাম। কিন্তু আপনার জীবনের সঙ্গে যদি আরো কিছু জীবন জড়িয়ে থাকে, তাহলে আপনার জীবনের মালিকানা শুধুমাত্র আপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কাজেই চাইলেও আপনি আত্মহনন করতে পারেন না। কেননা, আপনার একটি অপমৃত্যু আরো কিছু মানুষকে জিন্দালাশে পরিণত করবে, যা মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। কাজেই আত্মহত্যা থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।
আপনি যদি সফল হতে চান, তাহলে আপনার জন্য সম্ভাবনাময় অনেক পথ খোলা আছে। কোন বিশেষ চাকরি, পেশা বা ভালো ফলাফলকে নিজের সফলতার গন্তব্য ভাবা কোন সুবিবেচকের কাজ নয়।
জীবনে অনেকবার আপনাকে থেমে যেতে হবে, অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটবে, বারবার হেরে যাওয়ার পরেও নতুন স্বপ্ন দেখতে হবে, আপনাকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কারণ শেষ হাসিটা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
সর্বোপরি, আপনাকে আশাবাদী হতে হবে। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে- দূঃখ উপেক্ষা করে সুখ আসবেই।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক।