গাজীপুর প্রতিনিধি :
গাজীপুরের টঙ্গী, কাশিমপুর, কলেজগেট এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক বছরে প্রতারণা, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ব্ল্যাকমেইল ও নারী হয়রানির অভিযোগে একই ব্যক্তির নাম সামনে আসছে—নিজেকে “বাংলাদেশ ওলামা লীগ”-এর সভাপতি পরিচয়দানকারী মাওলানা ইসমাইল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে তিনি একটি সংঘবদ্ধ প্রতারণা চক্র পরিচালনা করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী একাধিক হত্যা মামলার অভিযোগ থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তিনি গ্রেপ্তারবিহীন।
ধর্মীয় পরিচয় ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ :
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের বরিশপুরের বাসিন্দা ইসমাইল দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় পোশাক ও “মাওলানা” উপাধি ব্যবহার করে নিজেকে ধর্মীয় নেতার পরিচয়ে পরিচিত করে তুলেছেন। বিভিন্ন এলাকায় “সভাপতি” পরিচয়ে ছোট ছোট কমিটি গঠন করে সমাজসেবার নামে অনুদান ও চাঁদা সংগ্রহ করতেন তিনি।
গাজীপুরের কলেজগেট এলাকার এক ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ জানান, মাদ্রাসা নির্মাণের কথা বলে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছিল। পরে জানতে পারি—এমন কোনো প্রকল্পই নেই।”
ওলামা লীগের দাবি—২০১৯ সালেই বহিষ্কা
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে , ইসমাইলকে ২০১৯ সালে “দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও প্রতারণার অভিযোগে” বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু বহিষ্কারের পরও তিনি ওলামা লীগের নাম, ব্যানার ও লোগো ব্যবহার করে অনুষ্ঠান, দাওয়াত ও নতুন কমিটি গঠন অব্যাহত রাখেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ—তিনি “বাংলাদেশ ওলামা লীগ”, “ওলামা পরিষদ” ইত্যাদি নতুন নামে সংগঠন তৈরি করে নিজেকে সভাপতি হিসেবে প্রচার করছেন।
ভুয়া কমিটি গঠন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ :
বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা এলাকায় ভুয়া কমিটি গঠনের মাধ্যমে নবীনদের পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এক ভুক্তভোগী বলেন,“চাঁদা না দিলে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিত, দোকানে লোক পাঠাত, ভয়ভীতি দেখানো ছিল নিত্যকার ঘটনা।”
নারী হয়রানি ও প্রতারণামূলক সম্পর্কের অভিযোগ:
নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কয়েকজন নারী অভিযোগ করেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ইসমাইল অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেন এবং পরে সম্পর্ক ভেঙে ব্ল্যাকমেইল করেন।
গাজীপুরের এক নারী জানান, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গয়না নিয়েছিল। পরে উল্টো ছবি ভাইরালের হুমকি দিয়েছে।
সামাজিক চাপ ও নিরাপত্তা-ঝুঁকির কারণে অনেকেই অভিযোগ করতে সাহস পান না বলে জানা গেছে।
জমিদখল সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ:
স্থানীয়দের দাবি, ইসমাইল খাসজমি ও বিরোধপূর্ণ জমিতে জাল কাগজপত্র তৈরি করে দখল নেওয়ার একটি চক্র পরিচালনা করেন।
এক ভুক্তভোগী জানান, ওলামা লীগের নামে সামাজিক প্রকল্পের কাগজ দেখিয়ে সই নিয়েছিল। পরে জানতে পারি—জমিটি বিক্রি করে দিয়েছে।
একাধিক হত্যা মামলার আসামি—তবুও গ্রেপ্তারবিহীন
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম বেতুকানিয়া ও গাজীপুরের বাসন থানায় সংঘটিত একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইসমাইলের নাম অভিযোগ হিসেবে রয়েছে বলে দাবি করছে প্রভাবিত পরিবারগুলো। তাদের অভিযোগ—সম্প্রদায় উত্তেজনা ছড়িয়ে হামলার পরিবেশ তৈরিতে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে এসব মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির।
এধিকে পুলিশি নীরবতায় ক্ষোভ বাড়ছে,
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, একের পর এক মামলা ও অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ইসমাইল প্রকাশ্যে এলাকায় বিচরণ করছেন।
চান্দনা চৌরাস্তার এক ব্যবসায়ী রহমান হক বলেন,এত মামলা, এত অভিযোগ, তবুও তাকে ধরা হয় না—আমরা তাহলে কোথায় বিচার পাব?
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কালাম বলেন, “ধর্মের নামে প্রতারণা করলে শাস্তি আরও কঠোর হওয়া উচিত। কিন্তু তদন্তে অগ্রগতি নেই।”
পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মামলাগুলো পুরনো, কিছু অভিযোগে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য মিলছে না। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ—সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানোই তার প্রধান অস্ত্র।
টঙ্গীর এক আলেম রহিমুল্লাহ বলেন, ওলামা লীগের নাম ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ করছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
হুমকি ও ভয়ে এলাকা ছাড়ছেন ভুক্তভোগীরা :
বেশ কয়েকজন অভিযোগকারী জানান—থানায় অভিযোগ করতেই তার অনুসারীদের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ না থাকলেও তবে তার নিজেস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীরা সক্রিয় এখানো।
কুলসুম নামের এক নারী বলেন, “অভিযোগ করার পরদিনই বাড়িতে তার নিজেস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী পাঠিয়ে ভয় দেখানো হয়েছে। এখন সন্তান নিয়ে আতংকে আছি।”
আইনজীবী হাসান মাহমুদ নেহাল বলছেন, গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত কাউকে দীর্ঘদিন ধরে গ্রেপ্তার না করা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আইন বিশেষজ্ঞ আব্দুল হাকিম মন্তব্য করেন, “স্বচ্ছ তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার না হলে ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে থাকা প্রতারকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।”
এবিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি জাহিদুল হাসান বলেন, যদি তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে অতিদ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
গাজীপুর–নারায়ণগঞ্জজুড়ে একটি প্রশ্নই এখন সর্বত্র— মাওলানা ইসমাইলের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ ও মামলাগুলোর তদন্ত কবে সক্রিয় হবে? এবং তিনি কবে গ্রেপ্তার হবেন?