✍️ রফিকুল ইসলাম জসিম
ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ—ইসলামের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। পবিত্র জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় এই মহিমান্বিত দিন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন বহনকারী এই ঈদ একাধারে বিশ্বাস, আনুগত্য ও মানবিকতার প্রতীক। কিন্তু আমাদের আজকের সমাজে ঈদের এই অন্তর্নিহিত চেতনা কতটা রক্ষা পাচ্ছে? ঈদ কি কেবল পশু কোরবানির বাহারি উৎসবে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে? আজকের এই ঈদের ভোরে প্রশ্নটা জরুরি। কারণ ঈদ মানে শুধু আনন্দ নয়, দায়বদ্ধতা—নিজের, সমাজের এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি।
আধুনিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোরবানির ঈদকে অন্য এক রূপ দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গরু-ছাগলের ছবি, ‘হ্যাশট্যাগ কোরবানি’, দাম জানিয়ে ‘শো-অফ’—এসব যেন একপ্রকার সামাজিক প্রতিযোগিতা। কে কত বড় পশু দিয়েছে, কার গরু কতটা ‘ফেরারি কালার’—এসব প্রশ্ন ঈদের মূল বার্তাকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু প্রকৃত ঈদ কি এমনই? হজরত ইব্রাহিম (আ.) কি শিখিয়েছিলেন বাহ্যিক প্রদর্শনের শিক্ষা? বরং কোরবানির মূল শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ—নিজের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা। কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে:
“আল্লাহর কাছে পৌঁছে না পশুর গোশত কিংবা রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।” (সুরা হজ, আয়াত ৩৭) এই আয়াত মনে করিয়ে দেয়—কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়, বরং মনের পশু জবাই, অহংকার, লোভ, আত্মপ্রদর্শন থেকে মুক্তি।
আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সবচেয়ে বড় সংকটে। তারা ধনী নয়, আবার দারিদ্র্যসীমার নিচেও পড়ে না। ফলে সরকার বা সমাজের কোনো ‘সুবিধা’র আওতায় আসে না তারা। কোরবানির মতো বড় ধর্মীয় উৎসবে এই শ্রেণির অবস্থা হয় সবচেয়ে বেদনাদায়ক।
প্রচলিত সামাজিক রীতিতে কোরবানি না দিলে ‘দীন’ ভাবা হয়, আত্মীয়-স্বজনের কাছে লজ্জা লাগে, প্রতিবেশীর কাছে হীনমন্য লাগে। ফলে অনেকেই সামর্থ্যের চেয়ে বেশি খরচ করে কোরবানি দেন। কেউ কেউ একসাথে মিলিত হয়ে কোরবানি করেন, কেউ অংশ নেন মসজিদের সমবায় কোরবানিতে। কেউ কেউ আবার লোকলজ্জায় না জানিয়ে গরিবদের দান করে দেন, যাতে দায়িত্ব পালিত হয়—তাও নিজে খেতে না পারলেও। এটা এক নিঃশব্দ আত্মত্যাগ—যা হয়তো আলোচিত হয় না, কিন্তু ঈদের অন্তর্গত অর্থকে ধারণ করে।
ঈদুল আজহার আরেকটি বাস্তব দিক হলো পরিচ্ছন্নতা ও ব্যবস্থাপনা। ঈদের কোরবানির পর পশুর বর্জ্য, রক্ত, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। নানা জায়গায় নালায় জমে পশুর চর্বি, রাস্তায় জমে যায় পানি। এতে তৈরি হয় স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ। যেখানে কোরবানির ঈদ আত্মশুদ্ধির প্রতীক, সেখানে এই পরিবেশগত অব্যবস্থাপনা ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্যকে ম্লান করে দেয়। নগর কর্তৃপক্ষের যেমন উদ্যোগ দরকার, তেমনি দরকার নাগরিকদের সচেতনতা। আল্লাহর নামে কোরবানি করেও যদি প্রতিবেশী বিরক্ত হন, পরিবেশ নষ্ট হয়—তাহলে কি সে কোরবানি সম্পূর্ণ হল?
বাংলা সাহিত্যে ঈদুল আজহা এক বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। শরৎচন্দ্র থেকে সেলিনা হোসেন, সাদত হোসেন মান্টো থেকে আহমদ ছফা—ঈদের ত্যাগ, সামাজিক বৈষম্য, মানবিকতা উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায়।
ঈদ সংখ্যা গুলো এই সময়ের এক বড় সাংস্কৃতিক আয়োজন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে ঈদ মানেই নতুন জামা আর একখানা ঈদ সংখ্যা। সাহিত্যিকদের চোখে ঈদের ত্যাগ, সমাজের বাস্তবতা, প্রেম, দ্বন্দ্ব—এসব উঠে আসে ভিন্ন আলোকে। এতে ঈদের চেতনা শুধু ধর্মীয় নয়, হয়ে ওঠে মানবিক।
এই সময়ে এসে আমাদের ভাবতে হবে—আমাদের ঈদ কতটা বাহ্যিক, আর কতটা আত্মিক? আমরা পশু জবাই করছি ঠিকই, কিন্তু নিজের ভেতরের পশুত্ব—হিংসা, অহংকার, লোভ—তা কি কোরবানি করতে পারছি?
কোরবানি হোক শুধু আঙুলের ছবি পোস্ট করার উপলক্ষ নয়—হোক একটি প্রকৃত আত্মত্যাগের, আত্মউপলব্ধির সময়। আমাদের ঈদ হোক সব শ্রেণি, সব পেশা, সব বয়সের মানুষের জন্য এক পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর মুহূর্ত। আসুন, কোরবানির ঈদে আমরা তাকওয়ার আলোয় আলোকিত হই। ত্যাগে হোক আমাদের সত্যিকারের ঈদ। ঈদ মোবারক!