ঢাকাশুক্রবার , ৩ মে ২০২৪
  1. সর্বশেষ

স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেল প্রবৃদ্ধির এক সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
২৫ মার্চ ২০২৩, ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

মোঃ কামাল হোসেন :

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অপর ভাগে রয়েছে ভারী শিল্প এলাকা। কর্ণফুলী নদীর উপর ইতোমধ্যে ৩ (তিন) টি সেতু নির্মিত হয়েছে, যা বিরাজমান প্রচুর পরিমাণ যানবাহনের জন্য যথেষ্ট নয়। নদীর মরফলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমা একটি বড় সমস্যা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারীতার জন্য বড় হুমকি। এই পলি জমা সমস্যার মোকাবেলা করার জন্য কর্ণফুলী নদীর উপর আর কোন সেতু নির্মাণ না করে এর তলদেশে টানেল নির্মাণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকার চট্টগ্রাম জেলার দুই অংশকে সংযুক্ত করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কর্ণফুলী টানেল বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই নামগুলো হচ্ছে – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গ, কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ। এই টানেলে কর্নফুলী নদীর ১৫০ ফুট গভীরে স্থাপন করা হচ্ছে দুইটি টিউব। নদীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরে চার লেনের টানেলে চলবে যানবাহন। টানেলটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করবে। এই টানেলে বা সুড়ঙ্গ নির্মিত হলে এটি হবে বাংলাদেশে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গ পথ।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এই টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানেলটির আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রথমে এই প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যায় আনুমানিক প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ধরা হয় পরবর্তীতে সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসাবে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি অর্থায়ন বাংলাদেশ সরকার করছে। আর নদী সুড়ঙ্গের কাজ হাতে পেয়েছে চীনের নির্মাণ সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হলেও, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার এবং এর সঙ্গে ৫ কিলোমিটারের বেশি সংযোগ সড়ক যুক্ত হবে। টানেলে থাকছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব, যাদের প্রতিটি দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। ২০২২ সালের মধ্যে টানেল বা সুড়ঙ্গটির নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এবং নতুন কিছু অবকাঠামো যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ায় সম্ভব হয়নি যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু টানেল যোগ করবে নতুন মাত্রা। চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক নগরী। কর্ণফুলী নদীর মুখে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেশের আমদানি এবং রপ্তানি কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। প্রস্তাবিত টানেল চট্টগ্রাম বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারা দেশের সাথে সংযুক্ত করবে। টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠবে ‘এক নগর, দুই শহর’। এ রকম নগরীর দেখা মেলে চীনের সাংহাইয়ে। দেশটির সবচেয়ে বড় ও জনবহুল নগরী সাংহাই পরিচিত ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে। এই শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্রকে দুই ভাগে ভাগ করেছে চ্যাং জিয়াং নদীর উপনদী হুয়াংপু ,যে নদীতে নির্মিত টানেল যুক্ত করেছে দুই তীরকে। সাংহাই সমুদ্রবন্দর বর্তমান বিশ্বের ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দর। সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরগুলোর একটিও। সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রাম নগরী থেকে আনোয়ারা উপজেলাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে কর্ণফুলী নদী।

তাই দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিকভাবে চট্টগ্রাম মহানগরীর গুরুত্ব ও পরিধি ব্যাপক হলেও এ নগরী শুধু কর্ণফুলীর এক প্রান্তেই বিস্তৃত হয়েছে। সড়ক সংযুক্তির অভাবে নদীর ওপারের আনোয়ারায় বাণিজ্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি না হওয়ায় সেদিকটা থেকে গেছে অবহেলিত। টানেল নির্মাণের পর বন্দরনগরীর পরিধি বাড়বে। ফলে, ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বাড়বে। ইতোমধ্যে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে আনোয়ারায় ৭৬০ একরের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। টানেলের সংযোগ সড়ক থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলায় পোশাক, সার, সিমেন্ট, ইস্পাত, ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কিছু শিল্পকারখানায় উৎপাদন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে এখানে গড়ে উঠছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও হাসপাতাল। এসব শিল্পের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। শুধু আনোয়ারা বা কর্ণফুলীই নয়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সমগ্র এলাকাতেই তৈরি হয়েছে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী যানবাহনগুলো চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুসহ ৩টি সেতু রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু টানেলটি মূল শহরের বাইরে হওয়ায় এখন আর চট্টগ্রাম শহর অতিক্রম করার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে চট্টগ্রাম নগরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংযুক্ত হওয়ায় ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব কমে আসবে। ফলে, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন হবে সহজ ও দ্রুত।

কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারাদেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। উপরন্তু টানেলের সংযোগ সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক। যার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে সরাসরি পণ্য পরিবহন করা যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও শিল্প-বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি এ টানেল সড়কপথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতেও রাখবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণে সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে দুই অংশের সংযোগ স্থাপন জরুরি। এতে টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত পারকি সমুদ্র সৈকতে যাতায়াত সহজ হবে টানেলের মাধ্যমে। টানেল খুলে দিলে মাত্র ১৫ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে লোকজন পারকি সৈকতে আসতে পারবেন। ফলে, এ সৈকত ঘিরে পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা বিকশিত হবে। ৩.৫ কি.মি. দীর্ঘ টানেলটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, যা একই দৈর্ঘ্য এর কোনো ব্রিজ নির্মাণের ব্যয়ের তুলনায় বেশি। ফলে, ব্রিজ নির্মাণ না করে টানেল নির্মাণে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়কে অপচয় মনে হতে পারে। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কর্ণফুলী টানেল স্থাপনের যৌক্তিকতা রয়েছে।

পদ্মা সেতুর পর এশিয়ার দীর্ঘতম টানেল বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের নির্মাণশিল্প ও স্থাপত্যের নতুন নিদর্শন, যা দেশের আভিজাত্যকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দান করবে। বঙ্গবন্ধু টানেল সরাসরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। ধারণা করা হয়, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে এটিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণকরাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে ।

লেখক: গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

188 Views

আরও পড়ুন

শেরপুরে ছাত্র কল্যান পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

মুক্তি পেছালো আল্লামা মামুনুল হকের

রাজধানীতে হঠাৎ বৃষ্টি, সাথে তুমুল বজ্রপাত

চট্টগ্রাম উত্তর জেলায় ছাত্র অধিকার পরিষদ এর নতুন কমিটি

পেকুয়ায় বজ্রপাতে দুই লবণ চাষির মৃত্যু

গাইবান্ধায় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান মে দিবস পালিত

আলোচিত মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতার

নওজোয়ানের সংবর্ধনায় চবি ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জনকারী মোবারক হোসাইন

শুধু গরমে গাছের গুরুত্ব নয়, গাছ লাগাতে হবে সারাবছর

বিশ্ব শ্রমিক দিবস : একটি পর্যালোচনা

কুবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন

তীব্র তাপদাহে বাড়ছে রোগী : বারান্দা-মেঝেতে একের স্থানে তিন