এ.এম জিয়া হাবীব আহসান
পরপারে অনন্ত জীবনে পাড়ি জমালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ছাত্রনেতা আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী । ১৯৬২-৬৯ সালের নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ৬৭-৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বরেণ্য সমাজসেবক ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের স্থপতি, শ্রদ্ধেয় চাচাজান আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী আর নেই। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নালিল্লাহে রাজেউন) ।
তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১ মাস যাবত পার্কভিউ হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন । গত ২৯ জানুয়ারী’ ২১ পবিত্র জুমাবার রাত আনুমানিক ১০:৩০ মিনিটে ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । হাটহাজারীর তদানিন্তন বৃহত্তর গুমানমর্দনের নাঙলমোড়া গ্রাম ছিল সে সময়ের শিক্ষা-দিক্ষা, রাজনীতি ও সমাজ উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু । তিনি ছিলেন সাবেক গুমানমর্দন বর্তমান নাঙলমোড়া ইউনিয়নেরর বাসিন্দা । তাঁর পিতা ছৈয়দ আহমদ কেরানী ও একজন ধর্মপ্রাণ সমাজসেবক ছিলেন । ৬ ভাই, ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মা বাবার ২য় সন্তান । সিরাজ সাহেবের ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে ২ ছেলেই অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী । নাঙলমোড়া গ্রামের বাজার ছিল তখন সকল শ্রেণীর শিক্ষিত ছাত্র, যুবকদের মিলনকেন্দ্র ।
নাঙলমোড়া স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন । তরুণ সমাজ তখন গঠনমূলক চিন্তা ভাবনা করত । তিনি কলেজিয়েট স্কুলে মেট্রিকুলেশন পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন । এরপর তিনি কমার্স কলেজে ভর্তি হন । ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয় । শিক্ষা আন্দোলনের সময় তিনি দিশারী কমার্স কলেজ শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে ১৯৬২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারী তাঁরা চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপণ করেন । ছাত্রদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬২-৬৯ পর্যন্ত তিনি পুরোপুরি রাজপথে ছিলেন । বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন, ৫টি মামলার আসামী হয়েও আন্দোলন সংগ্রামে সম্পৃক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে । অন্যায়ের পক্ষে কখনো হার মেনে নেননি । স্বাধীন পাকিস্থানের অখন্ডতা যে বেশি দিন টিকবে না তা তখন থেকে তিনি বুঝতে পেরছিলেন । তিনি ক্রমান্বয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন ।
চট্টগ্রামে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সুত্রপাত করেছিলেন সিরাজ চাচারা ।’
৭১ সালের ১লা মার্চের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর চট্টগ্রামের জনপদের চিত্র ও তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে গবেষক সাখাওয়াত হোসেন মজনু রচিত “রণাঙ্গনে সুর্য সৈনিক” ও সাংবাদিক ইদ্রিস আলম রচিত “আমরা এখন যুদ্ধে” গ্রন্থদ্বয়ে বিস্তারিত লিপিবদ্ধ আছে । মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ডা. মাফুজুর রহমান কর্তৃক রচিত আমার সাক্ষাৎকারটি এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য (www.mjgobeshona.org) মরহুম এডঃ সুলতানুল কবির চৌধুরী ও সিরাজ চাচার নেতৃত্বে শহরে মিছিল হয় । তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি চকবাজার এলাকায় নিজ এরিয়া থেকে অপারেশন করেছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে সেখানে যান । শারীরিক গঠন ও সৌন্দর্য্যের কারণে সীমান্তে তাঁকে পাঞ্জাবী মনে করে কিছুক্ষণ আটক রাখা হয় ।
পরবর্তীতে আজাদী সম্পাদক প্রফেসর খালেদ ও হাটহাজারীর সাবেক এমপি এম এ ওহাবের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান । দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্ত হননি । কখনও সনদ পাওয়ার চেষ্টাও করেননি । তিনি বলতেন সনদের জন্যে যুদ্ধ করিনি দেশকে হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধ করেছি । তিনি বলেন তালিকায় বহু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও আছে । দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর থেকে সরাসরি রাজনীতি থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন ।হাটহাজারীর লাংগলমোড়া -গুমানমর্দন নিজ গ্রামে তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা সহ বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক হিসেবে গৌরববোধ করতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন । যাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস রচনায় সংশ্লিষ্টদের সহায়তা দিতে পারেন । ১৯৪৯-৫০ সনের দিকে আমার দাদা মরহুম এম. আমিনুল্লাহ সিরাজ চাচা ও তাঁর বড় ভাই আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম চৌধুরীর শিক্ষক ছিলেন । তখন তাঁরা দু’ভাই আমার দাদার ঘরে গিয়ে প্রাইভেট পড়তেন । সে যুগে এমন দক্ষ শিক্ষকের সন্ধান পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার । আমার দাদা তদানীন্তন সময়ে এন্ট্রান্স পাশ ছিলেন । বার্মায় (বর্তমানে মায়ানমার) প্রখ্যাত দানবীর আদালত খাঁ ও আমার দাদাজানের ছাত্র ছিলেন । তখন আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহয়্যার সাথে তাঁর পরিচয় ও হৃদ্যতা । আমার বাবা সিরাজ চাচার বড় ভাই নজরুল ইসলাম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন । আমার বাবা সিরাজ চাচাকে ছোট ভাই তুল্য মনে করতেন, সিনিয়র ও জুনিয়র এর মধ্যে অত্যন্ত মান সম্মানগত সম্পর্ক ছিল । সিরাজ চাচা আমার চাচা আবু মোহাম্মদ এয়াছিনের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন । ১৯৭৩ সালে বৃহত্তর গুমানমর্দনকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ৩ ভাগে ভাগ করতে তিনি প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হয় । বিপণী বিতানের ২য় তলায় লাকী ফ্রেন্ডস ষ্টেশনারী বলে তাঁর একটি পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল । ওখানে তিনি বসতেন । তাছাড়া তাঁর আমদানী ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানও ছিল । তিনি অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত, সৌদি আরব সহ পৃথিবীর বহুদেশ সফর করেন । আমাদের গ্রাম ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম ও সংখ্যালঘুদের অভয়ারণ্য ।
সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আমার পিতা মরহুম এডভোকেট এ এম য়্যাহ্য়্যা চেয়ারম্যানকে সংখ্যালঘুরা ২টি স্বর্ণপদক ও নগদ অর্থ উপহার দেন ।
আমার আব্বা ৭০ এর পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রফেসর খালেদ সাহেবের প্রস্তাবক ছিলেন । আমার পিতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং গ্রাম উন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনে তাঁরা দু’ভাইয়ের ও তাঁদের পিতার যথেষ্ট সহযগিতা পান । তাঁরা যেকোন প্রয়োজনে সৎ পরমর্শের জন্য আমার আব্বার শরণাপন্ন হতেন । আমার পিতার মৃত্যুর পর সিরাজ চাচা আইনগত বিষয়ে পরামর্শের ক্ষেত্রে আমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন । কর্ণফুলী থানাধীন কিছু সম্পত্তি ভূমিদস্যু চক্র জালদলিল করে আত্মসাৎ এর চেষ্টা করলে তিনি আইনী সহায়তার জন্য আমার আইনী সহায়তা নেন । এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করলে তিনি তা তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন এবং তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায় । কিন্তু জমি ফেরত না পাওয়ায় মনে দুঃখ নিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান । তিনি এলাকায় নিজ ব্যয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা এতিমখানা নির্মান করেন । যার ওয়াকফ দলিলটিও আমার দ্বারা লিখিয়েছিলেন ।
সিরাজ চাচা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন । কিছুদিন আগে চন্দনপুরাস্থ দানির বাপের বাড়ির পুকুর পাড়স্থ নিজ বাসভবনে তাঁর পরিবারের একটি পার্টিশান দলিল রেজিস্ট্রির সময় তিনি তাঁর স্ত্রী পরিবারকে ডেকে বলেন, তোমরা যেকোন বিষয়ে আমার ভাতিজার সাথে পরামর্শ করবে । হাসপাতালে গুরতর অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও তিনি ফোনে আমার সাথে একাধিকবার কথা বলেন এবং সকলের খবরা খবর নেন । তিনি মাছুয়া ঝর্ণাস্থ আমার বাসার চেম্বারে এবং চট্টগ্রাম আইনজীবী ভবনের আমাদের ৮০ নং চেম্বারে আসতেন এবং আমার সব এসোসিয়েটদের সাথে চাচার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল । বিশেষ করে আমার স্নেহধন্য জুনিয়র এডভোকেট প্রদীপ আইচ দীপুকে পুত্র বৎ স্নেহ করতেন । আমাকে না দেখিয়ে কোন কাগজে তিনি স্বাক্ষর করতেন না । নেতা নেত্রী সহ সরকারের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও আত্নীয়তা থাকলেও কখনো কারো কাছে তিনি সাহায্য চান নি । স্বাধিকার আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার বাবার কথা বার বার স্মরণ করতেন । তিনি একাধিকবার হজ্ব ও ওমরা করেন এবং প্রায় প্রতি বছরই রমজানে ওমরাহ্য় এতেকাফ নিতেন । আঞ্জুমানের অন্যতম সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম সালেহ আহমদ সওদাগরের তিনি বড় জামাতা ছিলেন । চট্টলবীর মহিউদ্দীন চৌধুরী তাঁকে খুব পছন্দ করতেন ও বড় ভাইয়ের মত সম্মান করতেন । তাঁর পুত্র চট্টগ্রাম-৯ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাঁর মৃত্যূতে নিজের পেইজে গভীর শোকবার্তা প্রকাশ এবং সিরাজ চাচার আত্নার মাগফিরাত কামনা করেন । জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মহসিন কলেজস্থ মাঠে বিশাল জানাজা শেষে তাঁকে গার্ড অফ অনার দেয়া হয় । সিরাজ চাচাকে মিসকিন শাহ মাজারস্থ কবর স্থানে অত্যন্ত মান-মর্যাদার সাথে দাফন করা হয় ।
সর্বশেষে মরহুম আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী চাচার বহু অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে মহান আল্লাহ্ তাআলার দরবারে দোয়া করি আল্লাহ্ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন । আমীন ।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী ।