–এ.এম. জিয়া হাবীব আহসান, এডভোকেট :
প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারী আসলে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালুর সোচ্চার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারী চলে গেলে সে আওয়াজ আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে যায়। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা বাংলা সনের ৮ই ফাল্গুন কে এখনও ভাষা দিবস হিসেবে চালু করতে পারিনি। আইনের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আইন-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলনের বিষয়ে আজ শুধু দু’টি কথা লিখবো। আমাদের আইন আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে কোন আইনগত বাঁধা না থাকা সত্বেও এ কাজে আমরা এখনও পিছিয়ে আছি কেন? জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ড, চীন, রাশিয়া, সুইডেন প্রভৃতি দেশে তাদের মাতৃভাষায় বিদেশীদেরও কথা বলতে হয়। তাদের ভাষা শিখে সেখানে যেতে হয় অথবা শেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়। কিন্তু আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েও সে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলাম না।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫৭ ধারায় আদালতে সাক্ষীর জেরা, জবানবন্দী ইংরেজী ভাষায় অথবা ‘আদালতের ভাষায়’ লিপিবদ্ধ করতে সরকার নির্দেশ দিতে পারেন। বৃটিশের গোলামী যুগে বাংলার প্রাদেশিক সরকার উক্ত ধারা মূলে ম্যাজিষ্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালত সমূহে জেরা জবানবন্দী ইংরেজী ভাষায় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলো। পাকিস্তান আমলেও তা বলবৎ থাকে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বর্তমানেও এ ব্যাপারে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা বা বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমাদের মাতৃভাষা বহু ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৩৫৭ ধারায় ফৌজদারী আদালতের রায় ‘আদালতের ভাষায়’ অথবা ইংরেজীতে লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে। হাইকোর্ট ব্যতীত অন্যান্য আদালতের ভাষা কি হবে তা ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৫৮ ধারা মতে সরকার নির্ধারণ করতে পারেন। হাইকোর্টে সাক্ষীদের সাক্ষ্য কিভাবে গৃহীত হবে সে বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৫ ধারা মোতাবেক হাইকোর্টকে দেয়া হয়েছে। এ প্রকার বিধি প্রণয়নের জন্য হাইকোর্টের চুড়ান্ত এখতিয়ার রয়েছে। (সূত্রঃ সিলেক্ট কমিটি রিপোর্ট, ১৯৬১) ১৯০৮ সনে প্রণীত দেওয়ানী কার্যবিধি আইনের ১৩৭ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যে পর্যন্ত সরকার অন্য নির্দেশ প্রদান না করেন সে পর্যন্ত হাইকোর্টের অধীনস্থ যে আদালতে আদালতে বাংলা ভাষা হিসেবে যে ভাষা প্রচলিত আছে সে আদালতে সে ভাষাই প্রচলিত থাকবে….।
‘ সিভিল রুল্স এন্ড অর্ডারস (১ম খন্ড) এর ১১নং বিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মামলার পক্ষগণ আরজি, বর্ণনা, দরখাস্ত ইত্যাদি এবং এফিডেভিট ইংরেজী ভাষায় দাখিল করিবেন।
সংবিধানের ১৫৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাটা প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ বাংলাকে সর্বোচ্চ মযার্দা দেয়া হয়েছে। আদালতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন করতে হলে উক্ত আইন সমূহের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং প্রয়োজন মত নতুন আইন, বিধি ও বিজ্ঞপ্তি জারী করা আবশ্যক।
এরশাদ সরকারের আমলে বাংলায় আইন প্রণয়ন শুরু হয়। বর্তমানে পার্লামেন্টের আইন সমূহ বাংলায় পাশ হয়। সাথে সাথে এগুলোর ইংরেজী ভার্সন ও প্রকাশ করা যেতে পারে। বিশিষ্ট গবেষক মতিউর রহমান ফ্য়সাল বলেন, কোন সীমাবদ্ধতা না থাকলে বাংলাদেশ বিচার বিভাগের উভয় বিভাগের নিয়োজিত বিচারপতিরা বাংলা ভাষী হওয়া সত্তেও বাংলায় রায় দেয়াটাকে তাদের মানসিকতা বলা হচ্ছে কেন? বাংলা ভাষার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করলে উভয় পক্ষের বিচার প্রার্থীদের বক্তব্য প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরা সহজ হবে। বলা হয়ে থাকে, রায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পুণ আইনি শব্দ বিদেশি হওয়ার কারণে ইংরেজিতে রায় দেয়া হয়। যে শব্দ গুলোর বাংলায় রুপান্তর করা যায় তা কেন এখন পর্যন্ত বাংলায় বলা হচ্ছে না। আইনগুলো ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় রুপান্তর করার কাজ শুরু করলে বিচার অঙ্গনে বাংলা প্রচলন সহজ হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতে তাদের নাগরিকদের বোঝার জন্য তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করা হয়। যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের উচ্চ আদালতে বিচার কাজ চলে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায়। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে।
অন্যদিকে সংবিধানের, বহু জায়গায় বাংলা শব্দের ভুল বানান পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। যেমন : প্রস্তাবনায় `খ্রীষ্টাব্দ` ও `আশী` শব্দ দু`টি। অথচ এদের প্রকৃত বানান হলো: `খ্রিস্টাব্দ`, `আশি`। বিভিন্ন পার্টনারশিপ ফার্ম, ট্রাস্ট, ব্যাংক কোম্পানির দলিলপত্র, চুক্তি, নোটিশ, চার্জ ডকুমেন্ট, জামিন ফর্ম, ইত্যাদি ইংরেজীতে ড্রাফ্টিং এর কারণে সংশ্লিষ্টরা বুঝবেনা কোথায় তিনি স্বাক্ষর করলেন। তিনি এর অর্থ বুঝলে হয়তো কখনও স্বাক্ষরই করতেন না। বুঝে স্বাক্ষর করা আর না বুঝে স্বাক্ষর করা এক কথা নয়। এই ধরণের কর্মকাণ্ড তথ্য অধিকার আইন বা তথ্য জানার সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইংরেজি জরুরি হলেও দেশের অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ক্ষেত্রে ইংরেজি একেবারেই জরুরি নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ সব ধরনের লেনদেন, ডকুমেন্ট ও আদেশ-নির্দেশ বাংলা ভাষায় হওয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকে সীমিত আকারে বাংলা ভাষার ব্যবহার চললেও অনেক ব্যাংকের কার্যক্রম চলছে ইংরেজিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না। বরং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিতেও বাংলা ভাষা উপেক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব বিভাগের নামই রাখা হয়েছে ইংরেজিতে। ব্যাংকটির প্রজ্ঞাপন জারি থেকে শুরু করে অধিকাংশ প্রতিবেদন ইংরেজিতে তৈরি করা হয়। ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয় ইংরেজিতেই। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বাংলার প্রচলন না থাকার কারণে সাধারণ মানুষকেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এ নিয়ে। কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাইলে তাকে কয়েকটি ইংরেজি ফরম দেওয়া হয়। স্বল্পশিক্ষিতদের পক্ষে এটা পূরণ করা সম্ভব নয়। এসব ফরমে ২০টিরও বেশি স্বাক্ষর দিতে হলেও সেখানে কী কী শর্ত লেখা থাকে, তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। ব্যাংক খাতে লেনদেনের অন্যতম ঋণপত্রের (এলসি) আবেদন, ঋণ বা বিনিয়োগ আবেদন, আমানত জমাপত্র বা ভাউচার, লকারে সম্পদ রাখার আবেদন ফরম, চেক বইয়ের জন্য আবেদনপত্র, চেক বই, টাকা স্থানান্তরপত্র, আরটিজিএস ফরম এবং বিভিন্ন স্কিমের আবেদনপত্রও ইংরেজিতে লেখা। ব্যাংকগুলোর ওয়েবসাইটেরও একই অবস্থা। প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ওয়েবসাইটে যাবতীয় তথ্য লেখা থাকে ইংরেজিতে। ব্যাংকের পরিচিতি, বিভিন্ন ঋণপণ্য ও আমানতের তথ্যও থাকে ইংরেজিতে। যদিও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ব্যাংকগুলোতে প্রতিটি কাগজপত্র তিনটি ভাষায় লেখা হয়। ব্যাংকের শাখা যে রাজ্যে, সেই রাজ্যের নিজস্ব ভাষার পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা থাকে সবকিছু।
আমি মনে করি ‘এ খাতে বাংলা ভাষার প্রচলন বৃদ্ধি করা গেলে আমাদের মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সর্বসাধারণের জন্য সহজতর হয়ে দাঁড়াবে।‘ মহান ভাষাদিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করেন বিচারপতি এবাদুল হক। এর পর বিচারপতি আব্দুস সালাম ও বিচারপতি খায়রুল হক বাংলা ভাষায় জাজমেন্ট প্রদান করে উচ্চ আদালতে বাংলাভাষার মর্যাদাকে সু-উচ্চে তুলে ধরেন। উচ্চ আদালতে সর্বাধিক বাংলাভাষায় জাজমেন্ট দিয়ে অমর হয়ে আছেন চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান শ্রদ্ধেয় বিচারপতি আব্দুস সালাম মামুন। অন্যান্য বিচারপতিরা এ ধারা কে শাণিত করতে বিরাট অবদান রাখাতে পারেন। বর্তমানে আইন মন্ত্রনালয় বাংলাদেশ কোড এ ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় যুগপৎ ভাবে আইন প্রকাশ করে মাতৃভাষায় আইন চর্চার পথকে অনেক সুগম করেছে। কিন্তু ‘ল জার্নাল সমূহ (ডি,এল,আর/ বি,এল,ডি/ ল ক্রনিক/ এম,এল,আর/ বি,এল,সি/ বি,এল,টি প্রভৃতি) এখনও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভার্সন পুরোপুরি চালু করতে পারে নি। ফলে মাতৃভাষায় আইন চর্চা চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বাংলা ভাষায় সকল আইন রচনা ও প্রকাশ করতে হবে। ভালো ইংরেজী জানা অনেক সিনিয়র আইনজীবীকে দেখেছি যারা সুন্দর বাংলায় আর্জি/ জবাব লিখতে পারেন না। এটা বাংলার প্রতি আবহেলা ও উদাসিনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে পাণ্ডিত্য জাহির করতে ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকে গ্রহণ বা ইংরেজীর অধিক গুরুত্ব দিতে পারছেন না। সাধু চলিতের মিশ্রনে লিখা আর্জি/ জবাব দেখলে মাতৃভাষার প্রতি এত অবজ্ঞার কষ্ঠ সহ্য করা যায় না। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে ইংরেজীও জানা দরকার কিন্তু সর্বস্থরে মাতৃভাষাকে চালু করতে না পারলে বিশ্ববাসীরা এ ভাষাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে এগিয়ে আসবে না।
এখন থেকে বাংলায় গেজেট/ জাজমেন্ট/ রাষ্ট্রপতির আদেশ ইত্যাদি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে সাথে ইংরেজী ভার্সন প্রকাশ করা যেতে পারে। অতীতের সমস্ত গেজেট/ জাজমেন্ট ও দেশী বিদেশী আইন বইয়ের বাংলা অনুবাদে আইন অঙ্গন ভরে দিতে হবে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সর্বস্থরে বাংলা ভাষা চালুর নির্দেশ সম্বলিত এক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল। এর পর অফিস আদালতে ব্যাপক সাড়া জাগে। বর্তমানে নিু আদালত সমূহে আরজি, বর্ণনা, দরখাস্ত, এফিডেফিট, হাজিরা ইত্যাদিতে বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে। বিচারকরা অনেকেই বাংলায় আদেশ ও রায় প্রদান করছেন। জেলা ও মহানগর আদালত সমূহও কিছু কিছু রায়, ডিক্রি, আদেশ বাংলায় দিচ্ছেন, যাদের সাধুবাদ জানানো যায়। বাংলা সাঁট লিপি বা ষ্টেনোর অভাবে এক সময় আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে প্রধান বাঁধা ছিল। বর্তমানে সে বাধা দূর হওয়া সত্বেও মাতৃভাষায় উচ্চ আদালতে ব্যাপক জাজমেন্ট দেয়া হচ্ছে না। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধান বিচারপতির সু-দৃষ্টি প্রত্যাশা করছি। আদালতে ব্যবহৃত ও বহুল প্রচলিত ফারসী ও ইংরেজী শব্দ সমূহের উদ্ভট বাংলা না করে সে গুলোকে চালু রেখে বাংলা অনুবাদ কার্য করা যেতে পারে। যেমন- এজাহার এজলাশ, পেশকার, সোলেনামা, নামজারী, জামিন, তলবানা, তপশীল, রিভিশন, হাজিরা, মুসাবিদা, এওয়াজ, মুনসী, সুরতহাল, আলামত ইত্যাদি শব্দ।
যেহেতু দীর্ঘ দিন ইংরেজী ভাষায় সবকিছু চালু ছিল আইন আদালতে দ্রুত বাংলা চালু এতো সহজ নয়। আইনজীবী, বিচারক, আদালত কর্মচারী, আইন ছাত্র, গবেষক ও শিক্ষক গণের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার মাধ্যমে আইন আদালতে মাতৃভাষা বাংলা চালু করা সম্ভব। এজন্যে গত ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাশ হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিচারক, আইনজীবী ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে এ ব্যাপারে একটি শক্তিশালী কমিটি করে আইন আদালতে বাংলা ভাষা চালুর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা চালু হোক এ প্রত্যাশা করছি।
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিষ্ট, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।