কাজী আশফিক রাসেল :
গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ড শুধু একটি অপরাধের ঘটনা না, এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের বর্তমান সংকটের এক নগ্ন প্রতিচ্ছবি। গত বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুর শহরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় এক নারীকে মারধরের ঘটনা তিনি মোবাইলে ধারণ করছিলেন। হামলাকারীরা ভিডিও মুছে ফেলতে বললে তুহিন নিজের পরিচয় দেন এবং অস্বীকৃতি জানান। এরপর পাশের একটি মার্কেটের সামনে প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
এই নির্মম দৃশ্য আমাদের সামনে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আসলে আমরা এখন কোন পথে এগুচ্ছি? গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর জনগণের নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত হয়েছে? আমরা কি তবে ধীরে ধীরে আবারও নৈরাজ্য ও অমানবিকতার আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছি ?একের পর এক এমন লোমহর্ষক ঘটনা কি সরকারের প্রতিশ্রুতি ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে? এখানেই মনে পড়ে চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের সেই অমোঘ বাণী। তাঁর এক শিষ্য একবার জানতে চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো কী? কনফুসিয়াস বলেছিলেন, খাদ্য, নিরাপত্তা এবং জনগণের আস্থা অর্জন। শিষ্য পুনরায় জানতে চাইলেন, দুর্যোগ মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে যদি কোনো কিছু উৎসর্গ করতে হয়, তবে সেটি কী? কনফুসিয়াস উত্তরে বলেন, খাদ্য বা নিরাপত্তা যদি বিসর্জন দিতেও হয়, তবুও জনগণের আস্থা যেন কখনও না হারায়।
গাজীপুরের সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস ঘটনো আমাদের দেখিয়ে দিল, আমরা সেই আস্থা হারানোর এক গভীর প্রান্তে পৌঁছে গেছি।
চব্বিশের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা ভেবেছিলাম, বাংলাদেশ এক নতুন সূর্যোদয়ের পথে হাঁটছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলের অবসানে খুন, গুম, অপহরণ ও দমননীতি থেমে যাবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে আসবে, আর নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হলেও তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে নিয়মিতভাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি এখনপর্যন্ত একটি সঠিক বিচারের উদাহরণ দাঁড় করাতে পেরেছে? উত্তর হবে – না।
বর্তমান সরকারের অধিকাংশ উপদেষ্টার কার্যক্রম দেখে মনে হয়, তারা যেন নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ও সুবিধা সুরক্ষিত রাখতে বেশি ব্যস্ত। নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হলে যে বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়, তা এড়িয়ে চলাই যেন তাদের কৌশল। আমরা দেখছি, গণমাধ্যম , প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সেক্টরের স্তরে স্তরে এখনও স্বৈরাচারী দোসররা বহাল তবিয়তে আছে। দুঃখজনকভাবে, এর দায় বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের যেমন, তেমনি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অবদান রাখা রাজনৈতিক দলগুলোরও। গোপন যোগসাজশ ও সুবিধাবাদী সমঝোতার মাধ্যমে পুরনো অপশক্তিগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এসেছে। সেই দীর্ঘস্থায়ী অপশাসনের ক্ষত শুধু অর্থনীতি, প্রশাসন বা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেনি,এটি মানুষের মনোজগতে সহিংসতার বীজও বপন করেছে। ফলে আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে বিরোধ নিষ্পত্তি, ক্ষমতা অর্জন বা প্রভাব বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সহিংসতা। মূলত দীর্ঘমেয়াদি অপশাসনই অনেকের মনোজগতে সহিংসতাকে এক ধরনের “সমাধানের পথ” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ক্ষমতার দাপটে থাকা রাজনৈতিক ছত্রছায়া অপরাধীদের জন্য হয়ে উঠেছে নিরাপত্তার ঢাল।
এই প্রবণতা রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভয়ংকরভাবে কলুষিত করেছে। ফলে গাজীপুরের ঘটনাও বিচ্ছিন্ন নয়, বরং একটি ধারাবাহিকতার অংশ।
বাংলাদেশে বিগত দশকেগুলোতে দেখা গেছে, অনেক অপরাধীই তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয় বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়েছে। তারা জানে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকলে আইনের হাত তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে না, কিংবা পৌঁছালেও শাস্তি কার্যকর হবে না। এই সংস্কৃতি কেবল ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে না, বরং অপরাধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
অপশাসন মানুষকে দুটি পথে ঠেলে দেয়; কেউ হয় নিস্তব্ধ পর্যবেক্ষক, কেউ হয় সহিংসতার অনুশীলক। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অহিংস প্রতিবাদের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার জন্য সহিংসতা যেন ‘অঘোষিত নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। এর ফলেই সমাজের প্রতিটি স্তরে সংঘাত ও প্রতিশোধের মনোভাব প্রোথিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য বড় দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদের নেতাকর্মীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও অহিংস আন্দোলনের শিক্ষা ফিরিয়ে আনা। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের মনোজগতে ভিন্নমতকে সম্মান করা, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং প্রয়োজন; যাতে তারা বুঝতে পারেন, সহিংসতা ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে না, বরং সমাজে অনিশ্চয়তা বাড়ায়। তা না হলে পুরনো সহিংস ও অপরাধপ্রবণ মানসিকতা দলীয় কাঠামোর মধ্যেই বংশবিস্তার করতে থাকবে। বাস্তবতা হলো, সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোতে প্রায় সব অপরাধীই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক ছত্রছায়াকে তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক পরিচয় বা পৃষ্ঠপোষকতা অপরাধীদের জন্য এক ধরনের ‘ইমিউনিটি শিল্ড’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংস্কৃতিকে ভেঙে ফেলতে না পারলে, ন্যায়বিচারের কোনো উদাহরণ দাঁড় করানো অসম্ভব হবে।
গাজীপুরের এই হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের গভীর অসুখের প্রতিফলন। এর সমাধান হবে তখনই, যখন জনগণের আস্থা পুনর্গঠন হবে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। আরেকটা শঙ্কাজনক দিক হলো, সাংবাদিকতা এমন এক পেশা, যা সত্য তুলে ধরে জনগণকে সঠিক তথ্য দেয় এবং ক্ষমতাকে জবাবদিহির মধ্যে রাখে। একজন সাংবাদিক নিহত হওয়া কেবল একজনের জীবনহানি নয়; এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত, জনগণের জানার অধিকারে হস্তক্ষেপ। যদি সাংবাদিকদের জন্য কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা না হয়, তবে দক্ষ ও মেধাবী তরুণরা এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ অকার্যকর হয়ে পড়বে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়লে গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে যায়। তাই বলবো, এখনই সময়, অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রমাণ করুক,তারা সত্যিই জুলাইয়ের চেতনার উত্তরাধিকারী। নইলে এই সরকারও ইতিহাসের চোখে স্বৈরশাসনের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই গণ্য হবে।
লেখকঃ হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট ও তরুণ কলামিস্ট ।