মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
*********
( প্রথম পর্ব )
১৯৭০ সাল আমি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির রোসাংগিরি আরবানিয়া প্রাইমারী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ভোটের হাওয়ায় উত্তাল দেশ এবং দেশের মানুষ ভোটযুদ্ধে আন্দোলিত, উদ্বেলিত। সারা দেশ প্রচার প্রচারণায় সরগরম। আমার বাবা, চাচারা, ভাইয়েরা এবং বাড়ীর ছোটবড় সবাই ভোট নিয়ে ব্যস্ত। বড়দের পাশাপাশি আমার উৎসাহের যেন কোন কমতি নেই। অনেক মিছিল মিটিংয়ে আমিও সবার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের এলাকার এম পি পদে লড়েছিলেন মীর্জা আবু মনসুর এবং ফটিকছড়ি এবং মিরেরশ্বরাই এলাকা থেকে এম এন এ পদে ফজলুল হক বিএসসি। ভোটের তারিখ, মাস আমার এখন আর মনে নেই। তবে ভোটের দিন আমার বাবারা আমাদের পরিবারের সকল ভোটার এবং এলাকার পর্দানশীন মা-বোনদের নিয়ে একটা বিরাট নৌকায় চড়ে রোসাংগিরি হাই স্কুলের ভোট কেন্দ্রে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। এবং সঙ্গে আমিও ছিলাম। আমার মেঝদাদা জনাব মোহাম্মদ শহীদুল আলম চৌধুরী (বেবি) শহর থেকে অনেকগুলি পোস্টার নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর, ভোটের এবং পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন ইত্যাদি। পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন ? ছোট বড় সকল মানুষের মনে সেই পোস্টারটা খুব দাগ কেটেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দামের বিশাল হেরফের দেখে। ১২ হাজার মাইলের তফাতের দুই পাকিস্তানের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্য মূল্য ছিল পশ্চিমের চেয়ে অনেক বেশী যা মানুষের মনে ক্ষোভ, ঘৃণা এবং দুঃখের সঞ্চার করে। একদিন বিকালে রোসাংগিরি হাইস্কুলের বিরাট মাঠে ছিল নির্বাচনী মিটিং। তবে কোন মঞ্চ ছিল না। সারিবদ্ধভাবে চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা প্রতীকের প্রার্থী জনাব মীর্জা মনসুর। এবং আমার বাবারা তিন ভাই ( আমার মেঝবাবা মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত ১৩ নম্বর রোসাংগিরি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান)ও বসেছিলেন অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে। আর শ্রোতারা সবুজ ঘাসে সারিবদ্ধভাবে বসে খুব ধৈর্য সহকারে পাকিস্তানীদের অন্যায় জুলুমের কথা শুনছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন সংগ্রাম কারাবরণের বিভিন্ন ঘটনার কথা শুনছিলেন। বিরাট মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় আমিও সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের একজন ক্ষুদে দর্শক ছিলাম। বলা যায় ইতিহাসেরও সাক্ষী। আরেকদিন রাতে সমিতির হাট বাজারে মিটিং ছিল। বড়দের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। সেখানে মীর্জা মনসুরের পিতা শিল্পপতি মীর্জা আবু বক্তৃত্বা দিয়েছিলেন। ভোটের একদিন কি দুইদিন আগে এক বিরাট মিছিল বের হয় যা ছিল কয়েক মাইল লম্বা এটি পুরো রোসাংগিরি ইয়নিয়ন প্রদক্ষিণ করে। সেই মিছিলে কয়েকজন মানুষের কাঁধে ছিল মাইক। মাইকে জয় বাংলা, আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব সহ বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। আমি নিজেও জানিনা আমি সেই ছোট্ট শিশুটি কত মাইল পায়ে হেটেছি।
১৯৭১ সাল আমি গ্রাম ছেড়ে লেখাপড়ার জন্য শহরে আসি আমার বড় ভাই মোহাম্মদ ফরিদুল আলম চৌধুরীর ভাড়া বাসায়। সেটি ছিল দেওয়ান বাজার সিএন্ডবি কলোনীর সামনে বশর বিল্ডিং। আমার চাচারা গুরা মিয়া চৌধুরী লেইনে অবস্থিত শহরে আমাদের পৈত্রিক বাসায় বসবাস করতেন। শহরে এসে আবারো আমাকে সেই চতুর্থ শ্রেণীতেই ভর্তি করিয়ে দেন আমার সেঝ ভাই মরহুম আকতারুল আলম চৌধুরী (বাবু)। তিনিও ঐ স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের একাদশ/দাদ্বশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সাল ছিল এদেশের ইতিহাসের জাতীয় রাজনীতির আন্দোলন আর সংগ্রামের সর্বপোরি বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনসহ একটি ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক বছর। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন সহ নানানমুখী মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। অসহযোগ আন্দোলনের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে আমি বাবা মায়ের কাছে গ্রামে চলে যাই। আমাদের বাড়ির নাম হচ্ছে, আরবান আলী সওদাগর বাড়ী, পূর্ব ধলই, হালদার কুল, ১৩ নম্বর রোসাংগিরি ইউনিয়ন, থানা- ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম। স্বাধীনতার পর সাবেক রোসাংগিরি ইউনিয়ন ২টি ইউনিয়নে বিভক্ত হয়। একটি আগের ১৩ নম্বর রোসাংগিরি আরেকটি ১৯ নম্বর সমিতির হাট ইউনিয়ন। বর্তমানে আমরা সমিতির হাট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য, বর্বর, নিষ্ঠুর, পৈশাচিক এবং মানবতা বিরোধী হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চ সকাল থেকেই চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের গুলির আওয়াজ আমরা গ্রাম থেকে শুনতে পাই। তখন সারাদেশে কি হচ্ছে তার খবর পাওয়া ছিল অনেক কষ্টকর, দুরূহ, দুঃসাধ্য ব্যাপার। টেলিগ্রাম ছাড়া টেলিফোন বা ট্র্যাঙ্ককলের খুব একটা ব্যবস্থা বা ব্যবহার ছিলনা। ২৬ ও ২৭ মার্চ গ্রামের মুরুব্বী, যুবক কিশোরদের পাশাপাশি আমরা অনেক শিশু বিভিন্ন ঘরে ঘরে গিয়ে চাল ডাল তরি-তরকারি সংগ্রহ করতে থাকি ক্যান্টমেন্টে বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপির সহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের জন্য। ইতোমধ্যে শহর থেকে আমাদের ভাই চাচারা সহ অনেক আত্মীয় স্বজন ফুফুরা গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নিতে ছুটে আসে। হালদা নদী ছিল তখন খুব খরস্রোতা একটি নদী। শহর থেকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী তখন হালদা নদী দিয়ে বিরাট বিরাট নৌকার মাধ্যমে আনা নেয়া হতো। এবং এই নদী দিয়ে বিভিন্ন ছোট বড় নৌকার মাধ্যমে হিন্দু মুসলিম পরিবারগুলো শহর থেকে নিজেদের গ্রামে বা ভারতে আশ্রয় নেয়ার জন্য ছুটে যেতে থাকে। আমাদের এলাকার এবং পরিবারের লোকজন অনেক নৌকা থামিয়ে তাঁদের অনেককেই মুড়ি, চিড়া, গুড়, আবার অনেকেই ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক, ছাত্র আমাদের বাড়িতে রাত যাপন এবং খাওয়া দাওয়া শেষ করে দিনে ফটিকছড়ির খিরাম সহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করতে থাকেন। তাঁদের মধ্য আমাদের আত্মীয় কবি ও লেখক শওকত হাফিজ খান রুশনী এবং তার ছোট ভাই ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু (সি এন্ড সি, স্পেশাল / হাটহাজারী) ভাইয়ের ভার্সিটির বন্ধুরা সহ অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছেন।
( ২য় পর্ব )
২৬ মার্চের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের আত্মীয় স্বজন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আসতে থাকেন। আওয়ামী লীগ সীতাকুণ্ড থানার তখনকার সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার ছোট ফুফা জনাব ডাঃ এখলাস উদ্দিনের পরিবার উনি ভারতে চলে যাওয়ায় আমাদের বাড়ীতে চলে আসেন। আমার ফুফাতো বোন চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রওশন আক্তার হানিফ, তাঁর ছোট ভাই বর্তমান মা ও শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ মাহমুদ আহমেদ আরজুসহ তাঁর বোনেরা, আমার আরেক ফুফা তৎকালীন পিএইডি কর্মকর্তা ও লেখক সাংবাদিক খালেদ বেলালের পরিবার, আমার বড় ভাইয়ের মেঝভায়রা হামেদ শফিউল ইসলাম (প্রয়াত এডিশনাল সেক্রেটারি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার)’র পরিবার, আমার চাচাতো ভাইয়ের খালাতো বোনের স্বামী বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের নেতা বদরুদ্দোজা দুলাভাই সহ আরও অনেকেই আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। আমরা একঝাক শিশু কিশোর মিলে সারাদিন নানান ধরণের খেলায় মত্ত ছিলাম। একদিন সকাল সম্ভবত দশটার দিকে পাক আর্মি আসছে বলে সবাই বাড়ির পূর্ব দিকে অর্থাৎ সমিতির হাটের দিকে দৌড়াতে থাকি। পরে জানা যায় তা মিথ্যা। আমাদের বাড়ীর বিশাল উঠোন রাত পৌণে আটটা বাজলে সবাই বিবিসি রেডিও’র খবর শুনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন আশেপাশের বাড়ীর ছোটবড় সবাই। আবার রাত দশটায় ভোয়া বা ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনতেন তবে এখানে শুধু পাকিস্তানের খবরই বেশি প্রাধান্য পেতো। কিন্তু বিবিসি রেডিও ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এবং সকল খবর জানার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এদিকে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমার ছোট ফুফার সীতাকুণ্ড থানার বহরপুরস্থ গ্রামের বাড়ী পাক বাহিনী এবং এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদররা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
মার্চের ২য় সপ্তাহ থেকে গুল মোহাম্মদ চৌধুরী বাড়ীর নুরুল আবছার চৌধুরী ও পূর্ব ফরহাদাবাদের দবিরুল আলম চৌধুরী প্রত্যেকদিন আমাদের বাড়ীতে আসতেন এবং বাবু দাদা ও জয়নুলের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ করতে দেখতাম। আমাদের বাড়ীর কাছারি ঘরে রক্ষিত পথিকদের জন্য রক্ষিত ডাল ভাত চারজনে মিলে খেয়ে বের হয়ে যেতেন। বাবু দাদা আর জয়নুল কখন ফিরতেন জানতাম না তবে তাঁদেরকে সকালে দেখা যেতো বাড়ীতে। এভাবে মে-জুন পর্যন্ত কেটে যায়। এরই মধ্যে আমাদের এলাকার বিভিন্ন বাড়ীতে সশস্ত্র বুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিতে শুরু করে। আমার ভাই বাবু স্থানীয় যুবকদেরকে সংঘটিত এবং উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমাদের গ্রাম ফটিকছড়ি থানার সাবেক রোসাংগিরি ইউনিয়নের বি ওয়ার্ড এবং বর্তমান সমিতিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । যা আমাদের এলাকার জন্য গর্ব, অহংকার এবং গৌরবের বিষয়। বিগত ২৪ আগষ্ট ১৯৭১ তারিখে আমার ভাই মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবুর নেতৃত্বে ১৩ জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে রওয়ানা দেন তাঁর দলের অন্যন্য সদস্যরা হলেন –সম্প্রতি প্রয়াত আব্দুল মান্নান, অতি সম্প্রতি প্রয়াত জহুর, আবুল কালাম, জয়নুল আলম ( ম্যানেজার), আহমেদ হোসেন বাবুল, আবুল হোসেন, নুরুল ইসলাম, ছালেহ জহুর, মোহাম্মদ মুসা, মরহুম সাইফুল আলম, রাশেদ এবং সোলায়মান। ভারতে গিয়ে আমার ফুফা ডাঃ এখলাস উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। পরে তিনি আমার ভাই প্রতিবেশী সাইফুল আলম, রাশেদ, জয়নুল আলম এবং ফুফার ছোট ভাই সরোয়ার কামাল দুলাল মামাকে শেখ ফজলুল হক মণির বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীতে যুক্ত করে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত টান্ডুয়া ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষ্ণের জন্যে পাঠিয়ে দেন। বাকীদেরকে আসামের লোহার ক্যান্টনমেন্ট এবং লায়লপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। কিছুদিন আগে আমার ফুফা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, যখন আমি বাবু আর দুলুকে বিদায় দিচ্ছিলাম তখন আমার পকেটে ছিল ভারতীয় মাত্র ১৪ টাকা। তাঁদের দুইজনকে ৬ টাকা করে দেয়ার পরে আমার কাছে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২ টাকা। আমার অন্তরে খুব দুঃখবোধ হচ্ছিল আমার ছোট ভাই আর ভাগ্নেকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্য করতে পারছিলাম না বলে। আমার ভাইদের ভারতে গমনের পরে আমাদের পরিবারের কিছু অংশ শহরে চলে আসে। পাশাপাশি আগষ্ট মাসের শেষের দিকে একদিন খুব ভোরে আমাদের বাড়ী পাক আর্মিরা হালদার পাড় থেকে চারিদিকে এক মাইল ব্যাসার্ধে ঘিরে ফেলে। ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় এলাকার কিছু মানুষকে বাঁধা দেয়া হয়। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমার ভাইসহ এসব যুবকদের যদি পাক বাহিনী ধরে ফেলতো তাহলে সেদিন তাঁরা আদৌ জীবিত থাকতো কিনা সেটা সবার ভাবনার এবং আলোচনার বিষয় ছিল। প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাড়ী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রানজিট পয়েন্ট এবং আস্তানাও বটে। পাশাপাশি পেশায় শিক্ষক সূচি বাবু নামক মুক্তিযোদ্ধের এক সংঘটক আমাদের বাড়ীতে শিক্ষকতা করতে আসতেন এবং আমাদের বাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, এলাকার কোথায় কি ধরণের অপারেশন হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের কোন দল রাত্রি যাপন করবে, রাতে তাঁদের কত জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সবকিছু আমার মেঝবাবার সঙ্গে প্রতিদিন আলাপ করে যেতেন। আমার মেঝবাবার দাড়ি / চুল কাটার জন্য রায়মোহন শীল নামে একজন নাপিত সপ্তাহে ২/১ বার আমাদের বাড়ীতে আসতেন। রায়মোহন শীল একজন সনাতন ধর্মাবলী ছিলেন সে কারণে হয়তবা অনেক সময় কিছু আলাপ তাঁর সম্মুখে হতো। আমার মেঝ চাচা চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিলে নুরুল ইসলাম চৌধুরী চেয়ারম্যান হন। আবার তিনি ছিলেন মুসলিম লীগের সমর্থক। আমাদের আত্মীয় হলেও এলাকার প্রভাবশালী দানা মিয়াঁ চৌধুরী এবং ইসলাম চৌধুরী আমার বাবাদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন। এই সুযোগে চেয়ারম্যান ইসলাম চৌধুরী মুসলিম লীগ নেতা ফজল কাদের চৌধুরীর কাছে আমাদের বাড়ীর সকল তথ্য-উপাথ্য জানান। রায়মোহন শীল সূচী বাবুর আমাদের বাড়ীতে আগমন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কথা ইসলাম চৌধুরীকে জানান। আমার দাদা ১৯৫২ সালের ৮ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসেবে একাত্তরের আগষ্টের সুবিধাজনক এক রাতে আমরা বাবারা দাদার একটা ছোট ইছালে ছওয়াবের আয়োজন করেন যেখানে আমার বড় ভাই, মেঝ ভাই ফুফাতো ভাইয়েরাসহ শহর থেকে অনেক আত্মীয় স্বজন, বাড়ীতেঅবস্থানরত আত্মীয়রাসহ মুক্তিবাহিনীর কিছু সদস্যও রাতে উপস্থিত ছিলেন। রায়মোহন শীল সেটা ইসলাম চৌধুরীর কানে পৌঁছিয়ে দেয় আর ইসলাম চৌধুরী ফজল কাদের চৌধুরী জানায় আপনার বন্ধু আব্দুল লতিফ চৌধুরী মুক্তিবাহিনীকে মেজবান প্রকাশ্যে মেজবান খাওয়াচ্ছেন। সঙ্গত কারণে বিপুল সংখ্যক আর্মি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আর গোলা বারুদে সুসজ্জিত হয়ে বিরাট এবং দীর্ঘস্থায়ী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পাক আর্মিরা এসেছিল। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের ইচ্ছা, ঐদিন রাতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আর অস্ত্র বা গোলা বারুদ আমাদের বাড়ীতে ছিল না এবং আগের দিন রাতে আমাদের বাড়ীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অস্ত্র এবং গ্র্যানেড নিয়ে যায়। শিশু এবং নারী ছাড়া আমার বাবা এবং আশেপাশের সকল পুরুষদেরকে হালদা নদীর চরে নিয়ে যায়। সবাইকে জিজ্ঞেস করতে থাকে মুক্তি কাহা হ্যাঁয় ? আব্দুল লতিফচৌধুরী এবং শহীদুল আলম চৌধুরী বেবি কোন হ্যাঁয় ? এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমার মেঝবাবা সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ চৌধুরী মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরীর বন্ধু এবং বেবি হচ্ছেন আমার মেঝভাই। আমাদের পুরো পরিবারটাই হল আওয়ামী লীগের সমর্থক। পাশাপাশি ১৯৭০ এর নির্বাচনে আমার ছোট বাবা হালদা নদীর উপরে একটা নৌকা বানিয়ে ঝুলিয়েছিলেন। গ্রামের জামাতা জনাব হানিফ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য। তিনি প্রাণে বাঁচার জন্য নিজেকে ইপিআর সদস্য পরিচয় দিতে থাকেন এবং পাকিস্তানের কোথায় ছিলেন তার বর্ণনাও দিতে থাকেন বারবার যা তাঁর জন্য পরবর্তীতে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। মরহুম জলিল মিয়াঁর এক পুত্র মাহাবুব আলম চট্টগ্রাম ওয়াসায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর অপ্রকৃতিস্থ ভাই আগের দিন ঝগড়ার এক পর্যায়ে বসার পিঁড়ি দিয়ে তাঁর নাকে আঘাত করে যাতে পাক আর্মিরা তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সন্দেহ করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানতে চায় তাঁর কাছ থেকে। পাশাপাশি জনাব হানিফের কাছে জানতে চায় কয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এদিকে দশটার দিকে আমার বাবাসহ গ্রামবাসীদেরকে হাতে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে প্রায় ৭ মাইল পায়ে হাটিয়ে ফটিকছড়ির সেনা ক্যাম্পে নেয়া হয়। সেখানে দুপুরে সবাইকে মোটা দুইটা রুটি এবং ডাল দেয়া হয় দুপুরের খাবার হিসেব। পাশাপাশি আমার বড় দাদা মোহাম্মদ ফরিদুল আলম চৌধুরী তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংকের অফিসার ছিলেন। সে কারণে তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানীদের যোগাযোগ ছিল। পাশাপাশি শিক্ষানুরাগী মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর বড় ছেলে আমার ফুফাতো ভাই আবুল হাসনাত চৌধুরী খসরু তখন হাবিব ব্যাংক লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন এবং তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হওয়ায় তাঁর সঙ্গে বেশ কিছু পাক আর্মির কিছু অফিসারের পরিচয় ছিল। আরেক ফুফাতো ভাই চট্টগ্রাম নিউ মার্কেটে অবস্থিত ফটোরমার মালিক বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার মর্তুজা তৌফিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীর ফটোগ্রাফার নিয়োজিত ছিলেন তিনি এবং আমার বড় দাদার বাসা বশর বিল্ডিংয়ের ৩য় তলায় বসবাস করতেন অবাঙ্গালী জনাব হাসেমি সাহেব যিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কে সি দে রোড শাখার ম্যানেজার ছিলেন। তাঁদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার বাবা এবং গ্রামবাসীরা সন্ধ্যায় ছাড়া পান। শুধু মাত্র সবেক ইপিআর সদস্য হানিফ এবং মাহবুব আলম ছাড়া পাননি। তাঁদেরকে কোথায় কিভাবে হত্যা করা হয়েছে অদ্যাবধি তা কেউই জানেনা।
( ৩য় পর্ব )
আমাদের বাড়ীতে যে পাক আর্মিরা এসেছিল তাঁরা ছিল বেলুচ রেজিমেন্ট। মাত্র দুইজন ছিল পাঞ্জাবী। বাড়ীর শিশু এবং মহিলাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে পুকুরের পূর্ব পাড়ে সবাইকে বসিয়ে রাখা হয়। আর এদিকে সারা বাড়ী তন্নতন্ন করে তল্লাশি করা হয়। কাছারি, থাকার ঘর, রান্নাঘর, গরুর গোয়াল ঘরসহ সবকিছু। বিকেল হয়ে যায় কিন্তু কোনো অস্ত্র এবং গোলা বারুদ কিছুই পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি সেদিন সৌভাগ্যক্রমে কোনো মুক্তিবাহিনী না থাকায় কোনো প্রতিরোধ, বাঁধা বা যুদ্ধেরও সম্মুখীন হতে হয়নি পাক সেনাদের। আগুন ধরিয়ে দেয়ার জন্য বাড়িতে গান পাউডার ছিটানোর অর্ডার দেন ঐ দলের নেতা ক্যাপ্টেন সাহেব। কিন্তু আমার মেঝা আপা খুব সাহসের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মুখোমুখি হয়ে বলেন, এখানে মুক্তিবাহিনী নেই, অস্ত্র নেই, আমরা নিরীহ মানুষ। আমাদের ঘরটা জ্বলিয়ে দিলে আমাদের কি অবস্থা হবে। আমরা এতোগুল মানুষ কিভাবে রাত কাটাবো। পাশাপাশি বাড়ীর সবাই অবিবাহিত মেঝ আপার জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সবাই আল্লাহ্কে ডাকতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন সাহেব ফজল কাদের চৌধুরিকে অবহিত করেন অস্ত্র, গোলা বারুদ না পাওয়া এবং মুক্তিবাহিনীর কোনো সদস্যকে না পাওয়ার বিষয়গুলো। পরবর্তীতে কোনো ধরণের অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে পাক বাহিনী নৌকা যোগে বিদায় হয়ে যায়।
আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়ার পরেই পরিবারের কিছু অংশ আমরা এবং যারা চাকুরীজীবী ছিলেন তাঁরা শহরে আমার বড় ভাই মোহাম্মদ ফরিদুল আলম চৌধুরীর বাসা বশর বিল্ডিঙয়ে চলে আসি। ঘরের জানালার গ্লাসগুলোতে আটা দিয়ে ব্রাউন পেপার লাগিয়ে দেয়া হয় যাতে ঘরের আলো বাইরে না যায়। বাড়ীতে পাক বাহিনীর অভিযানের পরে পরিবারের অবশিষ্ট সদস্য এবং বাড়ীর উত্তর পার্শ্বের বেশ কিছু প্রতিবেশী আমার বড় দাদার বাসায় চলে আসে। ছোট বড় মিলে প্রায় ৬০ জনের মতো মানুষ সেখানে ছিল। রাতের বেলায় আমরা ছোটরা বড় দাদার তিন তলার প্রতিবেশী অবাঙ্গালী হাসেমী সেহেবের বিশাল ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে বিছানা পেতে ঘুমাতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যা বা রাতে আমরা রাইফেলের গুলির আওয়াজ পেতাম। তখন বুঝা যেতো মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের অপারেশন হচ্ছে। সবাই ভেতরের রুমে গিয়ে রেডিওতে লো ভলিউমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম। সবার অধীর আগ্রহ ছিল এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। তাছাড়া বিভিন্ন দেশাত্মমূলক গান, বিদ্রোহী কবি নজরুলের গানসহ বিভিন্ন রণ সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো। ২৮ নভেম্বর আমাদের পরিবারের ওপর নেমে আসে আরেক দুর্যোগ। আমার মেঝভাই এবং ৪৯ চন্দনপুরাস্থ অরোরা প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শহীদুল আলম চৌধুরী বেবিকে চান্দগাঁও থানার সাবেক এম পি হারুন উর রশীদ খান মামাসহ বোস ব্রাদার্সের পশ্চিম দিকের ক্যাফে দেহলভী থেকে মীর কাশেম আলীর আলবদর বাহিনী ধরে ডালিম হোটেলে বন্দী করে ফেলে। সেখানকার এক ফল বিক্রেতার মাধ্যমে আমরা তা জানতে পারি। বেবি ভাইয়ের অরোরা প্রিন্টার্স ছিল মুক্তিবাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধের সংঘটকদের মিলনস্থল। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন লিফলেট, ছোট পোষ্টার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন লেখা এই প্রেসে ছাপিয়ে যেতেন। মুক্তিযুদ্ধের অনেক সংঘটক, মুক্তিযোদ্ধা সেখানে জমায়েত হতেন। শুনেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ মাহফুজুর রহমানও সেখানে যেতেন। যারা সেখানে যেতেন তাঁরা যদি এ লেখা প্রকাশের পরে তাঁর যুদ্ধের সময় তাঁর অবদান সম্পর্কে কিছু জানেন তবে আমাদেরকে বা পত্রিকায় লিখে জানাবেন। পরিবার হিসেবে আমরা আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো। ডালিম হোটেলের আলবদর বাহিনীর টর্চার সেল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য আমাদের পরিবার থেকে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে ডিসেম্বর মাসের ৭/৮ তারিখের দিকে মেঝ দাদাকে মুক্ত করা হয়। যখন তাঁকে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছিল তখন শরীরের বিভিন্নস্থানে নির্যাতনের ব্যাথায় তিনি কুঁকড়ে উঠছিলেন। তাঁকে অমানুষিক, বর্বর, নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। অবচেতন বা বেহুশ না হওয়া পর্যন্ত আল বদর বাহিনী তাঁকে নানানভাবে শারীরিক নির্যাতন করতো বলে পরে তিনি জানান। তিনি ছিলেন টকটকে ফর্সা। যখন তাঁর গায়ের শার্ট আর গেঞ্জি খোলা হয় তখন বাসায় করুণ এবং হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে রডের আঘাতে রক্ত জমাট বাঁধা কালো দাগ সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে । তাঁর শরীরের কোথোও হাত দেয়া যাচ্ছিল না। যেখানেই হাত লাগায় সেখানেই তিনি ব্যথা অনুভব করতে থাকেন। পরে ডাক্তার এনে বিভিন্ন ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ এবং মলম লাগানো হয়। বিভিন্ন ঔষধ দেয়া হয়। হারুণ খান মামা মুক্ত হন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য আমার মেঝ ভাই এবং হারুন মামা মুক্তিবাহিনীর জন্য ঔষধ, রসদের জন্য টাকা পয়সা সংগ্রহ করতেন। তাঁরা দুইজন কয়েকবার ভারত আসা যাওয়াও করেছেন টাকা আর ঔষধ পত্র নিয়ে। হারুন মামা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিলেও আমার মেঝ ভাই নেননি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই সার্টিফিকেট না নেওয়ার কারণে তাঁর মৃত্যুর সময় আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনারও নেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধার সুযোগ সুবিধা ভোগ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
( চতুর্থ পর্ব )
নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এবং ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের ভয়াবহতা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। মিত্র বাহিনী ভারতীয় যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা ছোঁড়া হতে থাকে। ইস্টার্ন রিফাইনারীসহ বিভিন্ন তেল ডিপোতে ভারতীয় বিমান বাহিনী আকাশ থেকে বোমা ছুঁড়ে তেল ডিপোগুলো ধ্বংস করতে থাকে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। এমতাবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমাদের ফটিকছড়ির রোসাংগিরির গ্রামের বাড়ীতে সবাই ফিরে যাবো। আমাদের সব আত্মীয় স্বজন মিলে প্রায় ৭০/৮০ জনের বহর বাসে মদুনাঘাট হয়ে হালদা নদীতে বিরাট নৌকায় উঠি। নৌকা চলতে থাকে। রাউজানের কাছাকাছি এসে ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাড়ীর দিকে আর্মি এবং রাজাকার আলবদরদের চেক পোস্ট থাকায় আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে পড়ি। কেননা আমার মেঝবাবা এবং মেঝভাইয়ের জন্য এলাকাটা ছিল খুবই বিপদজনক। তাছাড়া তাঁদেরকে চিনতে পেরে ধরে ফেল্লে ছাড়ানোর কোনো উপায়ন্তরও তখন ছিল না। রাউজনের ফজল কাদের চৌধুরীর বাড়ী থেকে দূরের পথ দিয়ে ঘুরে আবার নৌকাতে উঠি। আমারা বিকালের দিকে যখন পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আকাশে ভারতীয় বাহিনীর বিমান উড়তে দেখা যায়। আমরা সবাই দৌড়াতে থাকি। আমার ফুফাতো ভাই তৌফিক ভাইয়ের স্ত্রী আমার ছোটবাবাকে বলেন ভাই আমার মেয়েকে নিয়ে আর দৌড়াতে পারছি না, ওকে একটু খোলে নেন। আমার ছোটবাবা তাকে খোলে নিয়ে নেন। সারাটাদিন নৌকায় আর হেঁটে রাতে আমরা অনেক কষ্টে বাড়ীতে এসে পৌঁছাই। পরের দিন আমার ছোটবাবার ঘরে উনাকে দেখে তৌফিক ভাবী আমার বড় ভাবীকে জিজ্ঞেস করেন উনি কে ? আমার ভাবী জানান উনি আপনার মামা শ্বশুর। কি বলেন ভাবী ? কাল আমি তো আমার মেয়েকে খোলে দেয়ার জন্য উনাকে ভাই বলে সম্বোধন করেছি। সবাই এটা নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করেন।
অবশেষে ঘনিয়ে আসে দেশ ও জাতির সেই মহেদ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ক্ষণ। সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে আনন্দিত হয়ে উঠে। আনন্দ মিছিল করতে থাকে। পাশাপাশি গ্রামবাসী অধীর আগ্রহ রাতের বিবিসি’র বাংলা খবর শোনার জন্য। বাড়ীর মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সঙ্গে বাজতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমার সেঝ ভাইসহ বিএলএফ’এ অংশগ্রহণকারী এলাকার চারজন মুক্তিযোদ্ধা তখনও ফিরে আসেনি। পরে ১৯ ডিসেম্বর যোহরের আগে আমার ভাই এবং সহযোদ্ধারা বাড়ীতে ফিরে আসে। জানা যায়, মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দল হিসেবে ছিল আমার ভাইদের বিএলএফ বাহিনী। তাঁরা আকাশ পথে আসামের দিমাগ্রী বর্ডার হয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয়ে রাঙ্গামাটিতে প্রবেশ করার পথে ১৭ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ফারুয়া এলাকায় পাক আর্মি এবং মিজোদের একটি দলের সঙ্গে অতর্কিত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমার ভাই মিজোদের হাতে ধরা পড়ে যান কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন। পরে রাতে কাপ্তাই হয়ে ১৮ তারিখ সকালে চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন। তাঁদের ঘাটি ছিল চট্টগ্রাম সিটি কলেজে এবং তাঁদের কামান্ডার হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। দেশ ১৬ তারিখ স্বাধীন হলেও তাঁদের ফিরে আসায় সবার সেকি আনন্দ। তাঁর পরনে জল্পাই কালারের মোটা ফ্লানেল শার্ট, কাপড়ের জুতা, ছাই কালারের হাফ হাতা সুয়েটার। জুতা খোলার পরে দেখা গেল পায়ের আংগুল ছিঁড়ে গেছে। অথচ তাঁর এসব অনুভবও হয়নি। আমাদের বাড়ীতে যখন আর্মিরা এসেছিল তখন তিনি ভারতে চলে যাওয়ায় বেঁচে যান। যুদ্ধ করতে করতে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনেন। তারপরেও আমার বাবু ভাই বাঁচতে পারেননি ভুল এবং অপ-চিকিৎসার কারণে নিজেদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। হয়তবা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর হায়াত এতটুকুই রেখেছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ ইং তারিখ রাত আড়াইটার দিকে ভেজাল ইঞ্জেকশান পুশ করার কারণে তিনি স্থানীয় একটি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর প্রয়াণের পরে তাঁর এক সহযোদ্ধা চৌধুরী এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার কাজীর যোগসাজশে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদকালে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করে দেয়। তাঁর আরেক সহযোদ্ধা বিএলএফ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ম্যানেজার জয়নুল এবং আমাদের গ্রামের তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমদ হোসেন বাবুল ফটিছড়ির মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তাঁর নাম না দেখে আমাকে জানায়। পরবর্তীতে তাঁদের দুইজনের আন্তরিক এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁর নাম ফটিকছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় পুনরায় স্থান পায়। মনে খুব দুঃখ আর ঘৃণা জন্মে যখন দেখি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধদের আস্ফালন। পাশাপাশি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যখন ভূলুণ্ঠিত করতে দেখি। একথা তো দিবালোকের মতো সত্য সেদিন যারা যুদ্ধে গিয়েছিল এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসেছে তাঁরা সার্টিফিকেট বা কোনো ধরণের ফিরতি পাওনার জন্য যুদ্ধ করেনি। যুদ্ধ করেছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। পাকিস্তানীদের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত স্বাধীন করার জন্য।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আমার একমাত্র ভগ্নীপতি, চিম্বুক রেস্টুরেন্টের মালিক এবং সিজেকেএসের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী এস এম কামাল উদ্দিন ( সি এন্ড সি / স্পেশাল, হাটহাজারী ) বিয়ের পরে জানান যে, যুদ্ধের সময় হাটহাজারীত যাওয়ার পথে তিনি আমাদের বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেছিলেন। হাট হাজারীর এম পি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াহাব মিয়াঁর এক জামাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈনুদ্দিন ভাইও আমাদের বাড়িত যুদ্ধের সময় রাত্রিযাপন করছিলেন বলে জানা যায়। আমার ভাতিজা শাদাবের চাচা শ্বশুর বোয়ালখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বেয়াই সৈয়দ আহম্মদ সাহবেও আমাদের বাড়ীতে ছিলেন। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে চাই যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করেছিলেন বা এখানে থেকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন তাঁরা যদি তাঁদের নাম ঠিকানা জানান তাহলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারে অবদান আরও সমৃদ্ধ হবে। যেহেতু আমাদের বিরাট বাড়িটি এবং বিশাল কাছারি ঘর মুক্তিবাহিনীর ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এবং মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধাদের প্রাণবাজী রেখে যুদ্ধ এবং দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ তিতীক্ষার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। লাল সবুজের পতাকা। জাতীয় সঙ্গীত। মুক্তিযুদ্ধের অমর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক :
মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী ।
দেওয়ান বাজার । চট্টগ্রাম