<strong>মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক </strong>
মানবতার আদর্শ প্রিয়ারা নবি, সাইয়েদুল মুরসালিন রাসুল (সা.)-এর ওয়ালাদ মাস রবিউল আউয়াল। ওয়ালাদ আরবি শব্দ, অর্থাৎ জন্ম। সেই থেকেই মিলাদুন্নবি বা নবির জন্মদিন। মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশে মা আমিনার কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে তাশরিফ এনেছিলেন পৃথিবী আলোকিত করা মানবতার মুক্তির দূত প্রিয়ারা রাসুল (সা.)। মক্কায় যখন অবিচার, অনাচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বীরত্বের ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক ছিল, সে সময়ের অবাদ সংস্কৃতির সমাজ তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তিনি নিজেকে এসব পঙ্কিলতা থেকে দূরে রেখেছিলেন। অবক্ষয়ের সময়েও সমাজ গড়ার চিন্তায় তিনি হিলফুল ফুজুল সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। রিসালাতের আগেই মক্কার বিদেশি ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
মক্কার শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ও নারীকুলের শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণাদায়ী মা খাদিজাতুল কোবরা (রা.)-এর ব্যবসার বিশ্বস্ত তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। পরে তাঁর সততা ও ব্যক্তিত্বের কারণে নিজ উদ্যোগে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। বিদুষী এই নারী তাঁর নবুয়তের প্রথম স্বীকৃতিদানকারী। ঐশী দূতের ঝাঁকুনির ভয়ে জাম্মিলুনি জাম্মিলুনি বলে কাতর মানুষটির পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, আল্লাহ আপনাকে অপমাণিত করবেন না, আপনি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায়-দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, মেহমানদের আপ্যায়ন করেন এবং সৎ পথের দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন (কিতাবুল ওহি, বুখারি)।
খাদিজার চাচাতো ভাই খ্রিষ্টান ধর্মের অন্যতম আলিম ওয়াকারা বিন নওফেল রাসুল (সা.)-এর রিসালাতের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘এ তো সেই দূত, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসা (আ.)-এর নিকট এসেছিল।’ রাসুল (সা.)-এর নবুয়তের স্বীকৃতির মাধ্যমে পৃথিবী এক আলোকবর্তিকা বা হক পথের সন্ধান পেল। আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘোর অন্ধকারে ডুবে থাকা জাতি আলোর সন্ধান পেল। সত্যিই এ ছিল এমন আলো, যা চাঁদের চেয়েও সুন্দর। মা আমিনার সঙ্গিনী বারাকাহ রাসুল (সা.)-এর জন্মের সময়ই বলেছিলেন, ‘মুহাম্মদ! চাঁদের চেয়েও সুন্দর।’ এই সুন্দরের ঢেউ দুনিয়ার তামাম জাহান আরো সুন্দর করে তুলেছিল। তিনি আমার আদর্শ সাইয়েদুল মুরসালিন প্রিয়তম মুহাম্মদ, আহমদ মোস্তফা (সা.)।
রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনে তামাম পৃথিবী সব আলোর আঁধার খুঁজেছেন এই ধরিত্রীর সব মুক্তিকামী ও মানবতাবাদী মানবস্রোত। সত্যের মহা আলোর আধাঁর আমার প্রিয়ারা রাসুল (সা.)। সারা পৃথিবীর দুর্গম পথ মাড়িয়ে আলোর পথের যাত্রীদের এক মহাকান্ডারি মানবতার মুক্তির দিশারি। রাসুল (সা.)-এর প্রেম আর ভালোবাসায় কত আবেগী মানুষ জীবন অতিবাহিত করেছেন, এর কোনো হিসাব নেই। আর এই ভালোবাসার তালিকায় মুসলিম-অমুসলিম সবাই আছেন।
রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনে সমগ্র বিশ্ব হেদায়াত তথা আলো হিসেবে যে কোরআন পেয়েছে, এর জন্য বিশ্ব সর্বকালে তাঁর স্মরণ এককভাবে সবচেয়ে বেশি করেছে, এখনো করছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। রাসুল (সা.)-এর শুভাগমনে সমগ্র বিশ্ব দিনদিন তাঁর ওয়ালাদাত’সহ আনীত জীবনবিধান, মানবাধিকার, মানুষের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর আলোচনা বাড়বে বই কমবে না। তাঁর এই অবদানের জন্যই মিলাদুন্নবি নিয়ে এত উৎস, আনন্দ ও খুশি। ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদে ইবনে আব্বাস বলেন : ‘রাসুল (সা.) সোমবার জন্মগ্রহণ করেন, সোমবার নবুয়ত লাভ করেন, সোমবারই ইন্তেকাল করেন। সোমবারে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনার পথে রওনা করেন, সোমবার মদিনায় পৌঁছান এবং সোমবারই তিনি হাজরে আসওয়াদ উত্তোলন করেন।’ (মসনদে আহমদ)।
গ্লোবাল ভিলেজে মুসলিম বিশ্ব বিশ্বের সবকিছুর অংশীদার। পৃথিবীর এমন কোনো স্থান পাওয়া যাবে না, যেখানে মুসলমানদের উপস্থিতি নেই।
বিশ্বের অর্থনীতি, শান্তি, মানবিকতাসহ মানবের প্রয়োজনীয় সবকিছুর সঙ্গেই মুসলমনদের অবদান জড়িত। মধ্যপ্রাচ্য তেল অর্থনীতিসহ বিশ্বের রাজনীতি ও পাওয়ার গ্রাউন্ড হিসেবে বিবেচিত। যে কারণে কেবল তাত্ত্বিকভাবে নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ বাস্তবিকভাবেই মুসলমানদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যে কারণে সব ধর্ম-মত ও পথের লোকজন খুব নিবিড়ভাবে মুসলিম ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাচ্ছে। ইসলাম বিশেষ করে রাসুল (সা.)-এর জীবন নিয়ে পশ্চিমা সমাজে যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, তা দুরকরণে মুসলমানসহ অনেক ওরিয়েন্টাস্টি এগিয়ে এসেছিলেন, যারা এখনো কাজ করছেন। হরর মুভির পরিচালক খ্যাত মোস্তফা আক্কাদ ১৯৭৪ সালে হলিউড থেকে ‘দ্য মেসেজ’ মুভির মাধ্যমে পশ্চিমা সমাজে রাসুল (সা.) সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। এমন শত-সহস্র উদাহরণ এখানে আনা যাবে, যারা রাসুল (সা.)-এর জন্মের মাধ্যমে পৃথিবী নবপ্রাণ পেয়েছিল বলে স্বীকার করেন।
বর্তমান পৃথিবীর এক-চতুর্থাংশ মানুষ রাসুল (সা.)-এর অনুসারি। কিন্তু অধঃপতিত ও ধ্বংসের কিনারায় হাবুডুবু খাওয়া মানুষকে যে আদর্শ দিয়ে রাসুল (সা.) কাছে টেনে নিয়েছিলেন, যে ভালোবাসায় একত্বের বাণীর মাধ্যমে মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন, নারীদের সসম্মানে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, অন্য ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন, সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে অন্যদের কথা বাদ দিলাম, আমরা মুসলমানেরা এর কতটুকুু জানি এবং মানি? দিনদিন হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি প্রতিনিয়ত সমাজে লেগেই আছে, এর দায় কি রাসুল (সা.)-এর উম্মত হিসেবে আমরা এড়াতে পারব? মিলাদুন্নবির এই দিনে আসুন আমরা একটি প্রতিজ্ঞা করি রাসুল (সা.)-এর নীতি-দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে প্রিয় জন্মভূমিকে সব মানুষের জন্য আবাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলি। পাশাপাশি তাঁরই আদর্শ হোক আমাদের জীবনের পাথেয়। আমিন।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক