প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ২ এপ্রিল পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব অটিজম দিবস। অটিজম একটি স্নায়ুর বিকাশজনিত মানসিক ও শারিরীক একটি রোগ। যা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে। বিভিন্ন অজ্ঞাতা ও অসচেতনতার কারণে এই রোগ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অসচেতন। তাই এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়।
অটিজম কীঃ
অটিজম হচ্ছে স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা সম্পর্কিত একটি রোগ। যে রোগে আক্রান্ত হলে একটি শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা হয়। শিশুটি তার চারপাশের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। সেইসাথে কোনো ব্যক্তির সাথেও স্বাভাবিক কথাবার্তা কিংবা ইশারা ইংগিত ইত্যাদির মাধ্যমেও যোগাযোগ করতে পারে না। মোটকথা যে সমস্যা একটি শিশুকে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অপূর্ণতায় পর্যবসিত করে তাকে অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলে। অটিজম পুরোপুরি মানসিক রোগ না হলেও মানসিক বিকাশ সংক্রান্ত একটি রোগ। যার কারণে একজন মানুষ অন্যান্যদের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ কথাবার্তা বা নিজের প্রয়োজনীতা প্রকাশ করতে পারে না।
প্রাথমিক লক্ষণঃ
কোনো শিশু তার এক বছর বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা বা বোল উচ্চারণ না করা। দেড় বছরের মধ্যে একটি শব্দও বলতে না পারা। দুই বছরের মধ্যে দুই বা তিন শব্দের অর্থবোধক বাক্য না বলা। কিংবা কিছু শেখার পর আবার ভুলে যাওয়া। কিংবা বাচ্চা যদি তার পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা ইংগিত করতে না পারা। বাচ্চার বয়স অনুযায়ী সামাজিক আচরণ করতে না পারা ইত্যাদি হচ্ছে অটিজমের খুবই প্রাথমিক কিছু লক্ষণ।
গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণঃ
উপরোক্ত প্রাথমিক লক্ষণ গুলোর পাশাপাশি যদি দেখা যায় আসলেই শিশুর ভাষা শিখতে সমস্যা হচ্ছে, বা একেবারেই মা–মা, বা–বা, চা–চা, ইত্যাদি এই জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সেইসাথে কারো চোখের দিকে চোখ রাখতে পারছে না। বা নাম ধরে ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। কিংবা সমবয়সী কারো সাথে মিশতে পারছে না বা মিশতে চাইছে না। কেউ আদর করতে চাইলে তা নিতে না পারা। হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া। অন্যের শোনা কথা বারবার বলা। বা যেকোনো বিষয়ে একই আচরণ বার বার করা।
কোনো পছন্দের জিনিস বা আনন্দের বিষয় অন্যের সাথে ভাগাভাগি করতে না পারা। সেইসাথে কারো স্পর্শ, কোনো শব্দ বা আলো ইত্যাদি বিষয়ে কম বা বেশি প্রতিক্রিয়াশীল না হওয়া। শিশু তার নিজস্ব গন্ডির নিজস্ব রুটিন মেনে চলতে পছন্দ করা। তার রুটিনের বাইরে আশেপাশের কোন পরিবর্তন সহ্য না করা। কোনো কারণে অকারণে নিজেকে আঘাত করা। পরিবেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পারা ইত্যাদি হচ্ছে অটিজমের খুবই গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এইসব লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
অটিজমের চিকিৎসাঃ
অটিজম সম্পর্কে আমাদের দেশে তেমন প্রচার প্রচারণা নেই। যারফলে অনেকেই শুরুতে এই রোগ নির্ণয় করতে পারে না। ফলে চিকিৎসা শুরু করতে বিলম্বিত হয়। যদি দ্রুত রোগ শনাক্ত করে শিশুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্দিষ্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া যায় তাহলে এই শিশুরাও অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের মত উন্নতি করতে পারে। তবে সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং উপদেশ নেওয়া খুবই জরুরী। আমাদের দেশে অটিস্টিকদের মানসিক রোগী মনে করে বিভিন্ন তান্ত্রিক কবিরাজী চিকিৎসা করা হয়। যা রোগীদের মানসিক অবস্থাকে আরও অবনতি করে।
তাই রোগ নির্নয়ের সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শে রোগীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং প্রয়োজনে বিশেষ সমস্যার জন্য ওষুধও সেবন করতে হতে পারে। তবে এটা সত্য যে, সাধারণ মেডিকেল চিকিৎসা এবং ওষুধের মাধ্যমে অটিজম থেকে সুস্থ হওয়া যায় না। অটিজম চিকিৎসায় ওষুধের তেমন কোনো ভূমিকা নেই৷ এই রোগীদের জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ৷
অটিজমে পরিবারের ভূমিকাঃ
অটিস্টিক শিশুদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পিতামাতাসহ পরিবারের অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমাদের দেশে অটিস্টিক শিশুদের বাবা মায়ের পাপের ফল বলে এক ধরনের কুসংস্কার চালু আছে। অথচ আল্লাহ্ নিজেই সন্তান দিয়ে তার বান্দাদের পরীক্ষা করেন। তাই এটা কখনোই পাপের ফল নয়।
সুতরাং রোগ নির্ণয়ের সাথে সাথে পরিবারকে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। এই রোগ থেকে একমাত্র বাবা-মাই তার সন্তানকে যতটুকু সম্ভব সুস্থ করতে পারে। তাই বাবা-মাকে অটিজমের উপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে হবে যাতে শিশুর অস্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
সেইসাথে স্কুলে ও বাড়িতে শিশুকে যাবতীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে হবে। যাতেকরে শিশুটি সামাজিক ও পারিবারিক রীতিনীতি শেখার চেষ্টা করতে পারে। বিশেষকরে যেকোনো সামাজিক পারিবারিক অনুষ্ঠানে শত লাঞ্চনা সত্ত্বেও শিশুকে সবার সাথে যোগাযোগের সুযোগ করে দিতে হবে।
সেইসাথে যে কাজ গুলো শিশু করতে আগ্রহী এবং যা ভালো করে করতে পারে, তাকে সেই বিষয়ে বেশী বেশী উৎসাহ দিতে হবে। বিশেষ করে ছবি আঁকা, গান গাওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়াতে হবে। হাজার কষ্ট হলেও শুরু থেকেই শিশুকে মূলধারার স্কুলে পাঠাতে হবে। যাতে সে সকলের সাথে মিশতে পারে। সেইসাথে স্কুলের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং থেরাপিস্ট সকলকে একযোগে চিকিৎসার জন্য কাজ করতে হবে।
পরিবারকেই শিশুর ভাষা শেখানোর প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে। তার মানসিক অবস্থা অনুযায়ী পরিবারকে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। হাজারো কারণ থাকা সত্ত্বেও শিশুকে কোনো প্রকার শারিরীক ও মানসিক পীড়া দেওয়া যাবে না। রোগের কারণে অন্যান্য লক্ষণের ধরণ অনুযায়ী কিছু ওষুধ ও থেরাপি যেমনঃ অকুপেশনাল থেরাপি বা দৈনন্দিন কাজ করার প্রশিক্ষণ, ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি, সাইকোথেরাপি, প্লে–থেরাপি, সেনসরি ইন্টিগ্রেশন অর্থাৎ সংবেদনশীলতা বাড়ানোর কৌশল ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দিতে হবে।
মোটকথা একটি পরিবার চাইলেই সাইকোথেরাপি বা স্পেশাল শিক্ষাদানের মাধ্যমে আক্রান্ত শিশুকে ৮০-৯০ ভাগ পর্যন্ত সুস্থ করে তুলতে পারে। সঠিক পদ্ধতিতে চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দিলে প্রতিটি অটিস্টিক শিশুই উন্নতি করে৷ এমনকি অনেকে সাধারণ স্কুলে যাওয়ার মতোও হয়ে ওঠে৷ শুধু তাইনয় চিকিৎসা গ্রহণ করে সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে বিয়ে ও সংসার করাও অনেকের পক্ষে সম্ভব এবং তার প্রমাণও আছে।
কখন ঔষধের প্রয়োজনঃ
আগেই উল্লেখিত যে, শুধুমাত্র ঔষধ দ্বারা কখনোই এই রোগ সারানো সম্ভব নয়। এই রোগের মূল চিকিৎসা হলো প্রশিক্ষণ এবং থেরাপি। তবে এই রোগের সাথে আরও অন্যান্য লক্ষণ যেগুলো আছে তার জন্য প্রয়োজনের ভিত্তিতে ঔষধ ব্যবহার করা যাবে। বিশেষ করে রোগীর বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা থেরাপি কোনো কিছুই দেওয়া যাচ্ছে না, তখনই রোগীকে ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা দিতে হবে।
বিশেষকরে অটিজমের পাশাপাশি সহযোগী সমস্যা যেমনঃ কোমর্বিডিটি অর্থাৎ খিঁচুনি, অতিমাত্রায় চঞ্চলতা, বুদ্ধির স্বল্পতা, বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, আচরণজনিত সমস্যা, হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া, আগ্রাসী আচরণ ইত্যাদিসহ যেকোনো শারিরীক সমস্যায় ডাক্তারি চিকিৎসা দেওয়া।
এছাড়া শিশুর এমন কোনো আচরণ, যা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যাকে বলে চ্যালেঞ্জিং বিহেভিয়ার। যেমনঃ নিজেকে আঘাত করে রক্তাক্ত করা, নিজেকে নিজে কামড়ানো, মেঝেতে বারংবার মাথা ঠোকা, যাকেই সামনে পায় তাকে আঘাত করা, নিজের চুল নিজে ছিঁড়ে ফেলা। অন্যকে দাঁত দিয়ে কামড়ানো ইত্যাদিসহ খিটখিটে মেজাজ বা ইরিটেবিলিটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা যায়।
সেইসাথে একজন শিশু বা ব্যক্তি যখন তার এইজাতীয় সমস্যার জন্য নির্ধারিত প্রশিক্ষণ বা থেরাপি নিতে না পারলে বা নিজের রুটিন কাজগুলো করতে পারে না পারলে, তখন রোগীকে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। যাতে সে নিজের কাজগুলো করার জন্য সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
অটিস্টিকরা প্রতিবন্ধী নয়ঃ
আমাদের দেশে অটিস্টিকদের অবহেলার একমাত্র কারণ হচ্ছে তাদের মানসিক প্রতিবন্ধী মনে করা। এই কারণে জন্মের পর থেকেই তারা বিরুপ আচরণের মুখোমুখি হয়। অথচ তারা শারিরীক বা মানসিক প্রতিবন্ধী নয়। কেননা প্রতিবন্ধীর অর্থ হল, যে শারিরীক বা মানসিকভাবে বিশেষ কোন বাধার বা প্রতিবন্ধকতায় কোন কাজ করতে না পারা। আমাদের সমাজে এমন কিছু শিশু দেখা যায় যাদের শারিরীক গঠন স্বাভাবিক নয়। হাত বা পা নেই কিংবা কানে শোনে না। ফলে কথাও বলতে পারে না। অনেকে চোখে দেখে না বা কম দেখে। সেইসাথে মানসিক ভারসাম্য না থাকার কারণেও স্বাভাবিক কাজ করতে না পারা হচ্ছে একধরনের প্রতিবন্ধীত্ব। যারা এই প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হয় তারা হচ্ছে প্রতিবন্ধি।
অথচ যারা অটিস্টিক তারা এই জাতীয় নয়। তাদের মূল সমস্যাই হলো স্নায়ুর সঠিক বিকাশ না হওয়া। এই ধরনের শিশুদের মানসিক ক্ষমতার বিকাশ বন্ধ হয় না। তারা সঠিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও ভালোবাসা পেলে জীবনে প্রচুর উন্নতি করতে পারে।
সামাজিক করণীয়ঃ
সামাজিক লাঞ্চনা এবং অবহেলার কারণে পরিবার থেকেই অটিস্টিকদের সবার থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। যা কখনোই উচিত নয়। সেইসাথে সামাজিকভাবে এই রোগীদের প্রতি ভালোবাসা ও আস্থা দেওয়া উচিত। যাতে তারা সামাজিকভাবে সকলের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায়। তাদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা, হেয় বা অবাঞ্ছিত করা কখনোই উচিত নয়। তাদের অযোগ্যতা কখনোই প্রকাশ করা উচিত নয়। বরং তাদের নূন্যতম কাজেরও প্রসংশা এবং বাহবা দেওয়া উচিত। সমাজের প্রতিটি স্তরে তাদের গ্রহনযোগ্যতা সৃষ্টি করা উচিত। যাতেকরে তারাও সমাজের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে। আর এভাবেই সকলের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা পেলে একটি অটিস্টিক শিশু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে।
অটিজম কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের একক সমস্যা নয়। অটিজম একটি জাতীয় সমস্যা। তাই এই সম্পর্কে সর্বস্তরের সচেতনতা খুবই জরুরী। সেইসাথে অনেক ক্ষেত্রে অনেক শিশু অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ নিয়ে জন্ম নিলেও সময়ের সাথে সাথে তা দূর হয়ে যায়। তাই কোন শিশু স্বভাবগতভাবে একটু বেশি অস্থির, চঞ্চল, রাগী ও জেদি প্রকৃতির হয়ে থাকলে তাকে অটিস্টিক মনে করা উচিত হবেনা। তাই প্রতিটি শিশুর প্রতি পরিপূর্ণ যত্নবান হওয়া উচিত। যাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ শিশুর মধ্যে প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।