(জন্ম ২০ জুলাই ১৮৯৮ সাল-মৃত্যু ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সাল)
এ.এম জিয়া হাবীব আহসান :
চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের মানুষের অধিকারের কথা বলতে
গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের মর্যাদা পায়
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত
দৈনিক আজাদী পত্রিকা । তাঁর মৃত্যুর পর সম্পাদক ছিলেন
তাঁর জামাতা প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ ও প্রকাশক এর
দায়িত্ব পালন করেন । প্রতিষ্ঠাতার একমাত্র সুযোগ্য পুত্র
আলহাজ্ব এম.এ মালেক (বর্তমান প্রকাশক ও সম্পাদক) ।
ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবের সহধর্মিনী মরহুমা মালেকা
খাতুন প্রকাশ মল্লিকা ছিলেন আমার আম্মার ফুফা গহিরা বক্স এলাহি চৌধুরী বাড়ী নিবাসী মরহুম সিদ্দিক আহমদ চৌধুরীর জেঠাতো বোনের মেয়ে এবং প্রাক্তন মেয়র এ.বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আপন ফুফাতো বোন।
এখানে উল্লেখ্য যে, আমার আম্মার ফুফা ছিদ্দিক আহমদ চৌধুরীর এক কন্যা খোদেজাল কোবরা হলেন আমার মেঝ মামী, উনার স্ত্রীকে তাই আমার আম্মা ও মামী সোহাগ করে ডাকতেন ʻমল্লিকা-বু’ নামে । রাউজান সুলতানপুর আমার নানার বাড়ির দিক থেকে ইঞ্জিনিয়ার মরহুম মগফুর আব্দুল খালেক (রঃ) আমার মরহুম নানাজান এডভোকেট এজাহার হোসাইন বি.এল (কলকাতা হাওড়া কোর্টের তদানিন্তন সরকারী আইন কর্মকর্তা) এর ঘনিষ্ট আত্নীয় এবং পরস্পর পীর ভাই ছিলেন । তাঁরা উপমহাদেশের মহান আধ্যাত্নিক সাধক পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ ছিরিকোটি (র.) এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। পরম ঘনিষ্টতা ও আত্নার আত্নীয়তার সুবাদে ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবের স্ত্রী’কে আমার নানা প্রায়ই তাঁর মোমিন রোডস্থ বাসভবনে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হিসেবে ʻʻনাইওর’’ করে নিয়ে আসতেন । ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেব ও আমার নানা ছিলেন একই বৃন্তে ফোটা যেন দু’টি ফুল । একারণে আমার নানাজান ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর মোমিন রোডস্থ দ্বিতলা ভবনের নিচে একটি আধুনিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম এম.বি.বি.এস ডাক্তার এম.এ. হাশেমও তাঁদের ঘনিষ্টজন ছিলেন ।
এছাড়া মরহুম আব্দুল খালেকের আপন ভাগ্নে ও জামাতা প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ যখন’ ৭০ এর নির্বাচনে এম.পি প্রার্থী হন, তাঁকে ঘনিষ্টজন আমার পিতা মরহুম আবু
মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা, এডভোকেট তাঁর প্রস্তাবক ছিলেন । প্রতিপক্ষ সেসময় বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় জেতার জন্য আমার পিতাকে অপহরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ।
প্রফেসর খালেদ এর নির্বাচনের নেপথ্যে সবচেয়ে বেশী কাজ করেন তাঁর স্ত্রী’র একমাত্র ভাই আলহাজ্ব এম. এ মালেক। প্রফেসর খালেদ সাহেবের মেঝো ছেলে শ্লোগান পত্রিকার সম্পাদক মোঃ জহির ভাই আমার খালাতো বোন বিয়ে করলে
তাঁদের সাথে আমাদের পুরানো আত্মীয়তা নবায়ন হয় ।
দৈনিক আজাদী, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস ও কোহিনূর লাইব্রেরী স্থাপনের মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ার খালেক সমাজ উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখেন । উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের মাধ্যমে
তিনি বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন ছাড়াও আর্থ-সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রভৃতির সামগ্রিক উন্নয়নে প্রভুত অবদান রেখে গেছেন ।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছিলেন দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক । ১৯৬২ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর পরই প্রফেসর খালেদ সাহেব দৈনিক আজাদীর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুর“ করেন । তবে প্রফেসর খালেদ সাহেবকে তাঁর মামা ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেব ইতিপূর্বেই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত করেন ।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক একজন প্রকৃত মানুষের প্রতিচ্ছবি। কোন মৌলিক ব্যাখ্যায় তাঁকে অধিষ্ঠিত করা যায়, কেন না তা সত্যিকার অর্থেই জটিল। তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে বিচার বিশ্লেষণ করলে মনে হবে তিনি যেন সেটির জন্যই জগত সংসারে এসেছেন। কিংবদন্তি সাংবাদিক হিসাবে বিশ্লেষণ করলে
মনে হবে, তিনি সফল ও ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিক। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে মূল্যায়ন করলে মনে হবে তিনি মানব কল্যাণে নিবেদিত পুরুষ।
আধ্যাত্নিক বিবেচনায় তিনি ‘সুফী সাধক’। জীবন সংসার এবং কর্মজীবনের চলমানতায় তিনি ছিলেন নির্লোভ মানুষ। তাঁকে বিশ্লেষণ করলে যে সত্যগুলো বেরিয়ে আসে তা হলো তিনি সমাজের জন্য Friend, Philosopher এবং Guide। ব্রিটিশ ভারতে বিশেষ করে এই চট্টগ্রামে তাঁর মতো একজন প্রকৌশলী অর্থের মোহ ত্যাগ করে পত্রিকা প্রকাশনা জগতে এসেছেন-সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার। এ অঙ্গনে আসার মূল কারণ ছিলো সমাজ ও সভ্যতাকে ইতিবাচক নির্দেশনা প্রদান । তদানীন্তন সময়ে পত্রিকা প্রকাশনা জগতে প্রবেশ করে তিনি প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
প্রকৃত মানুষ হিসেবে সমাজ ও মানবতার প্রতি কেন না দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি স্বেচ্ছায় এমন মানবিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তার পছন্দের কাজ ছিলো দুস্থ মানুষের সেবা করা, পাশাপাশি তাদের কর্মমুখী হিসেবে গড়ে তোলার
প্রত্যয়ে ছিলেন সদা সচেষ্ট। ভিক্ষুকদের ভিক্ষার হাতকে তিনি কর্মীর হাতে পরিণত করেছেন, তাদের সাথে এক বিছানায় বসে খেয়েছেন। অসুস্থ হলে নিজে তাদের সেবা করে সুস্থ করেছেন। এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব কি আছে ? তাইতো
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক একজন মহাত্না। এই মহাত্নার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে।
২০ জুলাই ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতার নাম বেলায়েত আলী এবং মাতার নাম ফজিলাতুন নেছা। বংশ পরিচয় তুলে ধরতে হলে যেতে হবে সুদূর অতীতের পানে। দেশবরেণ্য গবেষক ও চট্টলতত্ত্ববিদ আবদুল হক চৌধুরী তার দীর্ঘ শ্রমসাধ্য গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যে, আবদুল খালেক সাহেব মোগল পদাতিক বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেখ বড় আদম লস্করের সুযোগ্য বংশধর। কোন সূত্রে তিনি শেখ বড় আদম লস্করের বংশধর ছিলেন সে বিষয়ের অবতারণায় আমাদের যেতে হবে আবদুল হক চৌধুরীর ঐতিহাসিক গবেষণাকর্মের গভীরে। এই গবেষণা কর্মে তিনি লিখেছেন, সুপ্রসিদ্ধ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। মোগল
পদাতিক বাহিনীর প্রধান শেখ বড় আদম লস্কর ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড় থেকে চট্টগ্রাম জেলার সুলতানপুর গ্রামে আসেন। এর সত্যতা মেলে একই বংশের অ্যাডভোকেট আবুল কাসেম সাহেবের নিজ হাতের লেখা বংশ পরিচয় তালিকায়।
তিনি পূর্ব পুরুষদের তালিকা তৈরি করতে গিয়ে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন আদম লস্করের বড় ছেলে শেখ মোহাম্মদ রেজার (রাজা খাঁ বা রেজা খা) ছিলেন চার পুত্র।
তাঁরা হলেন : ১. মুই মুকিম ২. মুসা, ৩. ইউসুফ, ৪. কার্ফা মুই মুকিম। সেই মুসার প্রসঙ্গ টেনে গবেষক আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন বড় আদম লস্করের বড় ছেলের পক্ষের পৌত্র হলেন মুসা। দৈনিক আজাদী ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের
প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার হলেন সেই মুসার বংশধর।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বড় আদম লস্করের কবর আজও সুলতানপুর গ্রামের বড় বাড়ী পাড়া বাঘপুকুর সংলগ্ন পাড়ে রয়েছে। প্রখ্যাত শেজরা লেখক মরহুমা আলহাজ্ব মোহাম্মদ
দিদারুল আলম তাঁর রচিত ʻআমার বংশ শেজরা’ গ্রন্থে লিখেছেন চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত রাউজান উপজেলা শিক্ষাদীক্ষা- সংস্কৃতিতে অগ্রসর এলাকা। উপজেলার
কেন্দ্রস্থলে রাউজান পৌরসভার এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের নাম সুলতানপুর। এ গ্রামের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত মুকিম বাড়ির পূর্ব পুরুষ ছিলেন মোগল আমলের পদাতিক বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান শেখ সৈয়দ বড় আদম লস্কর ওরফে বড় আদম লস্কর (রঃ) এর বংশধর । মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব’র আমলে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে গৌড় হতে বড় আদম লস্করের সুলতানপুর আগমন ঘটে। এরই অধঃস্তন বংশধর মরহুম বেলায়েত আলী চৌধুরী ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার ঔরসে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাইয়ের এক শুভক্ষণে একটি শিশুর জন্ম হয়। সেই আনন্দঘন মুহূর্তে ইসলামী শরীয়ত মতে সদ্যভুমিষ্ঠ শিশুটির নাম রাখা হয় মুহাম্মদ আবদুল খালেক। উল্লেখ্য যে সৈয়দ বড় আদম লস্কর ওরফে বড় আদম লস্কর (রঃ) এর বংশধর মুকিম খাঁর পরবর্তী পুরুষ মুন্সী আমিনঊল্লাহ কেরানীর বংশধর হলেন আমার মরহুম নানাজান এজাহার হোসেন বি.এল । কোলকাতা থেকে ১৯৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর
দেশে ফিরে এসে আমার নানাজান চট্টগ্রাম মোমিন রোডের এক দ্বিতল বিশিষ্ট বিল্ডিং এ ূদি স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার কোম্পানি“ নামে এক আধুনিক লাইব্রেরী উদ্বোধন করেন এবং স্বপরিবারে ঐ বিল্ডিং এর উপর তলায় বসবাস শুরু করেন ।
সেখানে নানার বাসায় মরহুম আব্দুল খালেক সাহেবের পরিবার পরিজনের আসা যাওয়া ছিল । মোহাম্মদ আবদুল খালেক- এই নামকরণে সমৃদ্ধ তথ্য হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রিয় নামের সমন্বয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন অনেকটা এতিম। অল্প বয়সেই তিনি তার পিতাকে হারান। সে সময় বড় বোন তামান্না খাতুন এবং বড় ভাই আবদুল গণি চৌধুরীর স্নেহে তাঁর শৈশব কাটে। সংসারের দৈন্যতা না থাকলেও আর্থিক সচ্ছলতা খুব একটা ছিলো না। বিশেষ করে পরিবারের রোজগারের মানুষটির আকস্মিক মৃত্যু সংসারকে প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিলো। জমি-জমা ছিলো, কিন্তু ছিলো না তদারকি করার মানুষ।
সে দুঃখের সময়ে চাচা আহমদ মিয়া চৌধুরী তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর সার্বিক সহযোগিতায় আবদুল খালেক এগুতে থাকেন। পারিবারিক শিক্ষাকে ভিত বানিয়ে পাঁচ বছর বয়সে তিনি রাউজান স্টেশন প্রাইমারী স্কুলে ভর্ত্তি হন। পরবর্তী সময়ে সে স্কুলের নাম হয় ভিক্টোরিয়া প্রাইমারী স্কুল। এই মেধাবী মানুষটি পরবর্তী সময় যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম হচ্ছে-
১. আর.আর.এসি ইনস্টিটিউশন (রামগতি রামধন আবদুল বারি চৌধুরী)।
২. চট্টগ্রাম কলেজ
৩. যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কলকাতা। তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন ১৯১২ সালে, আইএসসি ১৯১৪ সালে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ১৯১৯ সালে।
প্রসিদ্ধি আছে যে, তিনি ছিলেন এতদ্ অঞ্চলের প্রথম বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। কেউ বলেন তিনি পূর্ব বাংলার প্রথম মুসলমান বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। মূলতঃ তিনি ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীতে চাকুরীর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুতায়নে অনবদ্য অবদান অনস্বীকার্য । তিনি ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে চাকুরীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পুরোপুরি চাকুরী ছেড়ে দেন। এই সময়গুলোতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ।
তাঁর জীবনে তিনটি অধ্যায় রয়েছে।
১. চাকুরি জীবন (১৯২০ থেকে ১৯৩৩) পর্যন্ত)
২. ব্যবসায়িক জীবন (১৯২৯ থেকে ১৯৬২)
৩. সাংবাদিকতার জীবন (১৯৫০ থেকে ১৯৬২),
পত্রিকার প্রকাশক হয়ে তিনি থেমে যাননি। চাকুরীতে থাকা অবস্থায় তিনি প্রতিষ্ঠান করেছিলেন কোহিনুর লাইব্রেরী (১৯২৯) এবং কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস (১৯৩০)। সেই সময় কোহিনুর নামে তার পরিবারের কোন মেয়ের নাম ছিল না। কোহিনুর ছিল মূল্যবান হীরক খন্ডের মুকুট। এটা ছিলো মুসলমানদের শৌর্য বীয্যের্র প্রতীক। তাই তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের পূর্বে কোহিনুর শব্দটি জুড়ে দিয়েছিলেন। কোহিনূর লাইব্রেরী ছিল আন্দরকিল্লা’র মোড়ে। মানুষরা এখানে এসে বই পড়ে যেতেন। চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ চালিত প্রথম প্রেস ছিলো কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস। কোহিনূর লাইব্রেরী এবং কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রামে সাহিত্য সাংস্কৃতির প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়তে থাকে। তাছাড়া তিনি দেখলেন মুসলমান সমাজ শিক্ষাতে পিছিয়ে রয়েছেন এবং তাদের মাঝে কুসংস্কার বড় একটি সমস্যা। তাই, তিনি তাদেরকে বাস্তবতা ও প্রগতিমূখী করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা (১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর)। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ১৯৫২’র ২১শে ফেব্রয়ারীতে বাংলা ভাষার দাবীতে ঢাকায় বাঙ্গালী ছাত্র-জনতার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হল। এই সংবাদ চট্টগ্রাম এলে ভাষা সংগ্রামী মাহাবুবুল আলম চৌধুরী অসুস্থ শরীর নিয়ে লিখে ফেললেন যুগান্তকারী একুশের প্রথম কবিতা।
‘কঁাদতে আসেনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’- এই কবিতা ছাপা হয়েছিল কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে। এইজন্য তৎকালীন পাকিস্তানীদের কাছে প্রেসের কর্মচারী এবং মালিককে প্রচুর খেসারত দিতে হয়েছিল। কোহিনূর পত্রিকার তিনি ছিলেন প্রকাশক ও সম্পাদক। এই সময় তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, লেখক ও প্রকাশক। সাড়া জাগানো এই কবিতাটি সভায় পাঠ করা ও বিতরণ করার লক্ষ্যে লিখলেন কবি। আর ঐতিহাসিক সেই কবিতাটি ছাপানোর জন্যে সিদ্ধান্ত হয় কোহিনূর প্রেসে। ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাপানোর জন্যে দীর্ঘ ১৭ পৃষ্ঠার কবিতাটি আসে কোহিনূর প্রেসে। অসীম সাহসিকতা নিয়ে কবিতাটি ছাপিয়ে দিলেন প্রেসের মালিক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। গভীর রাতে কবিতাটির ছাপানোর কাজ চলে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী টের পেয়ে যায়। কম্পোজ ও প্রুফের কাজ শেষ হওয়ার পথেই এসপি আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে পুলিশ প্রেসে হানা দেয়। প্রেসের কর্মচারীরা খুব দ্রুততার সাথে কম্পোজ ম্যাটার সরিয়ে ফেলে। ফলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তারা পেল না। পুলিশ চলে যাওয়ার পর বাকী কাজ সেরে প্রায় কয়েক হাজার কপি করে কবিতাটি যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। পরের দিন কবিতাটি লালদীঘির প্রতিবাদ সভায় পঠিত হলে কবিতাটি নিষিদ্ধ হয় এবং পাঠকারী চৌধুরী হারুন অর রশীদ ও কবির প্রতি হুলিয়া জারি হয়। অন্যদিকে ছাপানোর দায়ে ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবকে গ্রেফতার করতে আসে পুলিশ। কিন্তু প্রেসের ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী ছাপার কাজের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে নিজেই গ্রেফতার হলেন। স্বেচ্ছায় দায় কাঁধে নিয়ে বাঁচালেন প্রানপ্রিয় মানবতাবাদী প্রেসের মালিককে। এভাবে কোহিনূর প্রেস বা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব ভাষা আন্দোলনে স্বীয় অবদান রাখেন। আর বাংলাদেশের ভাষা তথা স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাসের মনিকোঠায় স্থান করে নেন । ১৯৩০ সালে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন এবং এ প্রেসকে ঘিরে ১৯৫০ সালে সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা বের করা হয়। এ ভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের মধ্য দিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে দৈনিক আজাদী বের করেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। এতে করে সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার অগ্রযাত্রা দৈনিক পত্রিকায় পরিণত হয়। যা আজও চট্টগ্রামের সর্বোচ্চ পঠিত দৈনিক । অবশ্য সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা ১ মে ১৯৬১ সালে মাসিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ১০ বছর ৬ মাস সাপ্তাহিক কোহিনূর প্রকাশের পর ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। দৈনিক আজাদী পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তিনি প্রচুর মেধা, শ্রম ও সময় দিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর পরিকল্পনা ছিল-
১. পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করা,
২. যথাসময়ে পত্রিকা পাঠকের হাতে পেঁৗছে দেওয়া,
৩. মালিক ও হকারের মাঝে সমন্বয় সৃষ্টি করা,
৪. নির্দিষ্ট পয়েন্টে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়া,
৫. কোহিনূর প্রেসের সাথে পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মচারিদের
সমন্বয় সৃষ্টি করা,
৬. অর্থের যোগান দেওয়া। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি ভিক্ষুকদের হকারে পরিণত করেছিলেন।
তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি বিশেষ দিক ছিলো পাকিস্তান-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের মহান আধ্যাত্নিক সাধক পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ ছিরিকোটি (র.) সাহেবের সংস্পর্শে এসে তিনি আধ্যাত্নিক উপলব্ধিতে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পীর সাহেব (রঃ) ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আমন্ত্রণে চট্টগ্রাম আসেন এবং উঠেন কোহিনূর মঞ্জিলে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁর হাতে বায়েত গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশনায় চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামক প্রতিষ্ঠানটি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন চট্টগ্রামে তাঁর খলিফা। এই মহান পুরুষ ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী এখনো গর্বের সাথে প্রকাশিত হচ্ছে। আরো বলা প্রয়োজন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা হচ্ছে দৈনিক আজাদী। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে কোন পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি এরপর ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদী। (সংক্ষিপ্ত তথ্য) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের একমাত্র পুত্র আলহাজ্ব এম. এ. মালেক, বর্তমানে তিনি দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ও প্রকাশক এর দায়িত্ব পালন করছেন।
আজাদী সম্পাদক এম.এ মালেক তাঁর মরহুম পিতার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির উপরোক্ত সমৃদ্ধিতে তাঁর মেধা শ্রম ও যোগ্যতাকে যুগোপৎভাবে কাজে লাগান বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে তিনি সাংবাদিকের সাহস ও প্রেরণার প্রতীক । তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে ক্রমান্বয় দৈনিক আজাদী জাতীয় মানের পত্রিকায় পরিণত হলেও তিনি আজাদীকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মাটি ও মানুষের পত্রিকা হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেন। ফলে আজাদী চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ের স্পন্দনে পরিনত হয়েছে । মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক সাহেবের প্রতি চট্টগ্রাম সহ সমগ্র দেশবাসী ঋণী । আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিযে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নগরের আন্দরকিল-ার ঐতিহাসিক মোড়টিকে ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চত্বর’ নাম দিয়ে তাঁকে স্মরণীয় করে রাখে । চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তন’ গড়ার পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) এ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের নামে শিক্ষার্থীদের জন্য গরীব ও মেধাবী বৃত্তি চালু করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সাহেবকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়া হয় । ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও কোহিনুর ইলেক্টিক প্রেসকে একুশে পদক প্রদান করা বাঞ্ছনীয় । এটা চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবী । মহান আল-াহ্পাক তাঁকে তাঁর সৎকর্মগুলোর সর্বত্তোম বিনিময় দান করুন ।
আমীন
লেখকঃ আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসনকর্মী ।
আরও পড়ুন :
এক জীবন সংগ্রামী মানুষের নাম প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ – জিয়া হাবীব আহ্ সান