কাজী আশফিক রাসেল
রাজনীতি কি মানুষ গড়ার শিল্প, নাকি পশুত্ব ঢেকে রাখার এক মুখোশ? এই প্রশ্ন আবারও সামনে এনে দিল পুরান ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতালের সামনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে পাথর ছুড়ে হত্যা এবং তার মরদেহের ওপর নাচতে দেখা গেছে যে নেতাকর্মীদের, তা শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির মৌল নৈতিকতাকে হত্যার নামান্তর।
এই ঘটনায় রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের পরিচিত নেতা এবং সম্ভাব্য পদপ্রার্থী ছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এতে প্রমাণিত হয়, অপরাধ এখন আর অজানা কোনো গলি ঘুপচির ব্যাপার নয়, বরং রাজনীতির নামেই সে আজ সমাজের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
আমরা ভুলে যাইনি ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা, পিলখানার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ কিংবা শাপলা চত্বরে হেফাজত কর্মীদের ওপরে চালানো মধ্যরাতের গুলিবর্ষণ । এসব ছিল রাজনৈতিক দখলদারিত্বের জঘন্য দৃষ্টান্ত। যদি বিএনপি একই ধারায় হাঁটে, তাহলে তাদের সঙ্গে অতীতের সেই বিভীষিকার কীই বা পার্থক্য রইল?
বিএনপি একটি ঐতিহ্যবাহী দল, যারা গত দেড় দশক ধরে ফ্যাসিবাদী দমননীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এ দলের অনেক কর্মী গুম, খুন, কারাবরণ ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেই একই দলের ছায়ায় যদি অপরাধীরা ঘাঁটি গেড়ে বসে, তবে তা শুধু রাজনৈতিকভাবে লজ্জাজনক নয়, বরং এদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর অশনিসংকেত। আমরা মনে রাখতে চাই, অপরাধীর একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত ‘অপরাধী’। সে কোন দলের, মতের বা শ্রেণির তা নয়, বরং তার অপরাধই বিচারযোগ্য বিষয়। যদি কোনো রাজনৈতিক দল দুর্বৃত্তদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেয়, তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই ধ্বংস করবে।
তবে মিডফোর্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি বিপজ্জনক প্রবণতা লক্ষণীয়। যেভাবে শুধু বিএনপিকে দায়ী করে হুলস্থূল করা হচ্ছে, অন্যদিকে চাঁদপুরে এক ইমামকে কুপিয়ে হত্যা, খুলনায় এক যুবদল নেতাকে গুলি করে হত্যা – এসব ঘটনায় রাষ্ট্র ও মিডিয়ার নির্লিপ্ততা আমাদের ভাবায়। ন্যায়বিচার যদি বেছে বেছে হয়, তাহলে সেটি আর ন্যায় থাকে না, পক্ষপাত হয়ে ওঠে। হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া কোনো ‘পছন্দের প্রশ্ন’ হতে পারে না; এটি একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বর্তমানে দেশের প্রশাসন পরিচালনায় রয়েছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাহলে কেন এই সরকার নিজেকে বারবার অসহায় প্রমাণ করছে? কেন তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে পারছে না? জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তো রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। সরকার যদি তোফাজ্জল, সৌম্যসহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনার পর দ্রুততম সময়ে দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে পারতো, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রাখতো, তাহলে এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়তো ঠেকানো সম্ভব হতো।
৫ আগস্টের মুক্তির স্বপ্ন লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল, একটি ন্যায়ভিত্তিক, স্বাধীন, নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য। সেই স্বপ্নের পথে যদি আবার রক্তের ছাপ পড়ে, যদি খুনিরা নাচে, তবে বুঝে নিতে হবে আমরা এখনও মুক্ত হইনি। রাজনীতি মানে মতবিরোধ থাকবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু খুন? লাশের ওপর নৃত্য? এসব কোনোভাবেই ‘রাজনীতি’ নয়। এটি নৃশংসতা। এটি বর্বরতা। এটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য হুমকি।
কোনো দলের হাজারো ভালো উদ্যোগ মুহূর্তেই ভেস্তে যেতে পারে যদি সেই দলের অভ্যন্তরে দুর্বৃত্তায়ন, খুন ও সন্ত্রাসের চর্চা স্থান পায়। এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য দুটি পথ খোলা,
হয় তারা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও আদর্শিক অবস্থান রক্ষায় দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেবে,
নয়তো তারা নীরব থেকে ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের অবস্থান দুর্বল করে ফেলবে।
এই বর্বরতা শুধু একটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, আমাদের সামষ্টিক মানবিকতাবোধ, রাজনৈতিক নৈতিকতা ও স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে আঘাত। এই আঘাতের জবাব আমরা কাকে বলবো? কে দেবে তার উত্তর? মুখে গণতন্ত্র বললেই চলে না, তার প্রমাণ রাখতে হয় সাহসিকতা ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে। এখন জনগণ সেই প্রমাণ দেখতে চায়।
লেখকঃ মানবাধিকারকর্মী ও কলামিস্ট।