ঢাকাশনিবার , ২৭ এপ্রিল ২০২৪
  1. সর্বশেষ

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে অদম্য এক তরুণ

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
৬ জানুয়ারি ২০২০, ১১:৩৮ অপরাহ্ণ

Link Copied!

———————

বর্তমানে বাংলাদেশের জটিল এক সমস্যার নাম মাদক। কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক অনেকে এ মাদকের সাথে জড়িত। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মাঝে এর প্রভাব লক্ষণীয়। গবেষণা অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখের বেশি। তার মধ্যে ৯০ ভাগ কিশোর ও তরুণ, ১৬ ভাগ নারী। ২০২০ সাল নাগাদ এর সংখ্যা এক কোটি ছড়িয়ে যাবে। মাদকাসক্তের ৪৫ ভাগ বেকার, ১৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত, ৬৫ ভাগ স্নাতক পর্যায়ে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। দিনদিন মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। প্রেমে ব্যর্থতা, ভুল ধারণা, কৌতূহল, পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, বন্ধুদের কুপ্রচারণা, নানা রকম হতাশা ও আকাশ-সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব এসব মাদকের নেশায় ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া বন্ধুবান্ধবের অসৎ পাল্লাই পড়ে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তরুণ সমাজ। এতে করে যুবসমাজের একটা বিশাল অংশ অচিরেই ঝরে পড়ছে। হারিয়ে ফেলছে তাদের কর্মক্ষমতা, সৃজনশীল শক্তি, এমনকি একটা পর্যায়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সভা সমিতিতে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলেছেন। তিনি মাদক, জঙ্গিবাদ এবং দূর্ণীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। মাদক নিমূলে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দায়বদ্ধতা আছে। বর্তমানে মাদক নিয়ে বেশ কিছু সংগঠন কাজ করছে। এর মধ্যে খুবই কার্যকর ভূমিকা পালনে এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের সন্দ্বীপের ছেলে মোঃ সামসুল আজম মুন্না। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মাদকমুক্ত তারুণ্য চাই’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বর্তমানে দেশের ১৪টি জেলায় কাজ করছে মাদকমুক্ত তারুণ্য চাই ফোরামের সক্রিয় টিম।

আজ মুন্নার সাক্ষাৎকারে জানব ভিন্ন কিছু। লিখেছেন জিসান মাহমুদ-

লেখক: মাদক নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা শুরু হলো কিভাবে?

মুন্না: আমার মা একটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বাবা বেঁচে নেই। মা’কে দেখার জন্য প্রায়ই বাড়িতে যাই। এই যাওয়া আসার কারণে আমার গ্রামের অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ে আমার। যুবকরা মাদকে আসক্ত। অনেক শিশু স্কুলে না গিয়ে মাদক পরিবহনে জড়িত।
আমাদের বিশাল বাড়ি। আমার বাড়িতেই মাদক বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। রাতদিন সবসময়ই মাদকের খদ্দরদের যাতায়াত। পরিবেশ ভয়াবহ। আমি শিশুদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ি। চুরি ডাকাতি ছিনতাইসহ বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে কিশোররা। অপরাধীরা সবাই মাদকসেবী। মাদকের টাকা যোগাড় করতেই এসব অপরাধ করছে ওরা।
বিবেকের তাড়নায় আমি এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে পারি নি। শুরু করি “মাদকমুক্ত তারুণ্য চাই” কার্যক্রম।

লেখক: তরুণরা কিভাবে আপনার এ কার্যক্রমে এগিয়ে আসলো?

মুন্না: খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে আমার গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার চেষ্টা শুরু করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতার বার্তা শেয়ার করি। আমার সমমনা কয়েকজন এগিয়ে আসে, ওরা ফুটবল, জার্সিসহ খেলাধুলার বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করে।
স্কুল থেকে ঝরে পড়া ২ জন কিশোরকে কিভাবে স্কুলমুখী করা যায়, এ নিয়ে আমি বেশ চিন্তিত হই। কারণ মাদক পরিবহনে কাজ করতো এরা। এটা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। মা যেহেতু স্কুল শিক্ষক। আমি মা’র সাথে কথা বলি যে, বছরের এই সময়ে ওদের দুইজনকে স্কুলে ভর্তি করানো যায় কি না। মা বললো ওদেরকে রাজি করাতে পারলেই হলো। আমি বললাম ওরা নিজে থেকেই আমাকে বললো। মা অবাক হলো। কারণ মাদক পাচারে নগদ টাকার লোভ ছেড়ে ওরা পড়ালেখা করতে রাজি হয়েছে। স্পোর্টিং ক্লাব করার আগে আমি ওদের বাবা মা’র সাথেও কথা বলেছিলাম, স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে। কিন্তু পড়ালেখা করে পাশ করবে, তারপর চাকরি করবে, সে অনেক দূরের কথা। এখন নগদ টাকা আসছে। তাই ওদের বাবা মাকেও রাজি করাতে পারিনি আমি।
পরবর্তীতে স্পোর্টিং ক্লাবটা একটা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। শিশু কিশোররা স্কুলমুখী হলো। তরুণরা অনেকেই মাদকসেবন ত্যাগ করে সুস্থ জীবন যাপন করতে লাগলো।

লেখক: আপনার এই সামাজিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা আসছিল?

মুন্না: আমার এই কাজে ধীরে ধীরে মাদকের ক্রেতা কমতে থাকলো। যা মাদক ব্যবসায়ীদের পছন্দ হলো না। তারা আমাকে তাদের ব্যবসার জন্য বিরাট হুমকি মনে করলো। তাই ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ খ্রিঃ পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র নিয়ে রাত সাড়ে দশটার সময় আমাকে আক্রমণ করে। আমাকে ও আমার মা’কে হত্যা করাই ছিলো ওদের উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে যাই আমি ও আমার মা।
আমি আক্রান্ত হওয়ার পর ৯৯৯ এ ফোন করলে ওরা সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। কিন্তু কেউ আসেনি আমাকে ও আমার মা’কে উদ্ধার করতে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে আমি সাহায্য চাই। কিন্তু স্থানীয় একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এসে আমাকে স্ট্যাটাস ডিলিট করতে বাধ্য করে। আমি ও আমার মা দুই দিন গৃহবন্দী থাকি। বিভিন্ন জনের কাছে সাহায্য চাই। কেউ এগিয়ে আসেনি। স্থানীয় নেতার হুমকি সত্ত্বেও ফেসবুকে লাইভ করি। পরবর্তীতে স্থানীয় এমপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ হলে উনি তাৎক্ষণিক পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবারো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকি। আমাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলা হয়। বাড়িতে এলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যদের ভয় ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়। সন্দ্বীপ থানায় জিডি করি।
মাদকের থাবা থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার স্বপ্নটা ওরা থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো। হামলা হুমকি ধমকি সত্ত্বেও আমি থেমে যাইনি। নিজের অর্থ শ্রম মেধা ব্যয় করে মাদকবিরোধী জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাই।

লেখক: কিভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন?

মুন্না: প্রথমে লিফলেট তৈরি করি। ছুটে বেড়াই সন্দ্বীপের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করি। মাদকবিরোধী শপথবাক্য পাঠ করাই। শতাধিক মসজিদে জুমার খুৎবায় মাদকবিরোধী বয়ান ও লিফলেট বিতরণ করি।
হাট-বাজারে গিয়ে মাদকবিরোধী জনসচেতনতামূলক পথসভা করি। “খেলাধূলায় বাড়ে বল মাদক ছেড়ে খেলতে চল” শ্লোগানে আয়োজন করি ফুটবল টুর্নামেন্ট।

লেখক: প্রচারণা সরূপ ফলাফল কি পেলেন?

মুন্না: এসব কার্যক্রমের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আসতে থাকে। সারাদেশ থেকে অনেকের সাথে যোগাযোগ হয় আমার। বেশ কয়েকজন সহ সমন্বয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী চেতনা জাগ্রত করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি এখন।
“মাদকমুক্ত তারুণ্য চাই”র উদ্যোগে ১জানুয়ারি’২০২০ তারিখে সারাদেশে একযোগে মাদকবিরোধী শপথগ্রহণ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করা হয়েছে। দেশব্যাপী আয়োজিত এই কার্যক্রমে বিভিন্ন জেলা টিমের সমন্বয়ে সহস্রাধিক তরুণ অংশ নেয়। গ্রহণ করে নতুন বছরে মাদকমুক্ত থাকার শপথ।

লেখক: ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই-

মুন্না: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে সফল করার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার মধ্যে অন্যতম হলো ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবকদের সমন্বয়ে সমাজে মাদক প্রতিরোধী দুর্গ তৈরি করা। শুধুমাত্র সচেতনতা নয়, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত মাদকবিরোধী এই যুদ্ধে প্রতিটি সচেতন মানুষকে সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রত্যেকটি পরিবারকে মাদকবিরোধী দুর্গে পরিণত করতে পারলেই মাদকমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণ করা সম্ভব হবে।
কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লা ভিত্তিক মাদকবিরোধী শপথগ্রহণ ও জনসচেতনতা মূলক আলোচনা কার্যক্রম নিয়মিত চলবে। আয়োজিত হবে অভিভাবক কাউন্সিলিং, থাকবে হাটবাজার ক্যাম্পেইন, উঠান বৈঠক, পথসভা, ধর্মীয় উপাসনালয় ভিত্তিক মাদকবিরোধী প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ ও নিয়মিত খেলাধুলার আয়োজন। প্রতিটি টিম নিজ নিজ অর্থায়নে নিজের এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
আমরা শুরু করেছি, এখন এই কার্যক্রমে যদি সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা থাকে তবে আমরা যে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখি, তা বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।

জিসান মাহমুদ
ইমেইল: mdzisan843@gmail.com
ছবি: সামসুল আজম মুন্না

117 Views

আরও পড়ুন

ক্রিকেট ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি : কোনও রান না দিয়েই ৭ উইকেট

চুয়েট বন্ধ ঘোষণা, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ

এশিয়া এখন জ্বলন্ত উনুন চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ

কাটা হবে ৩ হাজার গাছ, বন বিভাগ বলছে ‘গাছ রক্ষার কোনো সুযোগ নাই’

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে মিয়ানমার সেনাসহ ২৮৮ জনকে ফেরত পাঠালো বিজিবি !! 

শেরপুর প্রেসক্লাবের নয়া কমিটি ॥ দেবশীষ- সভাপতি, মেরাজ সা: সম্পাদক

রাজশাহীতে বিএসটিআই’র অভিযানে ৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা।

শেরপুরে চাঞ্চল্যকর গণধর্ষণ ও পর্নোগ্রাফি মামলার আসামী কানন মিয়া গ্রেফতার

আদমদীঘিতে অবৈধ ভাবে মাটি কাটার অপরাধে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

BIIHR ও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত: নেতৃত্বে জবি শিক্ষার্থী ফয়সাল

পেকুয়ায় বনবিভাগকে ফাঁসাতে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন বনদস্যুরা

পেকুয়ায় বনবিভাগকে ফাঁসাতে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছেন বনদস্যুরা

কুতুব‌দিয়ার ইউ‌পি চেয়ারম্যান আজমগীর কারাগা‌রে