রফিকুল ইসলাম জসিম: ২০২৪ সালের ৫ জুন, বাংলাদেশের উচ্চ আদালত এক রায়ে কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। রায়ের প্রকাশের পরপরই ছাত্রসমাজের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ক্ষোভ—যা দ্রুত রূপ নেয় সারাদেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনে। “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” ব্যানারে একত্রিত হয়ে ছাত্ররা ঘোষণা করে—এটি কেবল কোটার বিরুদ্ধে নয়, এটি একটি সামগ্রিক বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
এই আন্দোলনের নাম হয়ে ওঠে “৩৬ জুলাই আন্দোলন”—এক প্রতীকী সময়, যেখানে তারিখ নয়, প্রতিরোধই প্রধান। শুধু ঢাবি, বুয়েট, জাবি, মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং নয়—সিলেট থেকে খুলনা, রাঙামাটি থেকে পটুয়াখালী—সব জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা দাঁড়িয়েছেন সমঅধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে।
এই আন্দোলনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল মণিপুরী মুসলিম (পাঙাল) শিক্ষার্থীদের সক্রিয় ও সাহসী অংশগ্রহণ। তাঁরা ছিলেন না কেবল সহযোদ্ধা, ছিলেন মিছিলের সম্মুখসারিতে—কখনো প্ল্যাকার্ড হাতে, কখনো মোবাইলের স্ক্রিনে, আবার কখনো ক্যাম্পাসের মাঠে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে পাঙাল জনগোষ্ঠী বারবার প্রান্তে ঠেলে রাখা হয়েছে—তাঁদের সংগ্রাম ও প্রতিবাদ বারবার উপেক্ষিত থেকেছে মূলধারার ইতিহাসে। কিন্তু ৩৬ জুলাই আন্দোলন ছিল সেই বিরল মুহূর্ত, যখন পাঙাল ছাত্ররা একসঙ্গে উচ্চারণ করেছেন—“আমরাও আছি, আমরাও প্রতিবাদ করি।” এই সিরিজ সেই সাহসী কণ্ঠের দলিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের মুহূর্ত ২০২৪ সালের জুলাই। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের দিনগুলো ফিরে দেখতে নিউজ ভিশনের এই প্রয়াস।
আজকের পর্বে তুলে ধরা হলো মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের গোলের হাওর গ্রামের এক অদম্য মেধাবী পাঙাল ছাত্র রফিকুল হাসান-এর অভিজ্ঞতা। তিনি পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের সময় ছিলেন সরাসরি মাঠে।
জুলাইয়ের রক্তাক্ত দিনগুলো: এক মেডিকেল ছাত্রের চোখে দেখা বাস্তবতা
১৫ জুলাই ২০২৪। দেশজুড়ে চলমান ছাত্র আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে আমরা, পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা, রাতে মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিই—পরদিন কলেজ ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করব।
১৬ জুলাই সকাল ১০টায় ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করি। কিন্তু এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রলীগের পটুয়াখালী জেলা শাখা আমাদের ওপর হামলা চালায়। হঠাৎ সেই আক্রমণে ছাত্রী-ছাত্রদের উপর নেমে আসে নির্মমতা। কিছু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।
আত্মরক্ষার জন্য আমরা একাডেমিক বিল্ডিং ও ছাত্র হলে আশ্রয় নিই, কিন্তু সেখানে গিয়েও রক্ষা মেলেনি—হামলাকারীরা হলে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। এই দিনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আতঙ্ক, বিভীষিকা আর নিরাপত্তাহীনতার। ১৬ জুলাই হয়ে ওঠে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজের ইতিহাসের এক কালো দিন।
১৭ জুলাই কলেজ কর্তৃপক্ষ হল ছাড়ার নির্দেশ দিলে আমি পটুয়াখালী থেকে ঢাকার উদ্দেশে বাসে যাত্রা শুরু করি। এক ঘণ্টার মাথায় বাস বরিশালে ঢুকতেই জানা গেল—সামনে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর বাস চললেও, সামনে গিয়ে বুঝলাম বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। চোখের সামনে চলছিল টিয়ারশেলের ধোঁয়া, আগুন, রাবার বুলেটের শব্দ। আহত ছাত্রদের বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে তাদের বন্ধুরা। সংঘর্ষ চলছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত—ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বরিশালজুড়ে।
পুলিশ বারবার যাত্রীদের দিকেও ধাওয়া করে, বাসের জানালার পাশে টিয়ারশেল ছুড়ে মারে, হোস পাইপ দিয়ে গরম পানি নিক্ষেপ করে। এমনকি পাশের বাসের ড্রাইভার গুলি খেয়ে আহত হন। ১১ ঘণ্টা অপেক্ষার পর জানা গেল, কেউ কেউ লঞ্চে করে বরিশাল ছাড়ছে। আমি জানি ঝুঁকি আছে, তবু সাহস করে বাস থেকে নেমে রিকশায় লঞ্চঘাটে যাই।
সারারাত লঞ্চে থেকেও ঘুম আসে না—কেবল অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক। অবশেষে ১৮ জুলাই সকালে ঢাকায় পৌঁছাই, যেদিন সরকার দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করে। কী করব, কোথায় যাব—কিছুই জানি না। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে জুলাই আন্দোলনের আগে শেষ একটি ট্রেন পাই। সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছাই।
বাড়িতে এসেও আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি। সরাসরি মাঠে না থাকলেও, অনলাইনে মতামত দিয়ে গেছি। কিন্তু সেটাও নিরাপদ ছিল না—বিভিন্ন নাম্বার থেকে হুমকির কল আসত, “তুমি রেড এলার্টে আছো, পোস্ট ডিলিট করো, ফোন বন্ধ করো, বাটন ফোন চালাও।”
এভাবেই আতঙ্ক, নিঃসঙ্গতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে দিনগুলো। এরপর হাজারো ছাত্র-জনতার রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে শেষমেশ আসে ৩৬ জুলাই—জুলাই আন্দোলনের অবসান ঘটে।