নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তখন কাজল নামে পরিচিত। মায়ের উদরস্থ চামড়া মোড়ানো পৃথিবী থেকে আলোকিত গ্রহে সদ্য এসেছে মাত্র। বাবা ফয়েজ আহমেদ এবং মা আয়েশা ফয়েজের দাম্পত্য জীবনে চার বছর পর প্রথম সন্তান কাজল। দাদা কিংবা নানার বাড়ির সদস্যদের উচ্ছ্বাসে ভাটা নেই। আনন্দের জোয়ার যেন কমে না। ঠিক তখনই বাবা ফয়েজ আহমেদ তার ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন। একদিন এসে বললেন-
‘কাজলের ভাগ্য গণনা করে ফেলছি!
কী ভাবে করলে?
বইপত্র কিনে পড়াশোনা করছিলাম।
কী আছে ভাগ্যে?
অনেক বিখ্যাত হবে তোমার ছেলে! জান রাণী এলিজাবেথের ছেলে এবং তোমার ছেলের জন্ম একই দিনে, একই লগ্নে?
আমি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসলাম, কোথায় রানী এলিজাবেথ কোথায় আমি:
কাজলের বাবা গম্ভীর হয়ে বলল, রানীর ছেলে বিখ্যাত হবে বাবা মায়ের নামে আর আমার ছেলে বিখ্যাত হবে তার যোগ্যতায়! তুমি দেখে নিও।’
[জীবন যেখানে যেমন ]
ফয়েজ আহমেদ যতদিন জীবিত ছিলেন, ছেলের খ্যাতি দেখে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য – বাস্তব প্রেক্ষাপটে সন্তানের গৌরবান্বিত মুহূর্ত উপভোগ করতে পারেননি। বাবার এমন প্রত্যাশা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও আত্মজীবনীতে বলেছেন।
‘অভাবী সংসারে জন্মদিন পালন করা হতো না। বন্ধুর জন্মদিন পালন হচ্ছে দেখে ছোট বোন শেফা বায়না ধরলো। বাবা বলল, জন্মদিন শুধু একবার পালন করতে পারবো। তবে তোমরা এমনভাবে বড় হও, যেন সব মানুষ তোমাদের জন্মদিন পালন করে।’
[আমার ছেলেবেলা]
বাবা ফয়েজ আহমেদের কথামতো হুমায়ূন আহমেদ বিখ্যাত হয়েছিলেন তার যোগ্যতা দিয়ে। কতটুকু বিখ্যাত হয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে বরাবরই মাতামাতি ছিল। পাঠক এবং ভক্তদের বাড়াবাড়ি ছিল। তার সৃষ্ট চরিত্র হিমুকে নিজের মধ্যে ধারণ করে নিতে তরুণদের উদ্দীপনার কমতি ছিল না। কিন্তু বাস্তবে কি কেউ হিমু হতে পারবে? হয়তো পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে, খালি পায়ে ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে হিমুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করা দূরহ। হিমু তো স্বাধীনচেতা মানুষের- যা ইচ্ছে তা করতে পারার স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্ট একটা চরিত্র মাত্র। কাল্পনিক চরিত্রকে যেভাবে সৃষ্টি করা যায় ঠিক অনুরূপভাবে নিজের চরিত্রকে গড়া যায় না। চরিত্র গঠন আর গল্প উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র গঠন এক নয়। ভিন্নতা অনেক।
হুমায়ূন আহমেদ নিজেও স্বাধীনচেতা ছিলেন। নিজের ইচ্ছেটাকে বড় করে দেখে কল্যাণকর কিছু সৃষ্টি করে গেছেন। হাজার অনুরোধেও কখনও নিজের মত এবং সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনচিত্র কলমের কালিতে অঙ্কন করা এ মহান মানুষটা সাহিত্য সংস্কৃতির যে অংশে হাত দিয়েছেন তা মাটি থেকে সোনায় রূপ নিয়েছে।
সাহিত্যের ন্যায় চলচ্চিত্র জগতেও তার অবদান এবং সৃষ্টিকর্ম অনন্য। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রে তার কর্ম বহুকাল জীবিত থাকবে এবং তাকেও জীবিত রাখবে। বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে প্রতিবেদক ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্র নিয়ে দর্শকদের মাতামাতি এবং পাগলামো বিষয়ে নিজেকে অবাক করে কিনা জানতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদ বলেন- অবাক তো অবশ্য করে। দর্শক মাতামাতি করবে সেটা স্বাভাবিক, বাকের ভাইয়ের মুক্তি চেয়ে মিছিল করবে সেটাও স্বাভাবিক কিন্তু তার কুলখানি করাবে, মৃত বাকেরে আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল করবে এটা অভাবনীয় ছিল এবং সত্যিই অবাক করার মতো।
এমন কিংবদন্তি সৃষ্টিশীল হুমায়ূন আহমেদেরা গডগিফটেড হয়। এবং তারা একবারই জন্ম নেয়। এবং যুগযুগান্তর বেঁচে থাকার জন্য তাদের অন্যন্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটায়।
আমরা হুমায়ূনদের সৃষ্ট কর্মকে যত না মূল্যায়ন করি, তারচেয়ে বড় একটা প্রশ্ন, চিন্তা এবং ধ্যানধারণা লালন করি সেটা হলো – হুমায়ূন আহমেদ আস্তিক ছিলেন নাকি নাস্তিক ছিলেন। জীবিত কিংবা মৃত হুমায়ূনকে শতকোটিবার মুখোমুখি হতে হয়েছে অভিন্ন এ প্রশ্নের – আপনি আস্তিক না নাস্তিক?
আস্তিক নাস্তিক বিশ্বাসের বিষয়। মনের বিশ্বাস। কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির মননশীল লেখকদের ন্যায় হুমায়ূন আহমেদকে কখনও ধর্মের বিপক্ষে বিরূপ মন্তব্য কিংবা অযাচিত উক্তি ডেলিভারি দিয়ে আলোচিত সমালোচিত হতে দেখা যায়নি। তারপরও আপনি আস্তিক না নাস্তিক – তা জানাতেই হবে। এ আমাদের আবেগী ধার্মিকদের পূণ্যময় দায়িত্ব।
মৃত্যুর আগে হুমায়ূন আহমেদ নিজেও এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন।
‘অপারেশন হবে ভোর ন’টায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?
হ্যাঁ।
কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্যে তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?…
আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই।
তোমার অপারেশনটি জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি।একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন।
ডিসকাউন্টের প্রার্থনাতেও আমার বিশ্বাস নেই।
তুমি কি নাস্তিক?
আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী না।
[ফাউন্টেনপেন]
নাস্তিক ছিলেন কি আস্তিক ছিলেন আমি নিজেও জানি না। কারণ সেটা মনের বিষয়। কিন্তু তিনি যে মুসলিম ছিলেন, আল্লাহ রাসুলকে বিশ্বাস করতে তা জেনেছি। রাসুল (সা.) এর আদর্শকে খৃস্টান পাদ্রির কাছে উপস্থাপন করে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা.) প্রমোট করেছেন বলে তার এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ রয়েছে।
‘আমি যখন পিএইচডির শেষ পর্যায়ে তখন আমার কাছে খ্রিস্টান পাদ্রিরা আসতে শুরু করল। তারা মনে করল, একজন বিধর্মীকে ওদের ধর্মে নিয়ে গেলে ওদের জন্য সুবিধা।আমি দেখলাম, ওরা প্রচুর পড়াশোনা করে, জানে।…আমি আমাদের প্রফেটকে হাইলাইট করার জন্য এক পাদ্রিকে বললাম যে, শোনো, আমাদের প্রফেট ছিলেন এমনই একজন মানুষ, তিনি যখন কারও সঙ্গে কথা বলতেন, তখন সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন। তিনি যার সঙ্গে কথা বলতেন, তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে বলতেন না, তিনি পুরো বডিকে তার দিকে টার্ন করতেন, যাতে সে মনে করে তাকে ফুল অ্যাটেনশন দেওয়া হচ্ছে। শুনে পাদ্রি বললেন, দেখুন, স্পন্ডিলাইটিস বলে একটা ডিজিজ আছে যে ডিজিজে ঘাড়ের চামড়া শক্ত হয়ে যায়, আপনাদের প্রফেটের ছিল স্পন্ডিলাইটিস ডিজিজ। উনি ঘাড় ফেরাতে পারতেন না বলে পুরো শরীর অন্যের দিকে ফেরাতেন।…তখন গড আমাকে হেল্প করল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটা লজিক দিয়ে দিলেন এবং লজিকটা আমার তাৎক্ষণিকভাবে আসা।… আমি বললাম, আপনার কথাটা ভুল। আমাদের নামাজ পড়ার একটা সিস্টেম আছে, সিস্টেমে মাথা ফেরাতে হয়। আমাদের প্রফেটের যদি স্পন্ডালাইটিস ডিজিজ থাকত, তাহলে তিনি পুরো শরীর ফেরাতেন, উনি তো তা করেন না। তার এই ডিজিজ ছিল না, তিনি যেটা করতেন তা শ্রদ্ধার জায়গা থেকে করতেন।…তিনি আমার কাছে ক্ষমা পার্থনা করলেন এবং বললেন, তোমার লজিক খুব পরিষ্কার,আসলেই তো তোমরা নামাজের সময় দুই দিকে মাথা ফেরাও।’
শিলালিপি(দৈনিক কালের কন্ঠ),২৭ জুলাই ২০১২
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ধর্মীয় রাহাবর নয়। কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি আমার গুরু। সাহিত্যের বিবেচনায় অনন্য উচ্চতায় রাখি তাঁকে। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা। সেই সাথে শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক :
মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
তরুণ গল্পকার
379 Views