মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম :
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও সংহতির দিন আজ। দিনটিকে আমরা মে দিবস বলেও জানি। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রম অধিকার আদায়ের এ দিনটি বছরের পর বছর ধরে বিশ্বব্যাপী যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। শ্রমিকদের সম্মানে মে দিবস বা পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশ। কিন্তু যাঁদের নিয়ে এই দিবস, তাঁরা এ সম্পর্কে কতটা অবগত? অনেক শ্রমিক জানেনই না এর রক্তমাখা ইতিহাস।
উনিশ শতকের আগে কল কারখানার শ্রমিকদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশি। কিন্তু কাজ অনুপাতে পারিশ্রমিক ছিল নগন্ন। যা তাঁদের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট ছিল না। একটা পর্যায়ে শ্রমিকপক্ষ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। এ ক্ষোভের দানা এক সময় আন্দোলনে রূপ নেয়।
১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের গুটিকয়েক শ্রমিক মালিকপক্ষকে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণের দাবি জানায়। এ দাবি আদায়ের লক্ষে ১৮৮৬ সালের ১ মে নির্ধারণ করেন শ্রমিকেরা। কিন্তু কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের এ দাবি কর্ণপাত করেনরি। ফলে ক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট নামক স্থানে ফের আন্দোলন গড়ে তোলেন। গুলি চালিয়ে প্রশাসন তাদের আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। দাবী আদায়ে নিবেদিতপ্রাণ শ্রমিকরা সেদিন গুলির সামনে হার মানেনি। পুলিশ নিরীহ শ্রমিক জনতার উপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করলে নিহত হন ১০/ ১২ জন শ্রমিক এবং পরবর্তীতে আন্দোলন করার অপরাধে কয়েকজন শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ড ও দেওয়া হয়েছিল । এভাবে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে শ্রমিক শ্রেণি প্রতিষ্ঠিত করেছিল দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সম্মেলনে নির্দিষ্ট শ্রম ঘণ্টা নির্ধারণের পর বেতন বৈষম্য দূর করা, ন্যূনতম মজুরি, নিয়োগপত্র প্রদানের মতো বিষয়ও শ্রমিকদের জোরালো দাবিতে পরিণত হয়।
আজকের মহান মে দিবসের পথ ধরেই শ্রমিকদের নানা অধিকার অর্জিত হয়েছে। সেই সঙ্গে নিজেদের ও তাদের শ্রমের মর্যাদা পেয়েছে গুরুত্ব। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের দাবী আদায়ের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। উন্নত দেশে এখন শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কাজের পরিবেশও হয়েছে উন্নত। তবে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশা ঘোচেনি। আমাদের বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
শ্রমিক শ্রেণির অধিকার দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হলেও তা মানা হচ্ছে না । অনেক শিল্প-কারখানায় আইএলও নির্ধারিত শ্রমঘণ্টাও মানা হয় না। দেশে শ্রমিক শ্রেণি শুধু ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রায়ই মরতে হয় তাদের। কিন্ত এসব দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বা আহত হওয়া শ্রমিকদের জীবন কিছু কিছু কারখানা মালিকদের কাছে ফার্মের পশু মারা যাওয়ার মত। অবশ্যই এ ক্ষেত্রে গুটিকয়েক কারখানা মালিক মানবিকতার পরিচয় দিতে দেখা যায়। আহত শ্রমিকদের উন্নত চিকিসা সহ মৃত শ্রমিক পরিবারে যথাযথ ক্ষতিপুরণ প্রদান করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে দেশের সব কারখানায় শ্রম আইন প্রতিপালন সহ তাদের এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে তাদের জীবন ও শ্রমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মে দিবসে শ্রমিক শ্রেণির মানবেতর জীবনের অবসান ঘটানোর অঙ্গীকার করতে হবে আমাদের সবাইকে। সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো, সব ক্ষেত্রে শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত করা। উন্নত বা অনুন্নত সব রাষ্ট্রে এখনো শ্রমিক শ্রেণি সামাজিকভাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি । সমাজের অন্যান্য পেশার মানুষের মতো শ্রমিকদেরও একটি মর্যাদাসম্পন্ন শ্রেণি হিসাবে দেখা উচিত আমাদের।
মহান মে দিবসে দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের প্রতি রইল হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ।
কবি নজরুল ও তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে লিখেছেন-
আসিতেছে শুভদিন,
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!
হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর,
মুটে ও কুলি… কুলি-মজুর কবিতায় কবি নজরুল এভাবেই করেন শ্রমজীবী মানুষের বন্দনা।
মে দিবসের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও দিবস ঘোষণা :
শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রমিকদের তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে তাঁরা মে দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন ও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আমরা মে দিবস পালন করি, সেটি কতটা সফল হয়, তা নিতে প্রশ্ন আসতে পারে। আসাটা বেশ স্বাভাবিক।
মে দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও কিছু মানুষ রুটিরুজির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন কাজে। কারণ এক বেলা কাজ না করলে তাঁর পরিবারকে থাকতে হবে অনাহারে। কারও কারও আবার মেলে না ছুটি। ছুটির দিনে কাজের জন্য জোটে না বাড়তি ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময়ের পয়সা। আট ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিয়ম চোখে পড়ার মতো। কাজ করতে হচ্ছে আট ঘণ্টার অধিক।
আজকের দিনে মে দিবস পালন এসব মানুষের কাছে একপ্রকার বিলাসিতাই। নাটকে অভিনয় করার মত।
ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার :
শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জীবন ব্যবস্থা ইসলাম শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের কথা গুরুত্বের সাখে বলেছে। শ্রমিকদের প্রতি ন্যায় বিচারের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম শ্রমের প্রতি যেমন মানুষকে উৎসাহিত করেছে (জুম‘আহ ১০), তেমনি শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পূর্ণ প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কারণ যারা মানুষের সুখের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়, তারাতো মহান আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী।
শ্রমের মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ خَيْرًا مِنْ أَنْ يَّأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ وَإِنَّ نَبِىَّ اللهِ دَاؤُوْدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدَيْهِ- ‘কারো জন্য স্বহস্তের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য আর নেই। আর আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) স্বহস্তে জীবিকা নির্বাহ করতেন’।[1]
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। আর একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবী হ’ল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أُعْطُوا الْأََجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَّجِفَّ عَرقُهُ- ‘তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’।[2]
রক্তসিক্ত ইতিহাস মিশ্রিত মহান দিবসটি সফল হবে যদি সর্বত্রে শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়।
একজন শ্রমিকও অধিকার বঞ্চিত হবেনা যদি কল কারখানায় ইসলামের আলোকে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক রক্ষা করা হয়। তবেই সফল মে দিবস উদযাপন।
—–
লেখক :
সম্পাদক ও প্রকাশক
নিউজ ভিশন বিডি