আরিফ ইকবাল নূর
————–
বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করে নিজেদের সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহারলাল নেহেরু বলেছিলেন, একটি দেশ ভালো হয়, যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়। বর্তমান সময়ে অবশ্য এই উক্তিটি জাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হারিয়েছি। যে আবরার এইচএসএসি তে ঢাকা বোর্ডে টপ ২০তে ছিল। নটরডেম কলেজের তার ব্যাচের সেরাদের একজন হলো ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ সাবজেক্ট জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পেয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও চান্স পেয়েছিল।বিদেশের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে নিউক্লিয়ার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এসব জায়গাতে ভর্তি না হয়ে সে বুয়েটের টপ সাবজেক্ট তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে তে ভর্তি হয়। একজন আবরার বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিতে পারত। কিন্তু আমরা আজ তাকে হারিয়েছি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সবসময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগে থাকে। আবাসন সংকট, মিছিল মিটিং ইত্যাদীতে ব্যস্ত ঢাবির ক্যাম্পাস। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে দেশের অবস্থা কেমন হবে?
বর্তমানে শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড। আর সে মেরুদন্ড গড়ার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কর্ণধার ভাবা হয়। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজের চরিত্রেই যেন ঘুণে ধরেছে। সম্প্রতি বেশ ক’জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ঘুষ এবং বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। যা একটি জাতির জন্য হুমকি। যারা জাতীকে সঠিক পথ দেখাবে তারা যদি অভিশপ্ত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের কাছ থেকে জাতি কি আশা করতে পারে! একজন আদর্শবান শিক্ষক একটি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন আবার একজন চরিত্রহীন শিক্ষক একটি সমাজকে ধ্বংসও করে দিতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্বন্ধ অত্যন্ত সত্য হওয়া দরকার। বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তি-স্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তাহলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন। আজ নিজেকে হতভাগ্য মনে হয়। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভক্তি-স্নেহের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আজ ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। মিশেল ফুকোর মতে, আমাদের সমজাটা বিশাল কারাগার। প্রতিটা প্রতিষ্ঠান কারাগার।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্টানে বাচ্চাদেরকে গাধা গাধা বই পড়ানো হয়। রবী ঠাকুরের ‘তোতা কাহিনী’ তে বর্ণিত তোতা পাখিকে শিক্ষা দেওয়ার মতো। রাজা তাঁর মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, পাখিটাকে শিক্ষা দাও। তোতা পাখিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রথমে একটা খাঁচা তৈরি করা হলো। তারপর খাঁচার উন্নতি সাধনের চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু খাঁচায় দানা, পানি নেই। কেবল রাশি রাশি পুঁথি থেকে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়ে মুখের মধ্যে ঠাসা হচ্ছে। গান তো বন্ধই, চিৎকার করার ফাঁকটুকু পর্যন্ত নেই। তারপর একদিন পাখিটি মারা গেল।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও তোতা পাখির খাঁচা বানানোর মতো। আমাদের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করানো হয়েছে, তা তো পাখি মারার খাঁচার মতোই। ইদানীং বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর আত্মাহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শারিরীক শাস্তি অব্যহত রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের মৌখিক শাস্তি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। কিছুদিন আগে অভিভাবককে স্কুলে ডেকে এনে অপমানিত করার কারণে এক শিক্ষার্থী আত্মাহত্যা করেছে।
বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ইন্টারভিউ নামক একটি নাটকে আনিসুল হক বলেছেন, স্কুলে বাচ্চারা শিখতে আসবে, তারা তো জজ-ব্যারিস্টার হয়ে এসে ভর্তি পরীক্ষা দেবে না। আর স্কুল হতে হবে সবার জন্য, যেখানে কালো-ফরসা, ধনী-গরীব, আইকিউ বেশি, আইকিউ কম, কথা বলতে পারে, কথা বলতে পারে না-সবার সমান সুযোগ থাকবে, কোন ধরনের বৈষম্য থাকবে না। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সন্তান ভর্তি করাতে হলে অভিভাবকের নিদিষ্ট পরিমাণ মাসিক আয় থাকতে হয়। সরকারের উচিত ব্যবসায়ী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্টানগুলো বন্ধ করে দেওয়া।
আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মেরুদণ্ডহীন ভাবে দাঁড় করিয়েছি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্টানের অবস্থা বলার মতো না। যা জাতির কাছে দৃশ্যমান। আমাদের এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ ভুমিকা পালন করতে হবে। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক শিক্ষাপ্রতিষ্টান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষকদেরকে মানবিক হতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে সিলেবাসের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, আউট বই পড়া, সংস্কৃতির চর্চা এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আনন্দহীন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা, শিক্ষা নয়, যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। রবীনন্দ্রনাথ আনন্দহীন শিক্ষা প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, অন্য দেশের ছেলে যে বয়সে নবোদগত দন্তে আনন্দমনে ইক্ষু চর্চন করিতেছে, বাঙালির ছেলে তখন স্কুলের বেঞ্চির উপর কোঁচা সমেত দুইখানি শীর্ণ খর্ব চরণ দোদুল্যমান করিয়া শুধুমাত্র বেত হজম করিতেছে, মাষ্টারের কুট গালি ছাড়া তাহাতে তার কোনরূপ মশলা মিশানো নাই। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্টানে আনন্দমূলক ও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর শিক্ষককেও আনন্দমূলক শিক্ষার কৌশল রপ্ত করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নাটকীয় ভঙ্গিমায় চিত্তাকর্ষক পাঠদান করতে হবে। শিশুর মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। এতে করে তাদের কোমল মনে চিন্তার প্রসারতা ঘটবে। তার মনে বিশ্বকে জয় করার মানসিকতা গড়ে উঠবে। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অদেখাকে দেখার চরম ইচ্ছা জাগ্রত হবে।
বাংলাদেশে যারা ভালো মেধাবী তারা ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আর মধ্যম মানের ছাত্রেরা বাধ্য হয়ে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হয়। ফিনল্যান্ড বা নরওয়ের মতো নরডিক দেশগুলোতে শিক্ষক হতে হলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা বাধ্যতামূলক। ভালো ছাত্রদের সেখানে সর্বোচ্চ বেতন দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্নচিন্তা যার চমৎকার, জ্ঞানচর্চা তার দ্বারা হয়ে ওঠে না। শুধু শ্রদ্ধায় চিড়া ভিজে না। আমাদের দেশেও শিক্ষককে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে সর্বোচ্চ বেতন দিতে হবে। বেতন যদি আকর্ষণীয় হয়, তবে পিএইচডিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেই-বা সমস্যা কী? ডিগ্রি তো থাকতেই হবে, কিন্তু দেখতে হবে শিক্ষাদানে আগ্রহী, চৌকষ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরাই যেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। এ ধরনের শিক্ষক খুঁজে বের করতে হলে আমাদের নিয়োগকর্তাদেরও সমভাবে চৌকষ হতে হবে।
শিশুর শিক্ষার জন্যে সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজ হতে হবে শিশুর শিক্ষার উপযোগী। শিশুর বিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সমাজের দায়িত্ব। সমাজকে শিশুর চিত্তবিনোদনের জন্য খেলার মাঠ, ক্লাব, পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। বৃত্তিমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের সামাজিকভাবে উৎসাহিত করতে হবে। সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে, শিশুর অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সু-ব্যবস্থা। বিদ্যালয় থেকে শিশু শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়া রোধে এগিয়ে আসতে হবে সমাজের মানুষকে। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা, বেড়ে উঠা, আচরণ সহ সকল বিষয়ে সমাজের মানুষকে সচেতন ও সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মূলকথা হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্টানগুলো ভালো হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। আলোকিত মানুষ তৈরি হলে দেশও উন্নত হবে।
আরিফ ইকবাল নূর
শিক্ষার্থী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।