–কাজী আশফিক রাসেল :
নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে সেনাবাহিনীর গুলিতে মো. হাবিব নামের একজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। কয়েক দিন ধরে ছাঁটাই বন্ধ ও ন্যায্য পাওনা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছিল শ্রমিকরা। হঠাৎ করে কর্তৃপক্ষ কোম্পানি বন্ধের ঘোষণা দিলে বিক্ষুব্ধ হাজারো শ্রমিক গেটে তালা ঝুলিয়ে দিলে উত্তেজনা বাড়ে। অথচ একই সময়ে ঢাকায় নিষিদ্ধ লীগের মিছিলে কোনো লাঠিচার্জ হয়নি, গুলি তো দূরের কথা। প্রশ্ন উঠছে, শ্রমিকের ন্যায্য আন্দোলনে গুলি, কিন্তু নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর বেলায় নীরবতা কেন?
এর আগে রাজধানীর বিজয়নগরে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর যে বর্বর হামলা চালানো হয়েছে, তার রেশ এখনো কাটেনি। শুধু নুর নন, অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীও আহত হয়েছেন পুলিশের লাঠিপেটা ও সেনাসদস্যদের মারধরে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার এইভাবে রক্তাক্ত হওয়া কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে বহমান অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ।
ভিপি নুরকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের হাজারটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সেই নুরের ওপর হামলা শুধু পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রতিশোধপরায়ণতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং জনগণকেন্দ্রিক শক্তিকে দমন করার পরিকল্পিত প্রয়াস।
অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে ভিপি নুরকে নৃশংসভাবে পেটানোর দৃশ্যটি জনমনে প্রশ্ন তুলেছে, এটাই কি তাহলে গত একবছরে অন্তবর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের নমুনা? যে নিরাপত্তাবাহিনী জনগণের সেবক হওয়ার কথা, তারা কেন এখনো পুরোনো স্টাইলে জনগণের ওপর দমনযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? তবে উত্তরও খুব স্পষ্ট। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে এখনো শক্ত অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী দোসর ও ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির লালিত উপাদান। শুধু রাজনীতিতেই নয়, পুলিশ, সেনাবাহিনী এমনকি গণমাধ্যমের ভেতরেও এই দোসররা সক্রিয়। জনগণের রক্তের বিনিময়ে তারা বহিরাগত শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এ হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে। গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হলেও, তাদের সহযোগী জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ ব্যাপারে গড়িমসি সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় পার্টি সবসময়ই স্বৈরতন্ত্র ও ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির পুতুল হিসেবে পরিচিত। এরশাদের আমল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের প্রতিটি দুঃশাসনের সময়ে তারা ছিল অবিচ্ছেদ্য সহযোগী। জনগণের স্বার্থের বদলে তারা সবসময় বহিরাগত এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে।
চব্বিশের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা ভেবেছিলাম, বাংলাদেশ এক নতুন সূর্যোদয়ের পথে হাঁটছে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলের অবসানে খুন, গুম, অপহরণ ও দমননীতি থেমে যাবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরে আসবে, আর নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হলেও তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সাফল্য দেখাতে পারেনি। বরং চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে নিয়মিতভাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি এখনপর্যন্ত একটি সঠিক বিচারের উদাহরণ দাঁড় করাতে পেরেছে? উত্তর হবে – না।
বর্তমান সরকারের অধিকাংশ উপদেষ্টার কার্যক্রম দেখে মনে হয়, তারা যেন নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ও সুবিধা সুরক্ষিত রাখতে বেশি ব্যস্ত। নীতিনিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হলে যে বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়, তা এড়িয়ে চলাই যেন তাদের কৌশল। আমরা দেখছি, গণমাধ্যম , প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সেক্টরের স্তরে স্তরে এখনও স্বৈরাচারী দোসররা বহাল তবিয়তে আছে। দুঃখজনকভাবে, এর দায় বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের যেমন, তেমনি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অবদান রাখা রাজনৈতিক দলগুলোরও। গোপন যোগসাজশ ও সুবিধাবাদী সমঝোতার মাধ্যমে পুরনো অপশক্তিগুলোকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক দার্শনিক ফ্রানৎস ফ্যানন একবার বলেছিলেন, “যে উপনিবেশ কখনো মুক্তি পায় না, সেখানে শুধু শাসকের মুখ পাল্টায়, কিন্তু কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে।” আজকের বাংলাদেশে সেটাই ঘটছে। আওয়ামী লীগ সরলেও তাদের দোসররা পুলিশ, সেনা ও মিডিয়ার ভেতরে থেকে জনগণের মুক্তি রোধ করছে। এটাই আমাদের প্রকৃত বিপদ।
এই হামলার পর করণীয় নিয়ে দ্বিধার অবকাশ নেই। প্রথমত, জাতীয় পার্টির মতো দোসর দলগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে শুদ্ধ করতে হবে; ভারতীয় দোসর উপাদান চিহ্নিত করে অপসারণ করতে হবে। তৃতীয়ত, গণমাধ্যমকে জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে; দোসর সাংবাদিকদের হাতে তথ্যযুদ্ধের অস্ত্র তুলে দেওয়া চলবে না।
মনে রাখতে হবে, মানবদেহে যদি রক্তেই বিষ মিশে যায়, তবে শুধু বাহ্যিক চিকিৎসা দিয়ে রোগ সারে না। হৃদপিণ্ডে নতুন পেসমেকার বসালেও, যদি শিরা-উপশিরায় বিষাক্ত রক্ত বইতে থাকে, তবে পুরো দেহই ধীরে ধীরে পঙ্গু হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র আজ সেই বিষাক্ত রক্তসঞ্চালনের মতো। পুলিশ হলো বাহুর শিরা, সেনাবাহিনী মেরুদণ্ড, প্রশাসন মস্তিষ্কের স্নায়ু আর গণমাধ্যম চোখের দৃষ্টি। প্রতিটি জায়গাতেই ফ্যাসিস্ট দোসররা বিষ ঢেলে রেখেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিল, রক্ত বদল হবে, নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে দেহ জেগে উঠবে। কিন্তু দেখা গেল, শুধু হার্টে নতুন পাম্প লাগানো হয়েছে, অথচ পুরোনো বিষাক্ত রক্তই সারা শরীরে বইছে।
রাষ্ট্রকে সুস্থ করতে হলে তাই শুধু নেতৃত্ব বদল নয়, গোটা রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থার পূর্ণ শুদ্ধি দরকার। নইলে ‘নয়া বাংলাদেশ’ কেবলই ভাঙা শরীরের নতুন সাজসজ্জা হয়ে থাকবে। গণঅভ্যুত্থান তখনই সফল হয় যখন জনগণের শত্রুপ্রবণ রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে নতুন কাঠামো দাঁড় করানো হয়। যদি সেই পুরোনো দমনযন্ত্রই অক্ষত থাকে, তবে অভ্যুত্থান আংশিক বা পুরোপুরি ব্যর্থ বলা ছাড়া উপায় নেই।
লেখকঃ তরুণ কলামিস্ট ও হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট।