মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ফটিকছড়ি উপজেলার অবিভক্ত ১৩ নম্বর রোসাংগিরি ইউনিয়নে বর্তমানে ১৯ নম্বর সমিতিরহাট ইউনিয়নে অবস্থিত আরবান আলী সওদাগর বাড়ীটি ছিল এই পথে বিভিন্ন দিকে ছুটে চলা সাধারণ মানুষের এবং মুক্তিবাহিনীর আবাসস্থল এবং যাত্রাবিরতির ট্রানজিট পয়েন্ট। ২৫ মার্চের কালো রাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত পাক বাহিনী ঘুমন্ত নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর বর্বরোচিত নারকীয় মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। অপারেশন চার্চলাইট নামের এ অপারেশন শুরু হওয়ার পরে শহর থেকে মানুষ গ্রামে এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে স্রোতের মতো ছুটতে শুরু করে। আমাদের বাড়ির হালদা নদীর পাড়ে। নৌকা দিয়ে যাতায়াতকারীদের অনেকেই আমাদের বাড়ীতে দুপুরের বা রাতের খাবার, চিড়া মুড়ি গুড় খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছেন। কলেজ ইউনিভার্সিটির অনেক ছাত্র শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ভারতে যাত্রার প্রাক্কালে আমাদের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় নিয়েছে। তৎমধ্যে আমাদের আত্মীয় ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু সি এন্ড সি স্পেশাল (রাউজান), তাঁর বন্ধু খায়রুল আনোয়ার সবেক মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রিয়ভাজন এবং তাঁর সেক্রেট্রারি মোজাম্মেল হক পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন তাঁরা ভারতে যাওয়ার সময় আমাদের আবড়িতে অবস্থান করেন। আরও অনেকেই ছিলেন যাঁদের পরিচয় আমাদের অজানা রয়ে গেছে যা আমাদের পূর্ব পুরুষদের জানা ছিল। দুর্ভাগ্য তাঁদের কেউই এখন জীবিত নেই। ট্রেনিং শেষে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করতেন এবং এখান থেকে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা হামলা চালাতেন। তাঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদের বাড়িতেই হতো এবং এসব বিষয় নীরবে তদারক করতেন আমার মেঝ চাচা মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী। পরে জানতে পেরেছি ভারত থেকে ট্রনিং শেষে অনেকেই আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করেছেন তাঁদের অনেকের পরিচয় আমাদের অজানা। হাট হাজারীর সি এন্ড সি স্পেশাল বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম হাজী এস এম কামাল উদ্দিন ভারত থেকে ফেরার পথে তাঁর টিম নিয়ে আমাদের বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন। পরবর্তীকালে তিনি আমার ভগ্নীপতি হওয়ার সুবাদে এ তথ্য পেয়েছি। বোয়ালখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সদ্য প্রয়াত সৈয়দ আহমদ আত্মীয়তার সুবাদে জানতে আমাদের বাড়িতে ছিলেন ভারত থেকে ফেরার সময়। হাট হাজারীর সাবেক এম পি ওয়াহাব মিয়াঁর জামাতা মীনুদ্দিনসহ অনেকেই আমাদের বাড়িতে রাত্রি যাপন করেছেন।
মুক্তি বাহিনী আমাদের বাড়ীতে থাকে এবং এখান থেকে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হয় এই তথ্য ফজলুল কাদের চৌধুরীর কাছে পৌঁছালে আগষ্ট মাসে বিরাট বিরাট কয়েকটি নৌকাযোগে নাজির হাট থেকে বিরাট পাক হানাদার বাহিনী ভোররাতে আমাদের বাড়ীকে টার্গেট করে বিরাট এলাকা ঘিরে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে তার দুইদিন আগে আমার সেঝ ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আক্তারুল আলম বাবু গ্রামের এগার জন যুবককে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান। তাছাড়া ঐ রাতে আমাদের বিরাট কাছারি ঘরে মুক্তিবাহিনীর কেউ ছিল না। ছিল না কোন অস্ত্রশত্রও। আমাদের বাড়ীর এবং গ্রামের সব পুরুষদেরকে হালদা নদীর ছড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বারবার জানতে চায় মুক্তি কাহা হ্যাঁয়। আমার মেঝ চাচা মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী অবিভক্ত ১৩ নম্বর রোসাংগিরি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান যিনি আবার ফজল কাদের চৌধুররীর বন্ধু ছিলেন তাঁকে খুঁজতে থাকেন। খুঁজতে থাকেন আমার মেঝ ভাই মুক্তিযুদ্ধের একজন সংঘটক ৪৯ চন্দনপুরাস্থ অরোরা প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী মরহুম মোহাম্মদ শহীদুল আলম চৌধুরী বেবিকে। সেদিন তাঁরা আমাদের শহরের দেওয়ান বাজারের বাসায় অবস্থান করছিলেন। জনাব বেবির প্রেসে মুক্তিযোদ্ধা এবং সংঘটকদের বিভিন্ন সময়ে গোপন বৈঠক চলতো। তাঁর প্রেসে বসেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাড়ি আক্রমণের বৈঠক হয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ মাহফুজুল হক এবং প্রথিতযশা সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরী এ বিষয় নিয়ে দৈনিক আজাদীতে লিখেছেন। দুঃখজনকভাবে শহীদুল আলম চৌধুরী ২৮ নভেম্বর চান্দগাওয়ের সাবেক এম পি হারুন উর রশিদসহ আল বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। মীর কাশেমের টর্চার সেল ডালিম হোটেলে তাঁরা দুইজন নির্মম নিষ্ঠুর বর্বরোচিত নির্যাতনের তিনি শিকার হন। বিভিন্নভাবে তদবির করে ডিসেম্বর মাসের সম্ভবত ১০ তারিখের দিকে তাঁকে সেখান থেকে মুক্ত করে আনেন আমার বড়ভাই সাবেক ইউনাইটেড ব্যাংকের অফিসার (জনতা ব্যাংক), ফুফাতো ভাই মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর বড় সন্তান ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র এবং হাবিব ব্যংকের ( অগ্রণী) অফিসার মরহুম আবুল হাসনাত চৌধুরী খসরু, আমাদের আরেক ফুফাতো ভাই নিউ মার্কেটের ফটোরমার স্ত্বাধিকারি এবং ক্যান্টনমেন্টের ফটোগ্রাফার মীর্জা মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম এবং আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু তৎকালীন পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের অবাঙ্গালী অফিসার হাশেমী সাহেবদের আন্তরিক তৎপরতায় তিনি ছাড়া পান।
এদিকে আমার বাবাসহ বাড়ির এবং গ্রামের সব পুরুষদেরকে মোটা রশি দিয়ে বেঁধে নাজির হাট সেনাক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুরে মোটা রুটি এবং ডাল দিয়ে খাবার দেয়া হয় তাঁদেরকে। এবং আগে উল্লেখিত ব্যক্তিদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সন্ধ্যায় সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। দুইজন বাদে। এই দুইজন শহীদকে কি ধরণের নির্যাতন করা হয়েছে বা কোথায় কখন মারা হয়েছে সেটা সকলের কাছে অদ্যাবধি অজানাই রয়ে গেছে। অপরদিকে মহিলাদের বাড়ির পুকুরের পূর্ব পাড়ে নিয়ে জড়ো করে বসিয়ে রাখা হয়। এবং সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাসি করা হয়। অস্ত্র, বিষ্পোরক দ্রব্য, গ্রানেডসহ যুদ্ধে ব্যবহৃত কিছুই পাওয়া যাইনি। তথাপি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার জন্যে গান পাউডার ছিটানো হয়। বাড়ীর নারীদের এবং আমাদের মেঝবোনের সাহসিকতার সঙ্গে কমান্ড অফিসারের কাছে জোর গলায় বলেন আমাদের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী থাকেনা এবং কোনো ধরণের অস্ত্রশস্রও নেই। এমতাবস্থায় বাড়িটি জ্বালিয়ে দিলে আমরা এতগুলো নারী শিশু কিভাবে কোথায় রাত কাটাবো। পরবর্তীতে সেই কমান্ডার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে সর্বশেষ অবস্থা ব্যাখ্যা করলে অপর প্রান্ত থেকে ফজলুল কাদের চৌধুরী ঘর না জ্বালিয়ে তাঁর টিমকে ব্যারাকে ফিরে যেতে আদেশ দেন। তখন আমাদের বাড়ি ভর্তি শহরের এবং বিভিন্ন স্থানের আত্মীয় স্বজনে ভরপুর ছিল। সীতাকুন্ডের আওয়ামীলীগ নেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ এখলাস উদ্দিনের বাড়ী জ্বালিয়ে দিলে আমাদের তাঁর পরিবারের সবাই এখানে অবস্থান করেন, আমার ফুফা মরহুম বাদশাহ মিয়া চৌধুরীর পরিবার এবং তাঁর কন্যা চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম মহিলা প্রিন্সিপ্যাল মরহুমা রওশন আক্তার হানিফ, সাবেক জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং আমার বড় ভাইয়ের ভায়রা মরহুম হামেদ শফিউল ইসলামের পরিবার আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আরবান আলী সওদাগরের বাড়িটি শুধু আত্মীয় স্বজনদের আশ্রয়স্থল ছিল না। ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ভারতে যাওয়ার সময় এবং ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আরবান আলী সওদাগরের বাড়িতে অবস্থান করেছেন। খাবার খেয়েছেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন এবং তাঁদের আত্মীয় স্বজন যারা জানেন যে কারা কারা আমাদের বাড়িতে অবস্থান করেছেন তাঁরা তা যদি আমাদেরকে জানান আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। আমাদের প্রত্যাশা মুক্তিযোদ্ধাদের যদি নাম পাই তাঁদের পরিচয়সহ একটা তালিকা বোর্ডে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হবে যাতে তাঁদের এবং আমাদের আগামী প্রজন্ম তাঁদের অবদান ত্যাগ তীতিক্ষা জানতে পারে। আমারাও নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করবো মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এই বাড়ির যৎসামান্য অবদানের জন্য। আজকের এই দিনে আমরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক সাবেক চেয়ারম্যান এবং আরবান আলী সওদাগরের মেঝ ছেলে মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী, আরবান আলী সওদাগরের নাতি বীর মুক্তি যোদ্ধা মোহাম্মদ আক্তারুল আলম, আরেক নাতি মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক মরহুম শহীদুল আলম চৌধুরী বেবি এবং আরবান আলী সওদাগরের নাতিন জামাই হাট হাজারীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সি এন্ড সি স্পেশাল ও চিম্বুক রেস্তোরাঁর মালিক মরহুম হাজী এস এম কামাল উদ্দিনকে। স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে আমরা গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ত্রিশ লক্ষ শহীদদেরকে এবং ইজ্জৎ সম্ভ্রম হারানো দুই লক্ষ মা বোনের অবদানকে। আন্তরিকভাবে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।