——
ঈদ হল খুশি, শান্তি, এবং সৌন্দর্যের এক অনুপম উৎসব। তবে, প্রশ্ন উঠছে, আমাদের চারপাশে এই খুশি এবং সৌন্দর্যের প্রকৃত প্রদর্শন কি আমরা কখনোই উপলব্ধি করি? প্রতিটি ঈদে আমরা রাস্তা, গাছের গুঁড়ি, বিদ্যুতের খাম্বা—সব জায়গায় বড় বড় পোস্টার, ব্যানার, এবং শুভেচ্ছাবার্তায় ঢাকা পড়ে যাই। এখানে কি একটি সমাজিক সংকটের পরিচয় নেই? একজন নাগরিক হিসেবে আমাদের সচেতনতা কি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, না কি আমরা আমাদের দায়িত্বও বুঝতে শিখব?
এ ধরনের অযথা ব্যানার-পোস্টার, যা একটি নির্দিষ্ট খুশির উৎসবকে তথাকথিত ‘সাজানো’ উৎসবে রূপান্তরিত করে, বাস্তবে আমাদের সমাজের সৌন্দর্যকে অপচয় করে। এটি শুধুমাত্র পরিবেশের ধ্বংস হয় না, মানুষের ভেতরেও এক ধরনের অসুস্থ মনোভাবের সৃষ্টি করে। এই আত্মপ্রচার এবং বাহ্যিক প্রদর্শন যতটা শক্তিশালী, ততটাই ক্ষতিকর। পরিণতিতে, এর কোনো ইতিবাচক ফলাফল আমরা কখনোই পাবো না। যে টাকা আমরা এইসব বাহ্যিক প্রদর্শনীতে ব্যয় করি, তা যদি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা যেত, তাহলে এই কর্মটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হত। এটি শুধু অর্থের অপচয়ই নয়, আমাদের নাগরিক দায়িত্বের বিরোধিতা।
আমরা কী বুঝতে পারছি না, যে, রাজনীতি ও নেতৃত্ব শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা অর্জনের যন্ত্র নয়, বরং এর আসল লক্ষ্য জনগণের কল্যাণ। এখানে আমাদের সবার উচিত এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি হল, জনগণের জন্য কাজ করা, জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করা, এবং জনগণের সেবা করা। যা কিছু টাকা ব্যানার-পোস্টার বানিয়ে অপচয় করা হচ্ছে, সেই টাকা যদি একজন অসহায় মানুষের চিকিৎসা, দরিদ্রদের জন্য খাদ্য ব্যবস্থা, অথবা পথশিশুদের জন্য শিক্ষা উপকরণ সরবরাহে ব্যয় করা যেত, তাহলে এটি নিশ্চয়ই সমাজে গভীর প্রভাব ফেলত। কিন্তু তা না করে, আমরা যা কিছু করছি তা শুধুমাত্র বাহ্যিক এবং সাময়িক সুখের জন্য। তবে, যে প্রকৃত নেতৃত্ত্বের ধারণা, তা কখনোই এই সাময়িক আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রকৃত নেতা সে, যিনি নিজের কাজের মাধ্যমে সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনেন।
পোস্টার, ব্যানার, এবং ফেস্টুন শুধুমাত্র বাহ্যিক আচ্ছাদন সৃষ্টি করে, কিন্তু মানুষের মন জয় করতে পারে না। আসল শক্তি, আসল নেতৃত্ব, আসল সম্মান আসে মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে, তাদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অর্জনের মাধ্যমে। আমাদের কাজের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে যা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, যা তাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা অর্জন করে। একজন মানুষ প্রকৃত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয় তখনই, যখন তার কাজ জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে থাকে, এবং সে নিজেকে শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
আমাদের নাগরিক দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল পরিবেশের সুরক্ষা। যে পরিবেশে আমরা বাস করি, যা আমাদের স্বাস্থ্য এবং মনের প্রশান্তির জন্য অপরিহার্য, তা যদি শুধুমাত্র বাহ্যিক আনন্দের প্রদর্শনের জন্য ধ্বংস হয়ে যায়, তবে আমাদের দায়িত্ব কি পালন হচ্ছে? আসলেই, প্রকৃতি আমাদের সুরক্ষিত রাখতে বলছে, কিন্তু আমরা কি তার সুরক্ষা দিতে পারছি? এ ধরনের পরিবেশ ধ্বংস আমাদের মানবিক দায়িত্বের বিপরীত। নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত এক সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, যা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত নয়, সমাজের এবং পরিবেশের জন্যও কল্যাণকর। তাই আসুন, আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসি এবং আমাদের দায়িত্বপূর্ণ নাগরিক হওয়ার দিকে এগিয়ে যাই।
প্রকৃত নেতা সেই, যিনি মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন, যিনি প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখেন, এবং যিনি জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য বাহ্যিক প্রদর্শন, আত্মপ্রচার বা দম্ভের কোনো স্থান নেই। পরিবর্তন আসে মানুষের হৃদয়ে, মানুষের জীবনে কার্যকর উদ্যোগ এবং কর্মের মাধ্যমে। আমাদেরকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে, এবং নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে হবে। নেতৃ্ত্ব এবং সফলতা আসে প্রতিদিনের সাধারণ কাজের মধ্যে, যা সমাজের সেবায় নিবেদিত থাকে।
অন্যে অধম বলার মাধ্যমে আমরা কখনো উত্তম হতে পারি না। আমাদের উচিত নিজেদের শুদ্ধতা এবং সততার মাধ্যমে আমাদের কাজের প্রমাণ দিতে। দেশকে ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধ নাগরিক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে, আমরা শুধু নিজেদের নয়, আমাদের সমাজ এবং দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারব।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে ওঠে জনগণের কল্যাণ এবং পরিবেশের সুরক্ষার মাধ্যমে। সমাজের সৌন্দর্য নষ্ট না করে, প্রকৃত সৌন্দর্যকে চর্চা করা আমাদের দায়িত্ব। আসুন, এই দায়িত্ব পালন করে আমরা একটি উন্নত, সুন্দর এবং সচেতন সমাজ গড়ে তুলি।
আতিক সুজন
ম্যানেজিং ডিরেক্টর এজিএমএমসফট
সভাপতি চট্টলা ইঞ্জিনিয়ার্স ক্লাব