– জিয়া হাবীব আহ্সান, এডভোকেট
প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্র পক্ষে নিয়োগকৃত বিজ্ঞ কৌঁসুলীকে ‘পাবলিক প্রসিকিউটর’, আর আসামী পক্ষের নিয়োজিত বিজ্ঞ আইনজীবীকে ‘ডিফেন্স লইয়ার’ বলে । যে সব ফৌজদারী মামলায় সরকার বাদী অর্থাৎ পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে গৃহীত মামলা সমূহ পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষে যে বিজ্ঞ কৌঁসুলি নিয়োগ করা হয় তাকে ‘সরকারী আইন কর্মকর্তা’ বা ‘পাবলিক প্রসিকিউটর’ বলে । তেমনিভাবে সরকার পক্ষে দেওয়ানী মামলা পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে জি.পি বা ‘গভর্মেন্ট প্লিডার’ বলে । তাদের সহযোগিতা করার জন্য একাধিক এডিশনাল জি.পি, এ্যাসিসট্যান্ট জি.পি ও সহযোগী জি.পি থাকেন । বর্তমানে যেসব জি.আর, সি.আর মামলা সেশন ট্রায়াল- (এস.টি) সেসব মামলায় বিচারিক আদালতে একজন পি.পি বা এডিশনাল বা এ.পি.পি নিয়োগ দেয়া হয় । ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯২ ধারার ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র সরকারী আইন কর্মকর্তা তথা এ্যাটর্নী জেনারেল, সরকারি সলিসিটর, পাবলিক প্রসিকিউটর, অতিঃ পাবলিক প্রসিকিউটর, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর ইত্যাদি নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে । অ্যাটর্নী জেনারেল এর পদটি সংবিধানের ৫ম পরিচ্ছেদের ৬৪(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একটি সাংবিধানিক পদ হয় । উচ্চ আদালতে তিনি রাষ্ট্র পক্ষে দেওয়ানী ও ফৌজদারি সকল বিষয় দেখাশুনা করেন । সরকারী আইন কর্মকর্তাগণ রাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিটি মামলায় রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা সহ ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন । আইন মন্ত্রণালয় এ সকল সরকারী আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করে থাকেন । দেশের সকল জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের জন্য সরকার কর্তৃক আলাদা আলাদা পাবলিক প্রসিকিউটর, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এডিশনাল ও সহকারী পি.পি নিয়োগ দেয়া হয় । দায়রা আদালত সমূহে সকল প্রকার মামলা সরকার পক্ষে পরিচালনার গুরু দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত। পাবলিক প্রসিকিউটর এর অধীন ব্যক্তিগত আইনজীবী নিয়োগ ও মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রেঃ ধারা ২৬৫এ, ২৬৫বি ও ৪৯৩ ধারা অনুসারে দায়রা আদালতে প্রত্যেকটি বিচারে পাবলিক প্রসিকিউটরের সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করার বিধান রয়েছে। ২৬৫বি ধারায় বর্ণিত আছে, ২০৫সি ধারার বিধান অনুসারে আদালতে আসামী হাজির হলে প্রসিকিউটর আসামীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ বর্ণনার মাধ্যমে প্রথমে নিজেই বক্তব্য শুরু করবেন । ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪০ ধারায় বলা আছে, ফৌজদারী আদালতে অপরাধে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তির অথবা আদালতে এ আইন অনুসারে যার বিরুদ্ধে কার্যক্রম রজ্জু করা হয়েছে তার নিযুক্ত এডভোকেট দ্বারা আত্নপক্ষ সমর্থনের অধিকার থাকবে। এখানে দেখা যাচ্ছে, ৩৪০ ধারা অনুসারে আসামীর পছন্দ অনুযায়ী তার আত্নপক্ষ সমর্থনের জন্য দক্ষ ও আস্থাভাজন আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। অনুরূপভাবে ফৌজদারী মামলা পরিচালনায় বা বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ফরিয়াদী ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার নিযুক্ত এডভোকেট দ্বারা তার মামলা পরিচালনা বা বক্তব্য উপস্থাপনের একচ্ছত্র সুযোগ বা অধিকার নেই যা থাকা উচিত। কার্যবিধির ৪৯৩ ধারা অনুসারে পাবলিক প্রসিকিউটর সকল আদালতে তার দায়িত্বে ন্যস্ত সব মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। তিনি কখনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষে ওকালতি করবেন না । ব্যক্তিগত ভাবে নিযুক্ত কৌশুলীগণ তার নির্দেশাধীন কাজ করবেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাবলিক প্রসিকিউটর এর প্রতি নানান কারণে মামলার ফরিয়াদী বা মামলার ভিকটিমের আস্থা থাকে না। সে ব্যক্তিগত ভাবে তার পক্ষে দক্ষ ও আস্থাভাজন এডভোকেট নিযুক্তির মাধ্যমে মামলা পরিচালনা বা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য একান্ত ভাবে ইচ্ছুক হন । কিন্তু ব্যক্তিগত এডভোকেট সম্পূর্ণভাবে পি.পি.র অধীন হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন পি.পি.র স্বেচ্ছাচারিতা বা অদক্ষতার জন্য ফরিয়াদী পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং আত্নপক্ষের সমর্থনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে ব্যক্তিগত উকিল সকল ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর এর সম্পূর্ণ অধীন হবেন, এ বিষয়টি সংশোধন হওয়া আবশ্যক । প্রয়োজনে মামলায় ভিকটিম, ফরিয়াদী বা ক্ষেত্রমত এজাহারকারীর ইচ্ছানুসারে তার পক্ষে ব্যক্তিগত এডভোকেট নিয়োগ করতে পারবে এবং নিযুক্ত ব্যক্তিগত এডভোকেট তার মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বা বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর এর অনুমতি নিতে হবে না বা তার নিরংকুশ অধীন হবেন না এমর্মে উক্ত ধারাগুলো সংশোধন করা জরুরি । সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনায় একজন পাবলিক প্রসিকিউটর কতিপয় বিশেষাধিকার ভোগ করেন । তিনি বিনা ওকালতনামায় রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা চালাতে পারেন । তাঁর অনুমতি ছাড়া বাদী/সংবাদদাতা কিংবা ভিকটিমের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেয়া যায় । তিনি এতে অনুমতি দিলেও ওই আইনজীবীকে তার নির্দেশ মেনে তার সাথে সমন্বয় সাধন করে চলতে হয় । সমন্বয় করতে না পারলে ফরিয়াদী পক্ষের আইনজীবীকে সরে দাঁড়াতে হয় । সাক্ষী উপস্থাপন, আলামত উপস্থাপন, বাদী পক্ষে যুক্তিতর্ক করা । আসামী পক্ষে সাফাই সাক্ষী থাকলে তাকে জেরা করা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পি.পি পালন করেন । এক্ষেত্রে পি পি’র দক্ষতা না থাকলে আসামীগণ তাঁর সুবিধা পায় । আসামী খালাস পেয়ে অপরাধ থেকে রেহাই পায় । পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতের অনুমতি নিয়ে কেস নিস্পত্তির পূর্বে সরকারি নির্দেশে রাষ্ট্র পক্ষে প্রসিকিউশন বা কোন মামলা প্রত্যাহার কিংবা কোন মামলার এক বা একাধিক আসামীর সম্পর্কে মামলা প্রত্যাহার কিংবা কোন কেসের এক বা একাধিক চার্জ প্রত্যাহার করতে আদালতে অভিপ্রায় পেশ করার অধিকার রাখেন । আদালত তার অভিপ্রায় যুক্তি সঙ্গত হলে তাতে অনুমতিও প্রদান করেন । এর থেকে বুঝা যায় যে, পি.পি শুধু আসামী বা অপরাধীর সাজা করাতে খরগহস্ত নহেন তিনি নিরপরাধী মানুষের মানবাধিকার রক্ষায়ও যুগোপৎ ভুমিকা রাখেন । পাবলিক প্রসিকিউটরগণ মামলার তদন্ত রিপোর্টের উপরে মতামত দেন । কিন্তু কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাগণ পি.পি এর মতামত না নিয়ে বা এড়িয়ে চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করেন । এতে মামলায় গুরতর অনিয়ম এবং ফাঁক ফোকর সৃষ্টি হতে পারে, যার কারণে আসামী খালাস ও পেয়ে যেতে পারে । এজাহারে ও অনেক ত্রুটি থাকে । জনগণ মনে করেন পুলিশ আসামী গ্রেপ্তার করে আর আইনজীবী ও বিচারকগণ তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেন । এটা ঠিক নয় । প্রকৃতপক্ষে মামলায় জামিনের সুযোগ রেখে দেয়া হয় । এজাহার, চার্জশীটে ও তদন্তে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে বা অদক্ষতার কারণে মামলার শুরুতেই অনিয়ম এবং ফাঁক ফোঁকর সৃষ্টি করে । আইনের মারপ্যাঁচে কোন নিরপরাধীর সাজা হওয়া একটি বিরাট রাষ্ট্রীয় অপরাধ । পি.পি কে এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হয় । মোট কথা পাবলিক প্রসিকিউটর আদালত অঙ্গনে রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় একজন নিবেদিত প্রাণ অতন্দ্র প্রহরী । এমতাবস্থায় বুঝা যায় একজন পাবলিক প্রসিকিউটরকে কতটুকু সৎ, চরিত্রবান, অভিজ্ঞ, নিষ্কলুষ, যোগ্যতা সম্পন্ন, নিরপেক্ষ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হতে হয় । এজন্যে পি পি নিয়োগে আগেকার দিনে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা হতো । ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান আমলের গোলামীর যুগেও এই পদটি দলীয় করণের অভিশাপ থেকে মুক্ত ছিল । তখন পেশাগত মর্যাদা, ন্যায়বিচার নিষ্ঠা, সততা ও অভিজ্ঞতার আলোকে গোপন রিপোর্টের ভিত্তিতে, জেলা জজ ও জেলা প্রশাসকের গোপন সুপারিশের ভিত্তিতে পি.পি, জি.পি পদে নিয়োগ দেয়া হতো । রিপোর্টে তাদের বংশ মর্যাদা পর্যন্ত প্রাধান্য পেত । এ নিয়ম বিলুপ্ত হতে হতে পি.পি, জি.পি এর লিস্ট হওয়া শুরু হয় দলীয় কার্যালয় কিংবা এম পি, মন্ত্রীদের বাসভবনে । দলীয়করণের ফলে এ গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে অভিজ্ঞের চেয়ে অনভিজ্ঞের, যোগ্যতমের চেয়ে অযোগ্যের, নির্দলীয়ের চেয়ে মতান্ধর প্রাধান্য বেশী হওয়ার অভিযোগ প্রতিটি সরকারের আমলেই শুনে আসছি । এমনকি সেশন কোর্টে এ ধরণের আইনজীবীকেও উল্লেখিত পদে অধিষ্ঠিত হতে দেখা যায় শুধু দলীয় আশীর্বাদের কারণে । অনভিজ্ঞ, মতান্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগ দানের ফলে সরকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার সফল হবে না এটাই স্বাভাবিক । আমি নিজেও রাজনৈতিক নিয়ম দোষের কিছু নয় মনে করি । কিন্তু এই নিয়োগে যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততাকে প্রাধান্য দিতে হবে । নিয়োগদানকালে এ বাস্তবতাকে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে না বলে অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায় । পেশাগত অভিজ্ঞতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যের প্রতি বেশী প্রাধান্যের কুফল ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে দলীয় পি.পি দলীয় অপরাধীদের প্রতি সদয় হবেন আর অন্যদের প্রতি নির্দয় হবেন এটাই স্বাভাবিক । বাদী ও আসামীর চেহারার দিকে চেয়ে মামলা পরিচালায় দলীয় পি.পি কে প্রায় ক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থ রক্ষায় মূখ্য ভুমিকা রাখতে হয় । নিয়োগকর্তাদের রিমোর্ট কন্ট্রোল দ্বারা অন্য কিছু চললেও আইন আদালত চালানো নিজেদের জন্যই বিপদজনক । এজন্যে স্বাধীনচেতা, সৎ ও নির্দলীয় আইন ব্যক্তিত্বের এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক । দলীয় পিপি রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় সন্ত্রাসীদের সাজা প্রদানের পরিবর্তে তাদের নেপথ্য পৃষ্ঠপোষকতা করায় অভিযোগও অবান্তর নয় । নৈপথ্য সহযোগিতার হস্ত অনেক সময় প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে । অতীতে দেখা গেছে মামলায় পি.পি প্রকাশ্য আসামির পক্ষ নেয়ায় এর প্রতিকার চেয়ে বাদীকে সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত যেতে হয়েছে । চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর সীমা ধর্ষনের আলামত গোপনের মামলায় বাদী মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খানকে কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন স্পেশাল মামলায় ১৯/০৫-এ পি.পি মহোদয়ের বিরুদ্ধে আসামী পক্ষ অবলম্বনের অভিযোগে আদালতে অনাস্থা পিটিশন দায়ের করতে হয়েছে । আইন মন্ত্রনালয়ে বাদী পক্ষে সরকারী পি.পি ব্যতিরেকে মামলা পরিচালনার অনুমতি চাইলে ২০০৬ সালে আইন,বিচারক ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বয়ং বাদী এডভোকেট এলিনা খানকে পি.পি, বাদীর আইনজীবী এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান ও এডভোকেট নাজমুল আলম চৌধুরী নোমানকে ১৫/০৬/০৬ ইং তারিখে উক্ত মামলা পরিচালনার জন্য এডিশনাল পি.পি নিয়োগ দান করেন । সরকারি দলের আইনজীবীদের মধ্যে অনেক যোগ্য লোক আছেন । কিছু কিছু নিয়োগযোগ্য দেখা যায় । আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এডিশনাল বা এ.পি.পি এদের মধ্যে প্র্যাক্টিস ও অভিজ্ঞতার সময় দেখা হয় না । এই ব্যপারে প্র্যক্টিসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিৎ । পরিশেষে বলা যায় আমাদের আইনে নিরপেক্ষ ও দক্ষ আইনজীবীদের পি.পি নিয়োগের আইনটি রদ করা না হলেও অপ্রচলিত । এ ব্যাপারে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচারের পরিপন্থী । যদিও প্রতিটি সরকারের আমলে দলীয় নিয়োগ দেয়া হয়েছে,পাবলিক প্রসিকিউটরগণের যে কোন কেউ সংশ্লিষ্ট মামলায় রাষ্ট্র পক্ষে যথাযথ ভূমিকা না রাখলে এবং মামলা প্রমাণের চেয়ে আসামির খালাসের ব্যাপারে সহযোগীতার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও আইন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায় । বাদী পক্ষ চাইলে সরকারের অনুমতি নিয়ে নিয়োজিত কৌশলী দিয়ে মামলা চালাতে পারেন । একজন পি.পি’র ভূমিকার উপর সমগ্র মামলার ভাগ্য নির্ভরশীল । তিনি সরকার পক্ষে মামলা চালাতে গিয়ে বাদী পক্ষে সাক্ষী করান, আলামত উপস্থাপন করান বাদী পক্ষে যুক্তিতর্ক করেন, আসামির সাফাই সাক্ষীর জেরা করেন । এক্ষেত্রে পি.পি-এর দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবে আসামীপক্ষ সুবিধা পান, তারা খালাস পেয়ে সমাজে আবার নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দ্বিগুণ উৎসাহে । রাজনৈতিক কারণে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং পি.পি, এডিশনাল পি পি, এ.পি.পি নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অযোগ্য আইনজীবীরা পি.পির দায়িত্ব পেলে মামলা পরিচালনার দিকে নজর না দিয়ে নজরানার দিকে অধিক মনোযোগ দিয়ে আসামীদের অন্যায় সুবিধা প্রদানে এগিয়ে আসবেন । অনেক সময় দেখা যায় একটি মামলায় নথি নিয়ে একাধিক এ.পি.পি কাড়াকাড়ি করছেন । সরকারি মামলা চালাতে গিয়ে পি.পি দের ব্যক্তিগত মামলার ক্ষতি হয়, তাই তাদের পেশাগত সম্মানী দ্বিগুণ হওয়া আবশ্যক নইলে তারা অবহেলায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়বেন । সরকারী কৌসুলী আদালতে পুলিশের কিংবা আসামীর প্রতিনিধিত্ব করেন না । তিনি নিছক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন মাত্র । সরকারী কৌঁসুলী কর্তৃক দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণ রাষ্ট্রের স্বার্থ বিরোধী চরম অপরাধ । সকল দলীয় পি.পি’র ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে অযোগ্যাতার অভিযোগও চলে না । দলীয় পি.পির মধ্যেও যোগ্যতা সম্পন্ন দেশপ্রেমিক ব্যক্তি থাকতে পারে এবং আছে । কিন্তু দলের মধ্যে যোগ্যপাত্ররা লবিং এন্ড ওয়েলিং এ পারঙ্গম নয় বলে তাদের খোঁজ কেউ রাখে না বলে আদালত অঙ্গনে মন্তব্য শোনা যায় । তাছাড়া আমাদের আইনে ফরিয়াদির নিযুক্তীয় আইনজীবী কিংবা মানবাধিকার সংগঠনের নিয়োগকৃত আইনজীবীদের পি.পি এর আনুগত্য করতে হয় । এটা শুভ নয় । এ পদ্ধতির পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক । নচেৎ পি.পি আসামী পক্ষের অনুচিত প্রভাবে প্রভাবিত হলে ফরিয়াদির মামলা রক্ষা করাই দায় হয় । জওয়াবদিহীতা, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার সরকারের অঙ্গীকার সফল হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থায় পাবলিক প্রসিকিউটরের মতো গুরুত্বপুর্ণ পদকে সম্পূর্ণ দলীয়করণের অভিশাপমুক্ত করা যাবে না । এ ব্যাপারে সরকার একটি নিরপেক্ষ নিয়োগ বাছাই কমিশন ও গঠন করতে পারেন । দলীয় লোকজনের মধ্যেও অনেক যোগ্য লোক আছে যাদের বাছাই ও নিয়োগ দেয়া যায় । চট্টগ্রামে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত জেলা পি.পি এডভোকেট এ.কে.এম সিরাজুল ইসলাম একজন দক্ষ ও সর্বজন শ্রদ্বেয় কৌঁসুলি । তিনি চট্টগ্রাম বারের একাধারে সেক্রেটারি ও সভাপতিও ছিলেন । জেলা জি.পি এডভোকেট নাজমুল আহ্সান খান আলমগীরও একজন যোগ্য ব্যক্তি যিনি চট্টগ্রাম বারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ও তাঁর পিতা মরহুম মোজাফফর আহমদ খানও চট্টগ্রামে জি.পি এবং পি.পিও ছিলেন । তাই ঢালাওভাবে অযোগ্য, অদক্ষ নিয়োগের অভিযোগও সত্য নয় । মর্যাদা ও প্রটোকলের দিক থেকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অর্থাৎ এ্যার্টনী জেনারেল সচিব পদমর্যাদা সম্পন্ন, আর পাবলিক প্রসিকিউটররা সহকারী বা যুগ্ম সচিবের পদ মর্যাদা সম্পন্ন সরকারী কর্মকর্তা । তা’হলে একজন সরকারী আইন কর্মকর্তা ও সচিব বা যুগ্ম সচিব বা সহকারী সচিব বা প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তার সমান সম্মানী বা বেতন পাওয়ার কথা । অবহেলিত উপেক্ষিত সরকারি আইন কর্মকর্তারা প্রায়ই সম্মানী বাড়ানোর জন্য দাবি করে আসছেন । সর্বশেষ পে-কমিশনেও একটি নির্দেশনা থাকা উচিৎ ছিল সরকারি আইন কর্মকর্তাদের সম্মানী বাড়ানোর ব্যাপারে কিন্তু নেই। রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষাকারী সরকারী কৌঁসুলিদের বেতন ভাতা ও নিরাপত্তা জোরদার করা আবশ্যক । বর্তমানে পি.পি’দের জন্য একজন গানম্যান থাকলেও অন্যান্যদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই । অথচ তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে । পরিশেষে বলা যায় উন্নত বিশ্বের আধুনিক বিচার পদ্ধতি সম্পর্কে এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করতে তাদের পর্যায়ক্রমে বিদেশে পাঠানো সহ ত্রুটি মুক্ত প্রসিকিউশন পক্ষে পরিচালনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরী । আশা রাখি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় ও আইন কমিশন বিষয়গুলো নিয়ে ভাববেন ।
লেখকঃ আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী