হোসাইন মাহমুদ আপেলঃ
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ অভিযাত্রার প্রথম দিনে ১৯৭৪ সালের ২৫-এ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত ঐতিহাসিক একমাত্র ভাষণে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আত্মনির্ভরশীলতাই আমাদের লক্ষ্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ উদ্যোগই আমাদের নির্ধারিত কর্মধারা। এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যায় অংশীদারিত্ব আমাদের কাজকে সহজতর করতে পারে, জনগণের দুঃখকষ্ট লাঘব করতে পারে”।
তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে জাতিসংঘের ৭৬ তম সাধারণ অধিবেশনে বহু নেতার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাধারণ পরিষদের এই অধিবেশনে শেখ হাসিনার এই ১৮তম ভাষণে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষনে যেমন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার গল্প তুলে ধরেন, ঠিক তেমনি তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশের বিজয়গাঁথার গল্প ঠিক যেমনটা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য অনুকরণীয় ঠিক তেমনি উন্নত রাষ্ট্র সমূহের বিলাসিতার বলিও কিন্তু এই তৃতীয় বিশ্বই। সেখান থেকে উতরানোর জন্য উন্নত রাষ্ট্র সমূহের দায়বদ্ধতার জায়গা স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উচ্চাভিলাষী শেখ হাসিনা বিশ্বমঞ্চে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ভাষণ বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।
শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের উন্নয়নের কয়েকটি দিক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি-তে আমরা বিশ্বের ৪১তম। গত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। এ সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২,২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছি”। নারীর ক্ষমতায়ন সহ সামাজিক অন্যান্য সূচিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ, ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ কর্মসূচির এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। তিন বলেন, এ সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীর উন্নতি ও ক্ষমতায়নে বিপুল বিনিয়োগ। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার বিষয়ে দেশের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের কতিপয় উদ্ভূত সমস্যা নির্দিষ্ট করেন এবং সমাধানের পথে হাঁটতে বিশ্বনেতাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
প্রথমতঃ কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই তিরি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানান।
তৃতীয়তঃ মহমারির প্রকোপে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করার জন্য জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
চতুর্থতঃ তিনি বলেন কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করেন।
পঞ্চমতঃ তিনি মহামারিকাল অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাঁদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান। ষষ্ঠতঃ তিনি আবার রোহিঙ্গা সংকটের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা আপন মহিমায় বিশ্বমঞ্চে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন প্রতিনিয়ত। শুধু নিজ দেশের অর্জনের ঝুড়ি সমৃদ্ধ করতে তিনি ব্যাস্ত নন। তিনি তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছেন বহু আগেই, যার সর্বশেষ ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায় জাতিসংঘের ৭৬ তম সাধারণ অধিবেশনে।
লেখকঃ হোসাইন মাহমুদ আপেল, এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।