অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন:
ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক তারাগঞ্জ একটি বিশেষ অঞ্চলের নাম। ঐতিহাসিক একডালা দূর্গের মূল ভূমিতে অবস্থিত কাপাসিয়া – কালীগঞ্জ উপজেলার মিলনভূমি খ্যাত এই তারাগঞ্জ নানা কারণে বিখ্যাত ও অনন্য। মূলত ১০৬ বছরের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান তারাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজকে কেন্দ্র করেই এ এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি শিক্ষিত জনপদ,গড়ে উঠেছে উদার,সহনশীল ও সামাজিক মূল্যবোধের ঐতিহ্য। এ জনপদে জন্ম নেয়া কিছু আলোকিত ও গুনী মানুষদের হাত ধরেই তারাগঞ্জ আজ ঐতিহ্যবাহী এবং অনন্য।
তারাগঞ্জ অঞ্চলের স্বমহিমায় ও সৌরভে উদ্ভাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে সদ্য প্রয়াত এম আর খান কবির মিয়া অন্যতম। এ এলাকার সোনালী ইতিহাসের অন্যতম বরপুত্র তিনি। তিনি তারাগঞ্জ এলাকার গর্ব, অহংকার ও আলোকিত মানুষ। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাঁর সম্পর্কে অবহিত নয়। তাঁর সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্যই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
# এম আর খান কবির মিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী:
এম আর খান কবির মিয়া বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার উওরের কাপাসিয়ার সীমান্তবর্তী ডেমড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সায়িদ খান।
# শিক্ষা জীবন: তিনি তারাগঞ্জ এইচ এন স্কুলের একজন প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৪২ সালে তারাগঞ্জ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৪৩ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ব্রাহ্মনবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৩ সালে গ্রাজুয়েশন, ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
# কর্ম জীবন: এম আর খান কবির মিয়া ১৯৫৫ সালে গোপালগঞ্জ কলেজ, ১৯৫৬ সালে ফরিদপুর কলেজে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।
পরবর্তীতে ঢাকায় এজি অফিসে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ( বিএডিসি) উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৬৮ সালে বিএডিসির ডেপুটি সেক্রেটারি পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এর পর তিনি ম্যানেজার ও পরবর্তীতে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্ম জীবনে সরকারি খরচে আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর উপর ২ বছরের মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বর্নাঢ্য চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। একই বছর তিনি হক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর জেনারেল ম্যানেজার পদে যোগদান করেন।
# সামাজিক ও পারিবারিক জীবন: তিনি ঐতিহ্যবাহী তারাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা-উত্তর তারাগঞ্জে জনতা কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। সেই জনতা কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে চার দলীয় জোট সরকারের আমলে স্বচ্ছল ও মানসম্মত স্কুলে কলেজ শাখা তথা একাদশ শ্রেণি খোলার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আজিজুর রহমান পেরা’র নেতৃত্বে তারাগঞ্জ স্কুল শাখার সাথে কলেজ শাখা খোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নতুন করে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় বিভিন্ন পরামর্শ সভায় উপস্থিত থেকে উৎসাহ যুগিয়ে ছিলেন কবির মিয়া ।
তিনি গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করার পর অত্র প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন শিক্ষকতাও করেছিলেন। শীতলক্ষ্যা নদীর কড়াল গ্রাসে নদী তীরবর্তী স্কুল ক্যাম্পাস বিলীন হওয়ার আশংকা দেখা দিলে ১৯৭৭ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে স্কুল স্থানান্তরের পিছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
এম আর খান কবির মিয়া তারাগঞ্জ অঞ্চলের শত শত বেকার ছেলে মেয়েকে বিনা পয়সায় চাকুরী দিয়ে কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
তারাগঞ্জ অঞ্চলের সূর্য সন্তান এম আর খান কবির মিয়া ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর, সকাল ৯:৩০ মিনিটের সময় ঢাকার এভার কেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, একমাত্র পুত্র মাইজুস শাহান, খান ( সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) এবং দুই মেয়ে জেনি ও বাবুকে রেখে গেছেন।
উল্লেখ্য, এম আর খান কবির মিয়ার দুই মেয়েই গত শতাব্দীর আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতি ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে পরিবারের সবাই আমেরিকা ও কানাডা প্রবাসী।
এলাকার মানুষের জন্য তাঁর অসামান্য অবদান স্মরণে রাখবে। তাঁর শিক্ষা, সমাজ সেবা ও মানবতামূলক কর্মকান্ড কাপাসিয়া-কালীগঞ্জ উপজেলার মিলন ভূমি ঐতিহ্যবাহী তারাগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের মাঝে যুগ থেকে যুগান্তরে, বংশ থেকে বংশপরম্পরায় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কিংবদন্তি হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ । মহান আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করেন। আমিন।
লেখক:
শামসুল হুদা লিটন
অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
তারাগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজ
কাপাসিয়া, গাজীপুর।