———
বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এক মায়ের প্রতিক্রিয়া হলো, ‘আর কত! আমাদের সব জনগণকে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে দেশ ভারতকে দিয়ে দিলেই ভাল হয়’। এই মায়েদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার নেই। আমি আজও আমার নিজের মাকেও সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামাতে পারিনা। এখনও প্রায়শই দেখি ঘুমের মাঝে আমার মা কাছে এসে কপালের ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে চোখের জল ফেলে চলেছেন।
আমি নিজেকে নিয়ে কোনোদিনই ভাবিনি। আত্মবিশ্বাসটা বরাবরই আমার বেশি। সেই স্কুল জীবন থেকে যেহেতু প্রতিবাদ সংগ্রামের সাথে যুক্ত, এর আগেও বহুবার নানাভাবে জখম হয়েছি। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ অবিরত বহমান, তবু কখনও থেমে যায়নি আমার পথচলা। তবে আবহমান কালের সাথে সাথে বিশ্বাসের জায়গাটা খুব নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত/আহত হবার ঘটনা পৃথিবীতে তথা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব বেশি ঘটেনি। তাছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিবদমান দু’টি গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আগের দিনের মারামারি, লুটতরাজ ও কক্ষ ভাংচুরের পর দ্বিতীয় দিনে আবার নতুন করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক তা বিশ্ববিদ্যালয় কোন সচেতন মানুষ চাইতে পারেনা। উপরন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোমলমতি ছাত্ররা একে অপরকে আঘাত ও আহত করবে তা আমাদের কারও কাম্য নয়।
এমন একটি পরিস্থিতিতে ছাত্রদের বিশৃঙ্খলা ও হানাহানি থামাতে গিয়ে আমি ছাত্রদের টার্গেটে পরিণত হয়েছি। ঘটনার প্রায় দেড় মাস হতে চলল, এখনও আমার মাথার একটা বড় অংশ অনুভূতিহীন এবং বাম চোখে দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফেরত পাইনি। আমার এসকল শারীরিক অসুবিধা হয়তো সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। আর না হলেই বা কী এসে যায়! যখন আমার মনের বিশ্বাস আর আস্থার জায়গাটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন নিজের শরীরের বাতুলতাও ভনিতা বলেই ধরে নিয়েছি।
সেই ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয় পাড়াতে ছিল আমার বসবাস। সুশৃংখল জীবনযাপনের বিচারে বুয়েটকে সব সময় এগিয়ে রাখতাম আমরা। ঢাকা মেডিকেল আমার সহধর্মিণীর প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেখানকার শিক্ষার্থীদের আচরণ ও জীবনযাপন সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে। দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের এই দুইটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের বিশাল ব্যপ্তি এদেরকে সব সময় পড়াশোনা ও সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত রেখেছে এমনটাই দেখেছি। অন্তত একটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমার সহধর্মিণী তার মেডিকেল লাইফে আমার চেয়ে তিনগুণ বেশি পড়াশোনা করেছে।
নতুন শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির প্রবল থাবা এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে শুরু করে। সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ সকলকে মূল্য (Price) আর মান (Value) এর পার্থক্য ভুলিয়ে দিল। রাজনীতি করলেই সমাজে মূল্য বাড়ে, কমে যায় মান। আমরা সবাই সেই সহজ পথে হাঁটতে শুরু করলাম। অর্থ আর পদের লোভে আমরা দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে মেধাশূন্য রাজনীতিকদের পিছু ছুটতে থাকলাম। বুয়েটের মত মেধাবীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের বলি হলো নিরাপরাধ শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি। আজ আবার আমরা হারালাম মেধাবী আবরার ফাহাদকে। সত্যিই কি সরকারের একটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছে আবরার ফাহাদ!
বাংলাদেশের রাজনীতি ভীষণ জটিল! আমরা সব সময় দুটো পক্ষ হয়ে আছি। একপক্ষ যেমন ভারতের একনিষ্ঠ সমর্থক, অন্যপক্ষ ঠিক তেমনি ঘোর ভারত বিরোধী। ভারতের সাথে পানির হিস্যা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষ সবসময় বিরাজ করে আসছে। আমার বিচার-বিশ্লেষণে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণে ১৯৬১ সালে ভারত ফারাক্কা বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিয়ে সহজে পার পেয়ে গিয়েছিল। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া সহ প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ সব সময় আছে। বাংলাদেশের সবগুলো সরকার সব সময় পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যদি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয় তাহলেও সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ সম্পন্ন মানুষ বেশি পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে ভারতের পক্ষ থেকে সত্যিকারের আন্তরিক সহযোগিতা সব সময় বাংলাদেশের মানুষ পায়না। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও সাম্প্রতিক ভারত সফরে গিয়ে টিপ্পনী করে বলতে হয় যে, ভারত বিনা নোটিশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার কারণে রাঁধুনিকে তরকারিতে পেঁয়াজ দেয়া বন্ধ করতে বলেছি। ভারতের কেন্দ্রীয় আর প্রাদেশিক সরকারের নাটকে তিস্তার পানি কাগজ-কলমে আটকে গেছে। দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির ফলাফল হলো- বাংলাদেশ বহুগুণে পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, ভারতীয়রা এদেশে চাকরি করে তার চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিবছর আয় করে থাকে। খরা মৌসুমে যখন পানির হাহাকার পড়ে তখন পরাশক্তি ভারত একচেটিয়াভাবে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিজেদের দিকে নিয়ে সামান্য পানি আর অধিক পলি বাংলাদেশের জলসীমায় পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে বর্ষাকালে ফারাক্কা বাঁধের সকল গেট খুলে দেয় যা পরিণতিতে বন্যায় রুপ নেয়। আমরা যে যত বড় আওয়ামী লীগার হই, এই ধ্রুব সত্যটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এবছর যে সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে গিয়ে ফেনী নদীর পানির কিয়দংশ ভারতের জন্য বরাদ্দ দেবার চুক্তি করলেন ঠিক তখন পদ্মা অববাহিকায় তীব্র বন্যা চলছে। তিস্তার পানির কোনো সুরাহা হয়নি। ভারতের এনআরসি নিয়ে চরম অসন্তোষ চলছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের যারা রাজনীতি সচেতন, তাদের মাঝে কিছুটা অসন্তোষ বিরাজ করছে। যতটুকু অসন্তোষ আবরার ফাহাদ এর ফেসবুক পোস্টে দেখেছি, তাতে তাকে খুন করার মত অপরাধ করেছে বলে মনে হয়নি।
এবার শেষ কথায় আসি। আমরা সকলেই বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও তাঁর দেশ বান্ধব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানি। বাংলাদেশকে ঘিরে নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও রোহিঙ্গাসহ হাজারো ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে তিনি সাম্প্রতিক ভারত সফরে গিয়ে যে সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তা কতটা জনবান্ধব কিংবা দেশের স্বার্থবিরোধী তা ভবিষ্যতে জানা যাবে। তিনি তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে এখনও সংবাদ সম্মেলন করেননি। অতিমাত্রায় দেশ প্রেমিক ও আবেগপ্রবণ কিছু মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও স্বাক্ষরিত চুক্তি নিয়ে সমালোচনা মুখর হয়েছেন। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশে, সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনার অধিকার সকলের আছে। তাই বলে সমালোচনা করলেই খুনের শিকার হতে হবে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। আমরা আর কোনদিন মেধাবী আবরার ফাহাদ এর মেধা প্রকাশ দেখতে পাবো না। মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস শূন্যের কোঠায় পৌঁছতে চলেছে। যে ক্রিকেট বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে নতুনভাবে জায়গা করে দিয়েছে, সেই ক্রিকেট স্ট্যাম্প কারও হাতে দেখলে বড্ড ভয় লাগে। তবে ক্রিকেট স্ট্যাম্প নয়, মানুষেরে ঘৃণা করি।
————
লেখক:
ড. ফিরোজ আহমেদ
চেয়ারম্যান,অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ,নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়