মোহাম্মদ মন্জুরুল আলম চৌধুরী।
মানুষের জীবন এবং জীবিকার ক্ষেত্রে নদীর ভুমিকা এবং গুরুত্ব অপরিসীম। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ সবজায়গায় আমাদের নিত্যদিনের বিবিধ বর্জ্য কল কারখানার দূষিত রাসায়নিক ও শিল্প বর্জ্যের পাশাপাশি উজান থেকে নেমে আসা পলি জমছে নদীতে। দখলে দূষণে ময়লা আবর্জনার স্তূপের কারণে নদী ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হারাচ্ছে নাব্যতা। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারণেও নদী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পরিবেশ প্রতিবেশ এবং প্রাণীজ ও জলজ জীববৈচিত্র্য বিরাট হুমকির সম্মুখীন। দেশের মৎস্যসম্পদ আহরণ বাজারজাতকরণ দেশের চাহিদা পূরণ এবং রপ্তানী আয় ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মাছে ভাতে বাঙ্গালীর সেই চিরায়ত ইতিহাস ঐতিহ্য আজ লুপ্তপ্রায়। সাধারণ মানুষের কাছে মাছ এখন ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় দেশের বিভিন্ন শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদ নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ৫৩ জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অবৈধ দখলে চলে গেছে। সকল নিয়মনীতি উপেক্ষা করে যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে আবাসন, কল কারখানা, প্রকল্প এবং বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে শত শত বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রভাবশালী অসৎ এবং দুষ্টু চক্র যত্রতত্র নিজেদের প্রয়োজনে ব্যক্তিস্বার্থে দেশের স্বার্থকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ করে যে যার খুশি মতো নদী দখলের উৎসবে মেতে উঠেছে। আমরা ভুলেই গিয়েছি এক সময় বাংলাদেশ ছিল একটি নদীমাতৃক দেশ। এহেন পরিস্থিতিতে গেল ২৫ সেপ্টেম্বর’ ২২ তারিখে পালিত হয়েছে বিশ্ব নদী দিবস। এ উপলক্ষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থা নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এবারের নদী দিবসের প্রতিপাদ্য—‘নদীর অধিকার’। এক তথ্য থেকে জানা, “২০১৮ ও ২০১৯ সালের দিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে ৬৪ জেলায় ৫৭ হাজার ৩৯০ অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়। এই দখলদারদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, সরকারি সংস্থা রয়েছে। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ ১৮ হাজার ৫৭৯ জন বা ৩২ শতাংশ অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়। করোনা মহামারি শুরুর পর এতে ভাটা পড়ে” {সূত্রঃ প্র/ আলো,২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২}। আবার মোট দখলদারের ৬৮ শতাংশকেই উচ্ছেদ করতে পারেনি সরকার। দখলমুক্ত করার পর আবারও অনেক জমি দখল করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। সারা দেশে উচ্ছেদ অভিযান চালায় মূলত স্থানীয় প্রশাসন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৯) বলা হয়েছে, “এসব অভিযানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি। নদীর জায়গা উদ্ধারে আইন প্রয়োগে অবহেলা, অমনোযোগিতা, গড়িমসি, দায়িত্বহীনতা, গুরুত্বহীনতা বা অযোগ্যতা ও অদক্ষতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়”। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “দেশের প্রতিটি বিভাগে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান নদীর মধ্যে বা নদীর তীরে বড় বড় অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছে। সেগুলো উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, সরকারের যেসব সংস্থা, বোর্ড, প্রশাসন বা কমিটি এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দায়িত্বে ছিল, তারা দায়িত্ব পালনে গড়িমসি করেছে, কালক্ষেপণ করেছে। কমিশন নদী উদ্ধারে যেসব পরামর্শ, সুপারিশ বা অনুরোধ করেছে, এসব সংস্থা তা এড়িয়ে যাওয়ার বা অপব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে”। কমিশন মনে করে, “আরেকটি কারণে উচ্ছেদ অভিযান সফল হয়নি। অভিযান চালাতে স্থানীয় প্রশাসন যে অর্থ চেয়েছিল, অর্থ বিভাগ তার সামান্যই দিয়েছিল। উচ্ছেদ ও সীমানা নির্ধারণে অর্থ ও লজিস্টিক স্বল্পতার কারণে অনেক জেলায় ঠিকমতো কাজ হয়নি”। পাশাপাশি “জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ ও নীতিনির্ধারকদের একটি অংশের কাছে নদীর গুরুত্ব নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অনেকেই নদীসংক্রান্ত আইন জানেন না, অনেকে আইন প্রয়োগে আন্তরিক নন। প্রভাবশালী দখলদারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অনেকে ভয় পান। আছে দুর্নীতি। এসব কারণে নদী উদ্ধারে সাফল্য কম” {সূত্রঃ প্র/ আলো, ২৫ সেপ্টেম্বর’২২}।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর অবহেলা ও ভুল নদীশাসন, উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার এবং দখল ও দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে দেশের বেশির ভাগ নদ-নদী। বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার ওপর প্রথম আঘাত আসে ইংরেজ আমলের ভুল নদী ব্যবস্থাপনায়। এরপর ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে ক্ষতিকর বাঁধ, আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীগুলোর ভালোর বদলে মন্দই করেছে বেশি। গত দুই দশকে শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নদীর দখল ও দূষণ ঘটেছে ব্যাপক হারে। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে,নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণমুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আরো আছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। তবু রক্ষা পাচ্ছে না নদীর দখল ও দূষণ।
৩ ফেব্রুয়ারি’১৯ হাইকোর্ট এক মামলার রায় ঘোষণায় বলেছেন, “মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতি টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্য সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য”। নদী রক্ষায় বিভিন্ন দেশের আদালতের দেওয়া রায়ের উদাহরণ দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘আমাদের দেশের সব নদীকে রক্ষা করার সময় এসেছে। যদি তা না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ আদালত আরও বলেন, ‘শুধু যে তুরাগ নদই আক্রান্ত তা নয়; গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪৫০টি নদ-নদীও অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত পাশাপাশি দেশের সব নদ-নদী-খাল-জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা এবং তার বহুমুখী উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছেন আদালত। পরে রায়ের বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এ রায়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মতোই নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি পেল। নদী যাতে জীবন্ত থাকতে পারে, দখল বা দূষণ না হয় সেজন্য একটা মেসেজ দিতে চাচ্ছেন আদালত। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ যেন নদী দখলের সাহস না করে’। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন দুঃখজনক ভীতিকর এবং বিস্ময়কর কেননা দখলে দূষণে ভরাটে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীকে তথা আমরা নদীর জীবন সত্ত্বাকে হত্যা করছি। বিআইডব্লিইউটিএর নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দুই বছর আগে রাজধানীর আশপাশে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। এসব এলাকায় দখলদারদের আবার ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, প্রভাবশালী দখলদারেরা আবার নদীর সীমানায় অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটাই হচ্ছে সারা দেশের বাস্তব চিত্র।
আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আমরা অহরহ নদীর অধিকার ও জীবন স্বত্তাকে দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত পরিকল্পনা এবং জলবায়ু পরির্তনের মাধ্যমে অবিবেচকের মতো ধ্বংস করছি। অথচ পানি ও নদী নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেশন নদীকে তার মত থাকার অধিকার দিয়েছে যা প্রত্যেক রাষ্ট্রেকে অবশ্যই পালন করতে হবে। উজানের দেশ ভারত তা মানছে না বলে ভাটির দেশ হিসেবে আমরা আজ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। তাই নদীর অধিকার রক্ষায় সব দেশগুলোকে একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। পানি, শক্তি, জীববৈচিত্র্য ও নদীবাহিত পলি, এই চারটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে নদীর বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করা প্রত্যেক রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। অভিন্ন নদীর পানির অধিকার এবং সাধারনের সুরক্ষা, পানি গণতন্ত্র, পানি বিষয়ক উদ্ভাবনসহ বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মত বিনিময় এবং সংলাপ অপরিহার্য। পাশাপাশি দেশের নদ নদীকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা, দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন এবং স্বার্থে দখল দূষণ ভরাট বন্ধ করার জন্যে বলিষ্ঠ এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রভাব প্রতিপত্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়া বাহুবল পেশিশক্তিসহ সকল ধরণের ভয় ভীতি অপশক্তিকে পরাজিত করে দেশের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখা উচিৎ, দেশপ্রেম রাজনৈতিক অঙ্গীকার সদিচ্ছা আন্তরিকতা ছাড়া ‘নদীর অধিকার’ রক্ষা সম্ভব নয়।