ইমদাদুল হক যুবায়ের :
“দেশজুড়ে তোলপাড় ভয়ানক ইস্যু,/ নিহত-নিপীড়িত অসহায় শিশু।/ শিশুদের নিয়ে আজ কত শত উপহাস,/ যেথায় সেথায় গাছে ঝুলে শিশুদের লাশ।” হত্যাকান্ড সবসময়ই নিন্দনীয়। আর শিশুহত্যার ঘটনা সমাজের ভিতকেই যেন কাঁপিয়ে দেয়। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। আজ যারা শিশু, কাল তারাই বিশ্বের নেতৃত্ব দেবে। আজ যারা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, একদিন তারাও শিশু ছিলেন। শিশুরা হচ্ছে এমন এক প্রকার প্রাণী, যারা নিজেরা নিজেদের জগত তৈরি করে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানুষ হত্যা বিশেষ করে শিশুহত্যার ঘটনা জনমনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। শিশু অপহরণ বা ধর্ষণের পর হত্যা এ ব্যাধিতো দিন দিন আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তা দ্রুত সবার নজর কাড়ছে ও সচেতন মহলসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ব্যথিত ও ভাবিয়ে তুলছে।
চলমান বছরে লোমহর্ষক শিশুহত্যার মতো অনাকাঙ্কিত ও অপ্রত্যাশিত অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর অন্যতম হলো-চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় পাওনা টাকা ফেরত না দেয়ায় ইমরান হাসান নামের ১৩ মাস বয়সী শিশুকে চাচা-চাচী কর্তৃক শ্বাসরোধে হত্যা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে সিয়াম মোল্লা নামের ছয় বছরের শিশু ও বগুড়ায় দুপচাঁচিয়ায় আট বছরের আশিক নামক শিশু তার সৎমায়ের হাতে খুন। এছাড়া নোয়াখালির বেগমগঞ্জে নিখোঁজের চারদিন পর মাছের বাক্স থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, ইমরান নামের ৮ বছরের শিশুর লাশ।
শুধু তাই নয়, মুকসুদপুর উপজেলায় নিখোঁজের দুই দিন পর সুময়েল সরকার নামের ১০ বছরের শিশুর লাশ পাওয়া গিয়েছে পুকুরে। বগুড়ায় বড়দের বিরোধের বলির শিকার হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের ওয়াসিম নামের ২ বছরের শিশু। সিলেটের ১৩ বছরের শিশু সামিউল আলম রাজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশবাসী এখনো ভুলেনি। সর্বশেষ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে পাঁচ বছরের শিশু তুহিনের গাছের সাথে ঝুলন্ত লাশের ছবি সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষ কতটা নিষ্টুর আর নির্মম হলে ছোট্ট একটি অবুঝ শিশুকে এভাবে হত্যা করতে পারে। এ চিত্র অসংখ্য শিশুহত্যাকান্ডের কিয়দংশ মাত্র।
বহুল প্রচারিত ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক জরিপে দেখা গেছে যে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে গড়ে মাসে ৩৪ জন শিশুর বেশি খুন হয়েছে। খুনের শিকার অর্ধেকের বেশি শিশুর বয়স ১২ বছরের নিচে। তাছাড়া গত সাড়ে চার বছরে হত্যার শিকার মোট শিশুর সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি। পারিবারিক সহিংসতা, অপহরণ ও ধর্ষণের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু হত্যার ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশে সংগঠিত এসব হৃদয় বিদারক হত্যাকান্ড আইয়্যামে জাহিলী যুগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
মানবতার ধর্ম ইসলামে মানব হত্যার পরিণাম ভয়বাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাক্রমে মুসলমানকে হত্যা করে, তার শাস্তি জাহান্নাম, তাতেই সে চিরকাল থাকবে। (আল-কুরআন, সূরা নিসা, আয়াত: ৯৩)
মানব হত্যায় ইসলামের সর্বোচ্চ শাস্তি হলো- ধারালো অস্ত্র দ্বারা ঘাতকের শিরñেদের মাধ্যমে মৃত্যুদ-। কিন্তু শিশুহত্যার মত জঘন্য হত্যায় ইসলামের রয়েছে আরো কঠোর অবস্থান। “একবার এক রাহাজান একটি শিশুর অলংকার ছিনতাই করে তাকে পাথরে পিষে হত্যা করে। ওই শিশুহত্যার মৃত্যুদ- কোনো ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে দেয়া হয়নি। বরং তাকেও নিহত শিশুটির মতো প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। (ইমাম মুসলিম, সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৪৫৪)
ইসলাম পূর্ব যুগে কন্যা শিশুদের জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে ইসলামের সঠিক বিধান বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে শিশুদের বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া শিশু নির্যাতন রোধে রাসূলুল্লাহ (সা.) আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও শাস্তি কার্যকর করার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে শিশুহত্যার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়েই চলেছে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় এবং বিদেশী চলচ্চিত্র- এ ধরণের অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিশুহত্যার ঘটনায় শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এসব ঘটনায় শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতির সৃষ্টি হলে তা শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে।
বর্তমান প্রজন্মকে একটি শিশুবান্ধব বিশ^ উপহার দিতে শিশুদের নিয়ে ভাবতে হবে। পরকালের জবাবদিহীতার ভয় ও সামাজিক সচেতনতার সৃষ্টির জন্য সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে। শিশুহত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণরোধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন সজাগ থাকতে হবে তেমনি শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগকল্পে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিশুহত্যার ঘটনাগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। যারা এসব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন॥
লেখক: শিক্ষক, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ, এম.ফিল গবেষক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।