অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
চিকিৎসা সেবা মানবতার সেবায় নিয়োজিত এক মহৎ পেশা। অন্যদিকে সেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে সাধারণত মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বল সময়ে চিকিৎসকই তার বড় অবলম্বন, যেন অসহায়ের সহায়। এজন্য চিকিৎসা সেবাকে মহান পেশা বলা হয়। মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন কারও কিছু করার সামর্থ থাকে না, ঠিক সেই সময়টাতে চিকিৎসকরাই এগিয়ে আসতে পারেন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সেবা করার দারুণ সুযোগ চিকিৎসকদের দিয়েছেন। চিকিৎসকদের কর্তব্য সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করা ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় আইন সমূহ মেনে চলা। চিকিৎসা পেশার মহত্ত্ব ও মানবতার কথা মনে রেখে একজন চিকিৎসক রোগীর সেবা করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। রোগীর প্রতি চিকিৎসকের আচরণ হবে সৌজন্যমূলক, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল। রেজিষ্ট্রার্ড চিকিৎসকদের নির্দেশনা সংক্রান্ত মেডিক্যাল নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালা একজন চিকিৎসকের সাধারণ কর্তব্য, রোগীর প্রতি কর্তব্য এবং সহকর্মী চিকিৎসকের প্রতি কর্তব্যের দিক নির্দেশনা বহন করে। ১৯৪৯ সনের ১২ অক্টোবর লন্ডনে বিশ্ব মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক এই নীতিমালা পরিবর্তিতরূপে গৃহীত হয় এবং ইহাই জেনেভা ঘোষণা নামে পরিচিত। এই নীতিমালায় চিকিৎসকদের ব্যাপারে বলা হয় ‘‘আমি নিজে প্রতিজ্ঞা করতেছি যে, মানবতার সেবায় আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব। আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়া চিকিৎসা পেশার সম্মান ও গৌরবময় ঐতিহ্য বজায় রাখবার চেষ্টা করব। আমার রোগীর শারীরিক অবস্থাই আমার প্রথম বিবেচ্য বিষয় হবে। ধর্ম, গোত্র, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সামাজিক অবস্থিতির কোন কিছুই আমার রোগী ও আমার কর্তব্যের মাঝে আসবে না। আমি আমার চিকিৎসা জ্ঞানকে হুমকির মুখে ও মানবতার পরিপন্থী কোন কাজে প্রয়োগ করব না ইত্যাদি।’’ যে কোনো রোগী বা তার স্বজনদের প্রত্যাশা হলো চিকিৎসকের কাছে গেলে বা হাসপাতালে এলে যেন ডাক্তার পাওয়া যায় এবং চিকিৎসা শুরু হয়। আমাদের দেশে ভালো মানের এবং ভালো মনের চিকিৎসক অনেক আছেন, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার, প্রসূতি মায়ের সেবা, দুর্ঘটনায় আহতসহ অন্যান্য নিয়মিত রোগের চিকিৎসা মিলছে না বলে রোগীরা অভিযোগ এনেছেন। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা যেন অপ্রতুল। জ্বর, সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ থাকলেই এসব হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও অন্য রোগের চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর। প্রতিদিন অসংখ্য রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা পেতে নানা ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল অসুস্থ রোগী নিয়ে ধরনা। মিলছে না চিকিৎসা। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায়ই প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। মাঝে মধ্যে হাসপাতলে ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসকগণ দায়িত্ব পালনে বিরত থাকেন। যার ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় রোগীদের। চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন রোগী। তিন হাসপাতাল ঘুরেও নবজাতক জমজ সন্তানের চিকিৎসা করানো যায়নি। ফলে বিনা চিকিৎসায় জমজ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিকার চেয়ে মহামান্য উচ্চ আদালতে আবেদন করেছেন এক বাবা। বাংলাদেশের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কয়েক দফা নির্দেশনা, বেসরকারি হাসপাতাল মালিকদের প্রতিশ্রুতির পরেও চিকিৎসার বেহাল চিত্র বদলায়নি। কিন্তু কোন পক্ষই এর দায় নিচ্ছেন না। সাধারণ রোগীরাই হচ্ছেন ভোগান্তির শিকার। কেউ নিশ্চিতভাবে করোনা আক্রান্ত না হলে সেসব জায়গায় ভর্তি করানো হচ্ছে না। ফলে সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য রোগীরা কোথায় যাবেন তা বুঝে উঠতে পারে না। বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা পাওয়া সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার। চিকিৎসা সেবায় অবহেলা চিকিৎসা সেবা আইন, ২০১৬ এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কর্তব্য কর্মে ইচ্ছাকৃত অবহেলা, অযৌক্তিক দায়িত্বহীনতা বা বড় রকমের অযোগ্যতা প্রদর্শন করে কোন চিকিৎসক দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করলে বা দায়িত্ব পালনে বিরত থাকলে উহার পরিণতিতে যদি রোগীর মৃত্যু হয় বা রোগী আহত হয়, তবে সেটা চিকিৎসকের অন্যায়-আচরণ বা অসদাচরণ বলে পরিগণিত হবে। একজন চিকিৎসকের পক্ষে ইহা দুই রকমের অপরাধ বলে পরিগণিত হতে পারে; দেওয়ানী ও ফৌজদারী। পরিশেষে বলব- দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ সব রোগীর জন্য হাসপাতাল উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আর সে কারণেই এখন জরুরি যে কাজটি হচ্ছে, হাসপাতাল যাতে রোগী ফিরিয়ে না দেয় সেটি নিশ্চিত করতে মনিটরিং বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। কেন চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যায় মানুষ। সচ্ছলরা যায় সিঙ্গাপুর, আমেরিকা কিংবা থাইল্যান্ড; একটু কম সচ্ছলরা ভারত। ভারতমুখী রোগীর সংখ্যাই বেশি। কেন দেশের বাইরে যায়? দেশের চিকিৎসায় কি তাদের আস্থা নেই? দেশের মানুষের স্বার্থে, চিকিৎসা সেবা উন্নয়নের স্বার্থে এসব বিষয় গুলো বিবেচনা করা দরকার। বেশিরভাগ রোগী সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সরণাপন্ন হন। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কিছু চিকিৎসক তাদের পর্যাপ্ত সময় দেন না। রোগীর রোগের কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই প্রেসক্রিপশন লিখা শেষ। রোগীরা তাদের প্রতি কাঙ্খিত মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে কিংবা রোগের কথা পুরোপুরি বলতে না পেরে খুবই অসন্তুষ্ট ভাবে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন জনের পরামর্শে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান। কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে আসতে হচ্ছে দেশের বাইরে। এ রোগীরা দেশেই উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিলে বা নিতে পারলে প্রতি বছর দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। রোগ নির্ণয়ে ভুল করা কিংবা অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি রোগীদের বিদেশমুখী করতে ভূমিকা রাখছে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের রোগীবান্ধব মানসিকতা তৈরি একটি জরুরি বিষয়। সন্তোষজনক চিকিৎসা সেবা পেলে কেউ নিশ্চয়ই বেশি ব্যয়ে বিদেশে যেতে চাইবেন না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের ওপর মানুষের আস্থা তৈরি করতে হবে। আমরা চাই দেশের চিকিৎসা আমাদের পূর্ণ আস্থা অর্জন করুক। তাহলে আর কেউ হয়তো চিকিৎসার জন্য বাইরে ছুটবে না। সরকারী হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশ পরিস্কার রাখা এবং রোগীর সাথে সুন্দর মার্জিত আচরণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হবে। চিকিৎসকদেরও তাদের সেবামূলক পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও আনুগত্য থাকতে হবে। আমাদের দেশে হৃদয়বান চিকিৎসকও রয়েছেন। তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তবে চিকিৎসক সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ আরো আন্তরিক হলে দেশের চিকিৎসা সেবার চিত্র অনেক বদলে যেতো। নিজের জীবন বাজি রেখে যারা করোনায় আক্রান্তদের সেবা প্রদান করছেন নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখেন। পাশাপাশি সাধারণ রোগীরা যেন নিয়মিত চিকিৎসা সেবা পায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলেই আন্তরিক হবেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
লেখকঃ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট