ঢাকাসোমবার , ২৫ নভেম্বর ২০২৪
  1. সর্বশেষ

চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্ঠা মাও:মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী–জিয়া হাবীব আহ্‌সান

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
২৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

জিয়া হাবীব আহ্‌সান

চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন
একদিনে বাস্তবায়ন হয়নি । এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কিছু
ক্ষনজন্মা মানুষের স্বপ্ন সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা,
চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটা ছিল Ôচাওয়া পাওয়া সোনার
হরিণ’ । ষাট দশকে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বহু পূর্বে ত্রিশ, চল্লিশ দশকে
প্রথম একজন কৃতিপুরুষ চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলেছিলেন । আজ তাঁকে আমরা ভুলতে
বসেছি, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এ- ইতিহাস জানে না । বার আউলিয়ার আবাদ ভূমি
ইসলামের প্রবেশদ্বার বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মূলত সর্বপ্রথম একটি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা চট্টল গৌরব
মরহুম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী । তিনি কদম মোবারক মুসলিম এতিম খানা
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পটিয়ার দেয়াঙ পহাড়ে তিনি ইসলামী আরবী বিশ্ব বিদ্যালয়ের জন্য
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ত্রিশ চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের
আনোয়ারা থানাধীন দেয়াং পাহাড়ে একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে
একটি জায়গাও তিনি দান করেছিলেন । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর একটি অদৃশ্য কারণে তা
ধামাচাপা পড়লেও ষাট দশকের প্রারম্ভে যখন পুনরায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয় তখন এটা দেয়াং পাহাড়ের নান্দনিক পরিবেশে স্থাপনের দাবী
উঠেছিল । মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পর অপর আর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রামের
তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান (১৯২৭-৫৪) ও পাকিস্তান গণ পরিষদ সদস্য (১৯৪৭-৫৪)
জনাব নূর আহমদ চেয়ারম্যান অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদের সদস্য (১৯৩৭-৪৬)
থাকাকালে আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী করেছিলেন ।
চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সর্বপ্রথম যাঁরা শুরু করেছিলেন
আমরা তাদের নাম উচ্চারন করতে ভুলে গেছি । ফলে নতুন প্রজন্ম এর সঠিক ইতিহাস থেকে
বঞ্চিত হচ্ছে বিধায় মরহুমের ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজকের আলোচনায় মরহুম
মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সেই স্বপ্নের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করলাম । মরহুম মাওলানা

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আগ্রাসী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের যেমন পুরোধা ছিলেন তেমনি
এতদাঞ্চলের অনগ্রসর শিক্ষা ক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন । দীর্ঘ ৯২ বছর আগে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে একটি এতিমখানা ও উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।

মরহুম শুধু এ দেশের স্বাধীনতা – সার্বভৌমত্বের জন্য সংগ্রাম সাধনা করেই ক্ষান্ত হননি একাধারে তিনি ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ধর্মতত্ববিদ, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক বাহক । এমন অসম্প্রদায়িক বহুমাত্রিক ক্ষণজন্মা প্রতিভার মূল্যায়ন ও জীবনচরিত আলোচনা আমাদের দেশ প্রেমিক নাগরিক সৃষ্টিতে অবদান রাখবে । অনাথ এবং এতিমদের জন্য তাঁর দরদী মন
বাস্তবজীবনে দারুনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে । চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহত্তম কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা ও স্কুল প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এর প্রকৃষ্ঠ উদাহারণ । তিনি আজও দেশ প্রেমিক মানুষের চেতনার বাতিঘর । ইতিহাস অধ্যায়নে আরো জানা যায়, চট্টগ্রামের দক্ষিণ মহকুমার কর্ণফুলীর তীরবর্তী দেয়াঙ পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল  তার আজীবন। ১৯১৫ সালে তিনি সেই লক্ষ্যে সরকার থেকে ৬০০ বিঘা জমি ও ওই এলাকার
জমিদার আলী খান থেকে ৫০০ কানি ভূমি রেজিস্ট্রিমূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গ্রহণ
করেছিলেন। বিখ্যাত নেতা ও শিক্ষাবিদ শেরেহিন্দ মাওলানা শওকত আলী ১৯৩৫ সালে এ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন। জঙ্গে জিহাদ, শাহ বদিউল আলম, শাহ জুলফিকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবল সমর্থক হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে ঐ সময় চট্টগ্রামে থাকতে রাজি হন। দেয়াং পাহাড়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ স্থান পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হন ভারতীয় সেরা রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরম খাঁ, মুন্সী রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী,
মাওলানা শওকত আলী। তিনি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তবে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার হাজারো আলেমের মনের ঐকান্তিক ইচ্ছার ফল স্বরূপ ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যার দ্বারা হয়তো আলেম সমাজের মনের বাসনা পূরণ লাভ করেছে। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর শিক্ষক। চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের ইতিহাস গবেষক সোহেল মোঃ ফখরুদ্দীন হতে
প্রাপ্ত তথ্য মতে তিনি ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার বরমা ইউনিয়নের আড়ালিয়ার চর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুনশী মুহাম্মদ মতিউল্লাহ আরবী-ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। মাতার নাম রহিমা বিবি। চট্টগ্রামের অপর নাম ছিল ইসলামাবাদ। সেই প্রেক্ষিতে মনিরুজ্জামান নামের এর শেষে ইসলামাবাদী টাইটেল যোগ করেন।
তিনি মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন। তিনি ঘরোয়া পরিবেশে ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। লেখা পড়ায় তার অদম্য আগ্রহের কারনে তাঁর পিতা তাঁকে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রেরন করেন। সেখানে তিনি হুগলী সরকারি মাদ্রাসায় ভার্তি হন। ১৮৯৫

খ্রীষ্টাব্দে হুগলী মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল স্যার ডেলিনন রস ও অধ্যাপক এ এইচ হালী তার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও নিজ চেষ্টায় বাংলা শিখেন। তাছাড়া আরবী, উর্দূতেও যথেষ্ঠ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি কলকাতায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদের পিতা মাওলানা খায়ের উদ্দীন এর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৮৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ
করেন। এ-মহান শিক্ষাবিদের কর্মজীবনের সূচনা হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। তিনি রংপুর হারাগাছি সিনিয়র মাদরাসায় সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। এখান থেকেই তিনি সাহিত্য, সমাজসেবা ও শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। অতঃপর তিনি মোলন্ডাগিরিতে না গিয়ে স্বাধীন জীবিকার উদ্দেশ্যে মোক্তারশিপ পরীক্ষা দেয়ার জন্য তৈরি হতে থাকেন। হঠাৎ
মন পরিবর্তন করে তিনি রংপুর জেলার হাড়াগাছিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। পরে তিনি সীতাকুন্ড সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামে। তিনি সীতাকুন্ড হাইস্কুলের পাকা ভবন নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ঐ সময় তিনি মিসরের আল-মিনার, আল-বিলাদ প্রভৃতি পত্রিকায় আরবি ভাষায় প্রবন্ধ লিখতেন এবং ভারতের দিল্লি, লক্ষ্মৌ প্রভৃতি স্থানের উর্দু পত্রিকায় নিয়মিতভাবে উর্দু ভাষায় প্রবন্ধ
লিখতেন । অতঃপর তিনি সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণের উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গমন করেন এবং রাজশাহীর জমিদার মির্জা ইউসুফ আলীর পরিচালনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক
সুলতান’ এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমর্থনে, ১৯০৮ সালে ত্রিপলী যুদ্ধ ও ১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধে তুরস্কের সমর্থনে সমগ্র বাংলাব্যাপী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি বাঙালি মুসলমানদের পুনর্জাগরণ ও প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালে কলিকাতা থেকে মাসিক সাহিত্য পত্রিকা
আল এসলাম প্রকাশনা ও সম্পাদনা করে সে যুগের প্রতিষ্ঠাবান মুসলমান লেখকগোষ্ঠী গঠনে সহায়তা করেছিলেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ঐ সময় তিনি ইতিহাস গবেষণায় লিপ্ত হয়ে বহু গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর
সাংবাদিকতার সূচনা হয় সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’-এর মাধ্যমে। সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পরে ‘দৈনিক ছোলতান’-এ উন্নীত হয়। তিনি ছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক। পরে আঞ্জুমানে ওলামায়ে ইসলাম বাংলা ও আসামের মুখপাত্র আল-ইসলামের সম্পাদক হন। এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে
তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মাঝে আত্মজাগরণের প্রেরণা ছড়িয়ে দেন। তিনি শিক্ষা- সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের অগ্রসর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাঙালী মুসলমানদের জাতিগত ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক । তৎকালীন দুনিয়াজোড়া খ্যাতির শীর্ষে ছিল ফারসী ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক

সংবাদপত্র Ôহাবলুল মতিন’। প্রাচ্যের নেতা আল্লামা জামালুদ্দিন আফগানীর শিয্য ইরানের নির্যাতীত ত্যাগীনেতা আগা মঈদুল ইসলামের সম্পাদনায় কলকাতায় ইংরেজীতে Ôমিল্লাত’ ও উর্দু-ফারসীতে, দৈনিক Ôহাবলুল মতিন’ প্রকাশিত হতো। ১৯২৬ সালে কলিকাতায় দাঙ্গার সময় কলিকাতা প্রবাসী চট্টগ্রামের মুসলমান ব্যবসায়ীরা যৌথভাবে Ôদৈনিক সুলতান’ পত্রিকা প্রকাশ করে মাওলানা ইসলামাবাদীকে সম্পাদক করেন। সেই দুর্যোগের সময় তিনি
Ôদৈনিক সুলতানের’ মাধ্যমে মসিযুদ্ধ চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে পত্রিকার পরিচালনা কমিটির কর্তাব্যক্তি চট্টগ্রামবাসী জনৈক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার হঠকারিতায় মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী Ôদৈনিক সুলতানের’ পদ পরিত্যাগে বাধ্য হন। তখন তিনি Ôদৈনিক আমির পত্রিকা’ প্রকাশ করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অর্থাভাবে তাও বন্ধ হয়ে যায়, আর সুযোগ্য সম্পাদকের অভাবে Ôদৈনিক সুলতান’-এর ভরাডুবি হয়।
মাওলানা ইসলামাবাদী Ôহাবলুল মতিনের’ বাংলা সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন। এরজন্য মাওলানা ইসলামাবাদীকে বলা হয় বাংলায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক। সংবাদপত্র জগত ও মুসলিম সাংবাদিকতায় মাওলানা ইসলামাবাদীর অবদান অপরিসীম। তিনি চট্টগ্রাম থেকে সাপ্তাহিক ইসলামাবাদ নামেও একখানি পত্রিকা পরিচালনা
করেছিলেন। তিনি সোলতান (পত্রিকা) (১৯০১), হাবলুল মতিন (১৯১২), মোহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনুর (১৯১১), বাসনা (১৯০৪) এবং আল এছলাম পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ওই শতকের প্রথমে রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস, খেলাফত কমিটি, নিখিল বঙ্গীয় কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতি, জমিয়ত-
এ ওলামায়ে হিন্দের বাংলা-আসাম শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের তিনি ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমা (বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও কক্সবাজার পর্যন্ত এলাকার) থেকে প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি
চট্টগ্রামের কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সময়ে তিনি কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা হারান এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সমর্থন দান করে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। তাঁর জীবনের গুরত্বপূর্ণ ঘটনা হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগদান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কার্যক্রমের প্রতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন । ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল
হকের কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী।

একজন আলেমের আইনসভায় সদস্য পদ লাভ একটি ইতিহাস। তিনি স্বদেশের জন্য কারাবরণ করেছেন। সে সময় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিপ্লব কেন্দ্র স্থাপন করেন। আজাদ হিন্দু ফৌজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৪ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। আটক রাখা হয় লাহোরের মিয়ানওয়ারী দুর্গে। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান। নেতাজী যখন আজাদ হিন্দ
ফৌজ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়িয়ে দিল্লি চলো স্লোগান তুলে এগিয়ে চলছিলেন ভারতের দিকে ঐ সময় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাথে পরিচয় ঘটে বেংগল ভলান্টিয়ার্স এর সুবোধ চক্রবর্তীর। সুবোধের সাথে আলাপ করে মাওলানা মনিরজ্জামান ইসলামাবাদী এত বেশি মুগ্ধ হন যে শেষ বয়সে একটা ঝুঁকি নেবার জন্য রাজি হয়ে পড়েছিলেন। সুবোধকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড়ে। চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে আরাকানের পথ ধরে আবারো নেতাজীর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে যখন পথ চলছিলেন তখন সীমানা এলাকায় ছিল সতর্ক পাহারা। আজাদ হিন্দ ফৌজ দখলে থাকার কারণে সতর্কতা যেন সীমাহীন হয়ে পড়েছিল। মাওলানা
মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বীরকণ্ঠে তার সহচরকে বলছিলেন, “আমার জীবনের মাত্র কয়েকদিন বাকি, এই চরম ঝুঁকি নিতে আমার অসুবিধেও নেই।” তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিলেন- শ্যালক মোর্শেদকে নিয়ে একেবারে ফকির সেজে নেতাজীর সাথে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। ব্রিটিশ গুপ্তচরেরা তখন মাওলানার সমস্ত বিপ্লবী কার্য টের পায়। সে কারণে তার শহরস্থ বাড়ি, তৎকালীন পটিয়ার (বর্তমান চন্দনাইশ) বাড়ি, সীতাকুন্ডের বাড়ি,
কলকাতার বাসভবনে ইংরেজ সার্জেন্টের নেতৃত্বে বিপুল সৈন্যের মাধ্যমে তলাশি চালানো হয়।

 

ঐ সময় মাওলানাকে চট্টগ্রাম শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জহরলাল নেহরু- প্রভৃতি নেতার সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকেও দিল্লীর লালকিল্লায় বন্দী করে রাখেন। অতঃপর তাঁকে সেখান থেকে পাঞ্জাবের ময়াওয়ালী জেলে স্থানান্তর করেন। সেখানকার জেলের ছাদের বিমের সঙ্গে রজ্জু দিয়ে ৬৫ বছর বয়স্ক
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর দু’পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে গোপন তথ্য জানার জন্য তাঁর উপর অশেষ নির্যাতন চালানো হয়েছিল গোপন তথ্য জানার জন্য। কিন্তু বৃদ্ধ বিপ্লবী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে গেছেন তবুও আদর্শচ্যুত হননি। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী একজন দুরদর্শী রাজনীতিজ্ঞ
ছিলেন, ছিলেন সাহিত্যিক সাংবাদিক, লেখক-গবেষক। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের যুগে তিনি কলিকাতার নবযুগ ও আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানের অসারতা প্রতিপন্নমূলক বহু প্রবন্ধে যে সব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; ৭১ সালে তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষপর্বে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী নিজ মাতৃভূমি পূর্ববঙ্গে না এসে কলিকাতায় অবস্থান করেন। সেখানে বছর
দু’য়েক মাস অবস্থান করার পর তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যান।

 

বন্ধুবান্ধবদের পীড়াপীড়িতে তিনি দেশে ফিরতে সম্মত হওয়ার পর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে তাঁকে চট্টগ্রামে আনা হয়। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সফললভাবে সাহিত্য চর্চা ও রচনা  করেছেন। তার সাহিত্য রচনায় সাহসিকতা চর্চা প্রাধান্য পেয়েছিলো। তিনি একাধিক ভাষায়  ইসলামি সভ্যতা ও গণমানুষের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। তিনি দেশীয় ও বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়েও লেখালিখি করেছেন। এই শিক্ষাবিদ ৪২ টির মতো গ্রন্থ রচনা করেন। মাওলানা
মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী রচিত, প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলির একটি তালিকা ইসলামাবাদী গবেষক সাংবাদিক ছৈয়দ মোস্তাফা জামালের গ্রন্থে প্রাপ্ত তথ্য তালিকাটি নিম্মরপ- (১) ভারতের মুসলমান সভ্যতা (২) ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান (৩) খগোল শাস্ত্রে মুসলমান (৪) তুরস্কের সুলতান (৫) নিজামুদ্দিন আউলিয়া (৬) কনস্টান্টিনোপল ও মুসলমান জগতের অভ্যুত্থান (৭) ভারতে ইসলাম প্রচার (৮) আওরঙ্গজেব (৯) কোরান ও রাজনীতির
বাণী (১০) কোরান ও স্বাধীনতার বাণী (১১) কোরান ও বিজ্ঞান (১২) ইসলামের শিক্ষা (১৩) বাংলার ওলি কাহিনি (১৪) আসাম ভ্রমণ (১৫) ভারতের মুক্তিসংগ্রামে মুসলমান (১৬) ইসলামের পুণ্য কথা (১৭) আবে হায়াত (১৮) সমাজ সংস্কার (১৯) সুদ সমস্যা (২০) নিম্ন শিক্ষা ও শিক্ষা কর (২১) আত্মজীবনী। তাছাড়া তাঁর অজস্র প্রবন্ধ উভয় বাংলায় বিভিন্ন
পত্র পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হত। চট্টগ্রামের এ ক্ষনজন্মা, বিপ্লবী মাওলানা মনিরজ্জামান ইসলামাবাদী ৭৫ বছর বয়সে ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর চন্দনাইশের বরমা গ্রামে তাঁর নিজ বাড়িতে পরলোকগমন করেন। ইসলামাবাদীর শেষ ইচ্ছা অনুসারে চট্টগ্রাম শহরস্থ কদমমোবারক নবাব এয়াসিন খাঁর মসজিদ সংলগ্ন ও তারই প্রতিষ্ঠিত কদম মোবারক মুসলিম এতিম খানার সামনে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর চারদিন পর
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নাগরিক শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ ও সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত কৃষক নেতা মির্জা আলী। উক্ত সভায় ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী উপস্থিত থেকে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে
আলোচনা করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সমাধিলিপি লিখে গেছেন ইসলামাবাদীর সমাধির গায়ে লিখা আছে তাঁর একটি ফার্সি কবিতার বাংলা অনুবাদ যা
নিরূপ:

“পথিক: ক্ষণেকের তরে বস মোর শিরে
ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে
যে জন আসিবে মোর সমাধি পাশে।
ফাতেহা পড়িয়া যাবে মম মুক্তির আশে।

অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার।
এছলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।”

মরহুমের ২ পুত্র । শাহাজাহান ইসলামাবাদী এবং বিএম আজাদ ইসলামাবাদ। মরহুম আবুল কালাম আজাদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমাজ পত্রিকায় আমি ছাত্রজীবনে নিয়মিত লিখতাম । আজাদ সাহেবের এক পুত্র মিলন, এক কণ্যা শাহানা বিলকিস খান স্মৃতি। তাঁর কন্যা ও মরহুম ইসলামবাদীর নাতনি বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী শাহানা বিল্কিস খান স্মৃতি আমাদের চট্টগ্রাম কলেজের (৮১-৮২ ব্যাচের) সহপাঠী ছিলেন। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও ইতিহাসের কৃতি
সন্তানদের অবদানকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে না ধরলে জাতিস্বত্তার বিনাশ ও বিস্মৃতির অতল গর্ভে তা বিলীন হয়ে যায়। তাই এই সব মহাপুরুষদের জীবনী-আলোচনা
জাতিস্বত্ত্বাকে সজীব ও প্রাণীত করে, সুদৃড় হয় স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব ও দেশপ্রেম, মরহুম মগফুর মাওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন তাদের অন্যতম। আল্লাহ্‌ পাক রহমান রহীম এই মহান মনিষী শিক্ষাবিদ ও আকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামীর সকল অবদানকে কবুল ফরমান,
আমীন।

লেখক – আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।

তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতাঃ
১। সোহেল মোহাম্মদ ফখরুদ্দীন, ইতিহাস গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী,
পরিচালক, চট্টগ্রাম ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্র।
২। “মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও তাঁর অবদান”। দৈনিক আজাদী ২০১৯-০৯-২৫।
সংগ্রহের তাং-২০২০-০৯-০৭ ইং।
৩। পরিষদ, সম্পাদনা (জুন ১৯৮২)। সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ ২য় খণ্ড। শেরেবাংলা নগর,
ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ২৮৭।
৪। “মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রহ.)-এর জীবনালেখ্য”। banglanews24.com।
সংগ্রহের তাং-২০২০-০৯-০৭ ইং।
৫। (ছৈয়দ মোস্তফা জামাল সম্পাদিত, মাওলানা ইসলামাদী; ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, মুসলিম
বাংলা সাহিত্য।)।
৬। “ইসলামাবাদী, মওলানা মনিরুজ্জামান – বাংলাপিডিয়া”।
গ্রন্থপঞ্জি-
৭। প্রফেসর খালিদ হোসেন, আ ফ ম (২০২২)। নিভে যাওয়া দীপশিখা ১। বাংলাদেশ: আকাবিব
স্টাডিজ অ্যান্ড পাবলিশিং হাউস। পৃষ্ঠা ১৮১–১৮৭।

৮। ইকবাল, আকাশ (২০২০)। বহুমাত্রিক কিংবদন্তী মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী।
বাংলাদেশ: তৃতীয় চোখ।
৯। ইসলামাবাদী – নেছার আহমদ

288 Views

আরও পড়ুন

পাঠকের অনূভুতিতে ❝কলিজার আধখান❞

অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে বিএনপি সন্দেহ করছে–ড. হুমায়ুন কবির

বিশ্বরূপ চন্দ্র বিশ্বাসের কবিতা:- হাসি

শান্তিগঞ্জে জমিয়তের গণসংবর্ধনা ও কাউন্সিল শুক্রবার

শান্তিগঞ্জে জমিয়তের গণ সমাবেশ সফল করার লক্ষে সংবাদ সম্মেলন

আইডিইবির ৫৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আধুনগর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের র‌্যালি ও আলোচনা সভা

দোয়ারাবাজারে এফআইভিডিবি’র স্বাস্থ্য সামগ্রী বিতরণ

বোয়ালখালীর নব যোগদানকৃত শিক্ষা অফিসার হারুন উর রশীদকে বরণ

জামালপুরে মৃত আইনজীবী হলেন অতিরিক্ত জিপি

তানযীমুল উম্মাহ হিফয মাদ্রাসা, সাইনবোর্ড শাখার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান সম্পন্ন

সাইফুল ইসলামের কবিতা : শীতের আমেজ

সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ইসলামি বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ