ঢাকাবুধবার , ৩ ডিসেম্বর ২০২৫
  1. সর্বশেষ

করোনাকালীন উমরাহ্ হজ্ব ভিন্ন আমেজ, ভিন্ন অনুভূতি

প্রতিবেদক
নিউজ ভিশন
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৫:০৯ অপরাহ্ণ

Link Copied!

লেখকঃ আশফা খানম, নারী উন্নয়নকর্মী, কলামিষ্ট ও প্রিন্সিপ্যাল সিভিএনএস ।

আশফা খানম

আলহামদুল্লিাহ, মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দরবারে অশেষ শুকরিয়া যে তিনি তাঁর দরবারে আমাদের হাজিরাকে কবুল করেছেন। গত ২৭শে ডিসেম্বর পরম করুনাময়ের ইচ্ছায় আমি ও আমার স্বামী পবিত্র উমরাহ্র উদ্দেশ্যে মদিনা মনোয়ারার পথে যাত্রা করি। গত ২০২০ সালের এপ্রিলে আমার স্বামী এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সানের ফুসফুস করোনায় খুব খারাপভাবে আক্রান্ত হলে মা ও শিশু হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি নিয়ত করেন সুস্থ হলে তিনি স্বস্ত্রীক উমরাহ্ পালন করবেন। দীর্ঘদিন করোনাকালীন সময়ে উমরাহ্ ও হজ্ব বন্ধ থাকায় হঠাৎ ২০২১ এ আবার উমরাহ্ জন্য খুলে দেওয়ায় আল্লাহর ঘর তাওয়াফ ও মহানবী (সাঃ) এর রওজা জিয়ারত করার জন্য মন ব্যাকুল ও উতলা হয়ে উঠে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পঞ্চাশোর্ধ উম্রাহ পালনের উপর হঠাৎ বিধিনিষেধ আরোপিত হওয়ার এক ধরণের সংবাদ আসায় এ যাত্রায় বাঁধ সাধে। ফলে আমরা হজ্বে ‘বাইতুল্লাহ ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস’ নামীয় কাফেলায় রেজিষ্ট্রেশন করার পরও চরম উৎকন্ঠায় ছিলাম। কেননা আমার স্বামী পঞ্চাশোর্ধ ছিলেন এবং তিনি যেতে না পারলে মাহারাম ছাড়া আমারও যাওয়া সম্ভব নয়। অবশেষে, আমাদের এজেন্সী সৌদি আরবে খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত করেন যে এরূপ কোন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি যা গুজব মাত্র। বরং উমরাহ্কারীকে ১৮ বছর বয়সের উপর হতে হবে। বয়সের এ বাধার কারণে আমাদের ছোট সন্তান রিয়াদ আহসানকে সাথে নেয়া সম্ভব হলো না। যাত্রার ২ দিন পূর্বে ভিসা নিশ্চিত হওয়ার পর এবং পিসিআর টেষ্টে নেগেটিভ রিপোর্ট আসলে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করি এবং চরম উৎকন্ঠার অবসান ঘটে।

এ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে আমরা হজ্ব ও বেশ কয়েকবার উমরাহ্ পালন করলেও এবারের উমরাহ্ পালন ছিল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । কেননা প্রথমতঃ করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আমরা উমরাহ্য় যাত্রা করছি। দ্বিতীয়তঃ আমার তিন ননদ যথাক্রমে তাসনীম আরা বেগম (পান্না), এডভোকেট জান্নাতুল নাঈম (রুমানা), জান্নাতুল নাবিলা (তানিয়া) এবং কনিষ্ট জনের স্বামী মুহাম্মদ ইসমাইল ও আমার স্বামীর কলিগ এড. সৈয়দ মোঃ হারুন ও তৎ স্ত্রী মিসেস শাহীন ফেরদৌস ঝিনুক, আমাদের মুরুব্বী ও অভিভাবক তুল্য চট্টগ্রাম ওয়াসার এম.ডি একেএম ফয়লুল্লাহ সাহেব, তাঁর কন্যা ও জামাতা বিএম এ নেতা ডাঃ ফয়সাল ইকবাল (স্বস্ত্রীক), আমাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়া রুনা, আমার ননদ ডাঃ রুজির বান্ধবী চ.বি. বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা শায়লা (মনি) ও তাঁর স্বামী ডেইলীস্টার চট্টগ্রামের ব্যুরো চীফ সাংবাদিক শিমুল নজরুল ভাই প্রমুখ সহচরদের নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয় । প্রফেসর মাওলানা ডাঃ গিয়াসুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে প্রায় ৫৫ জনের কাফেলা নিয়ে গত ২৭ শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সে সকালে প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এবং রাত্রে ঢাকা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। ঢাকায় দীর্ঘক্ষণ অবস্থান এবং যাত্রা দেরী হওয়াকে আমরা আমাদের ধৈর্য্য পরীক্ষার শুরু মনে করে আল্লাহর ওয়াস্তে সবর করি। একই ফ্লাইটে ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি আমার শ্বশুর আব্বার স্নেহধন্য বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব এস.আলম মাসুদ সাহেব ও তাঁর পরিবারের ৫৫ জন সদস্য/ সদস্যা।অবশেষে আল্লাহ্র রহমতে বিরতিহীন ৭ ঘন্টা যাত্রা শেষে আমরা মহানবী (সাঃ) স্মৃতি বিজরিত পবিত্র নগরী মদিনা মনোয়ারায় এসে পৌঁছি। এবারের যাত্রা তাৎপর্যপূর্ণ হবার আরো বিশেষ যে কারণ গুলো আছে তাই এ লেখার মাধ্যমে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি।
মদিনা এয়ারপোর্টে নেমেই ইমিগ্রেশনে গিয়ে আমি বিষ্মিত হই। কারণ মাথায় হিজাব পরিহিতা লম্বা লম্বা পুলিশী পোষাকে একদল অল্প বয়স্ক মেয়েরা সেখানে ইমিগ্রেশনের কাজে নিয়োজিত। ওখানে কাজে নিয়োজিত পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের সংখ্যা বেশি বলে মনে হলো। আর তারা খুব নিবির্ঘ্নে দ্রুততার সাথে সুষ্ঠুভাবে ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করে। আরো ভালো লাগলো মেয়ে গুলোকে ইংরেজী বুঝতে ও বলতে দেখে। অথচ এর পূর্বে যতবার এসেছিলাম দীর্ঘ লম্বা লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িঁয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার ইমিগ্রেশন কাজে নিয়েজিত পুরুষ কর্মীরা খুব অবহেলার সাথে তাদের কাজ করতো। তারা দীর্ঘলাইনে হাজীদের দাঁড় করিয়ে পরস্পর গল্প গুজব করতে ও চা খেতে দেখেছিলাম। আবার তারা ইংরেজী বুঝতে ও বলতেও অক্ষম ছিল। বর্তমানে সৌদি সরকারের এই উদ্যোগ (মহিলাদের কাজে নিয়েজিত করা) সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি অনুধাবন করলাম যে, মহিলারা তাদের কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল ও আন্তরিক । অতঃপর সবাই আমরা নির্দিষ্ট বেল্ট থেকে আমাদের লাগেজ সংগ্রহ করে বের হয়ে কাফেলা কর্তৃক ভাড়া করা সুন্দর ২টি বাসে উঠে নিজ নিজ আসনে বসে পড়লাম। এবার মদিনার মসজিদ-এ- নববীর দিকে যাত্রা শুরু। তখন রাত প্রায় ১০টা। চারিদিকে অন্ধকার। মাঝে মধ্যে অনেক দূরে আলোর সন্ধান মেলে। আবার কখনো কখনো সে আলো দৃষ্টি সীমা থেকে হারিয়ে যায়। ধু ধু মরুভূমির দিকে বাস ছুটে চলেছে । দরূদ শরীফ পড়তে পড়তে প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি মনে মনে বার বার সালাম পৌঁছাচ্ছিলাম।

অতঃপর মসজিদে নব্বীর একেবারে সীমানার কাছে আমাদের ‘আল আকিক’ পাঁচ তারকা হোটেলের সামনে গাড়ী এসে থামে। আগে দেখা সেই জমকালো কোলাহলপূর্ণ মদিনা নয়, এ যেন অন্য আরেক মদিনা। কেননা মসজিদ-উল-নববীর চারপাশে গড়ে উঠা বিশাল বিশাল হোটেলগুলোর অধিকাংশই জনশূন্য ও অন্ধকার। সম্ভবতঃ হোটেলগুলো করোনাকালীন সময়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং উমরাহ হাজীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হোটেলগুলো বন্ধ প্রায়। ঠিক সেরকম সারাদিন রাতে খোলা থাকা মার্কেটগুলোর অধিকাংশ দোকান বন্ধ দেখলাম। এ চেনা জায়গাকে হঠাৎ অন্যরকম অপরিচিত মনে হলো। হঠাৎ হঠাৎ শীতের মৃদু বাতাসে আমরা ঠান্ডা অনুভব করছিলাম, তার মধ্যে আলোহীন বিশাল বিশাল দালান আর শুনশান নীরবতায় মদিনা মনোয়ারাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করলাম। শুধু যে হোটেলগুলো খোলা ছিল সেখানে আলো জ্বলছিল। আমরা লাগেজ নিয়ে পাসপোর্ট ও অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দিয়ে কার্ড বুঝে নিয়ে যার যার রুমে ছুটে চল্লাম। আমাদের জন্য কাফেলার পক্ষ থেকে রান্না করা ডিনার টিফিন ক্যারিয়ারে দেয়া হয়েছে। আমরা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিই। কেননা অল্প কিছুক্ষণ পর তাহাজ্জুদের আজান দিবে। করোনার ভয়াল থাবা থেকে বেঁচে এসে আবার মদিনায় আসতে পেরে মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নব্বীতে যাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। তাই দেড়ি না করে আমরা মসজিদ-উন-নববীর দিকে ছুটে চললাম। মসজিদ-উন-নববীতেও আগের মতো কোলাহল,ধাক্কাধাক্কি বা ভীড় নেই। নিজেদেরকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছিল। আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার কাছে শুধু শুকরিয়া জানাচ্ছিলাম আমাদেরকে এ যাত্রায় কবুল করার জন্য, আমীন। মসজিদের ভেতরে ও যথেষ্ট জায়গা আছে। সবাই ফাঁক ফাঁক করে অবস্থান নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। ছোট শিশুদের ব্যাপারেও বাধানিষেধ থাকায় স্থানীয় ছাড়া অন্য কোন শিশুকে এবার দেখতে পাইনি। মাক্স পরা বাধ্যতামূলক। মাক্স ছাড়া নেকাব পড়লেও ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সকলে শৃংঙ্খলার সাথে সুন্দর ভাবে ইবাদত বান্দেগী করছেন । পিন্ পতন্ নীরবতার মধ্য দিয়ে ফজরের জামাত সম্পন্ন হয়। আগে শিশুদের কান্নার রোলে, চেচাঁমেচিতে মসজিদ উন নববীর প্রাঙ্গনে মুখরিত থাকতো । তাই সেখানে এখন শুধু ইমামের সূরাগুলো শূন্যতার মধ্যে যেভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল তখনই ওহী নাযিল হচ্ছে। বুকের ভিতরে এক ধরণের শিহরণ বোধ করছিলাম। প্রতিবার সিজদায় পরমকরুনাময় এর নিকট কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলাম। অতঃপর পাঁচতারাকা হোটেলের রাশিয়ান/ এরাবিয়ান বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বিশ্রাম নিই । আমাদের শর্ট টাইম ভিজিটে ২৯/১২/২০২১ ইং বুধবার সকালে মসজিদউল কুবা, মসজিদ উল কিবলা তাইন, সালমান ফারসীর খেজুর বাগান, খন্দকের যুদ্ধে যে পরিখা তৈরী করা হয় সে স্থান গুলো সহ ঐতিহাসিক কিছু জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখানো হয় । উল্লেখ্য মসজিদ-উল-কুবা মদিনায় প্রতিষ্ঠিত রাসুল (সাঃ) কর্তৃক প্রথম মসজিদ । প্রায় প্রতি শনিবার মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনা থাকাকালীন এ মসজিদে নামাজ পড়তেন । হাদীসে আছে যে ব্যক্তি এই মসজিদে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে পবিত্রতার সাথে ঘর হতে বের হন এবং সেখানে নামাজ আদায় করেন । তিনি একটি কবুল উমরাহ হজ্বের সওয়াব পান । তাই আমরা সবাই সে সুযোগ কাজে লাগালাম । অতএব জোহরের নামাজের পূর্বে আমরা আবার ফিরে যথারীতি মসজিদ উন নব্বীর । পথে যেতে যেতে আমাদের কাফেলার দলনেতা প্রফেসর ড. গিয়াসউদ্দিন তালুকদার ভাই বাসের ভিতরে আমাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ইতিহাস সম্পর্কে বলছিলেন। এর পূর্বেও যতবার পবিত্র মক্কা-মদীনা শহরের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো পরিদর্শন করলেও প্রতিবার সেগুলো সম্পর্কে বয়ানগুলো শুনলে নতুনভাবে নিজে উজ্জীবীত হই বলে মনে হয় ও মনের মধ্যে প্রশান্তিভাব অনুভূত হয়। এছাড়াও পথিমধ্যে যখন যে জায়গা যে কারণে উল্লেখযোগ্য ছিল গিয়াস ভাই সেগুলো সম্পর্কেও বলছিলেন। করোনাকালীন সময়ে বন্ধ হওয়া মসজিদগুলোর অনেকগুলো এখনও বন্ধ আছে। আর কিছু মসজিদ পূর্বের মতো যে কোন সময়ে প্রবেশের অনুমতি নেই। শুধু নামাজের ওয়াক্তে মসজিদের দরজা খুলে দেয়া হয়। অতঃপর তৃতীয় দিন (বুধবার ৩০/১২/২১ ইং) মদিনায় আমাদের যথাযথভাবে বাকী সময় ইবাদতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। এবার পূর্বের মতো যে কোন সময় রাসূল পাকের রওজা জিয়ারতের অনুমতি নাই। তাওয়াক্কাল এ্যাপস্ এর মাধ্যমে রওজা জিয়ারতের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করে অনুমতি পেলে তবেই প্রবেশ সম্ভব। উল্লেখ্য, কাফেলা থেকে দেয়া বার কোড সম্বলিত হেন্ড বেল্ট দেখে অথবা তাওয়াক্কাল এ্যাপস্ রেজিষ্ট্রেশনের লিস্ট মিলিয়ে দেখে রাসুলে পাকের রওজায় প্রবেশ সম্ভব। অতঃপর কাফেলা আমাদের জন্য তৃতীয় দিন বুধবার ফজরের নামাজের পর রওজা জিয়ারতের ব্যবস্থা করে নামের লিস্ট মিসেস হারুনের (ঝিনুক) দায়িত্বে বুঝিয়ে দেন। আমরা মহিলারা জামাতে নামাজ শেষে সবাই মসজিদের ২৫ নং গেইটে একত্রে অপেক্ষা করতে থাকি। অন্যরাও সবাই লাইন ধরে অপেক্ষা করছিল। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে লাইন ধরে সুশৃংঙ্খলভাবে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে রিয়াদুল জান্নাহ, প্রিয় নবী হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ), প্রিয় খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ), খলিফা হযরত উমর (রাঃ) কে সালাম জানাতে জানাতে জিয়ারতের শেষে রিয়াজুল জান্নাতে প্রবেশ করি। সেখানে প্রত্যেকের জন্য নামাজ পড়ার নির্দিষ্ট দাগ দেয়া আছে।আমরা পছন্দমত দাগে দাঁড়িয়ে শুকরানার নামাজ, নফল নামাজ, তওবার নামাজ, দোয়া কবুলের নামাজ পড়ি এবং প্রাণ ভরে মুনাজাত করি। চারিদিকে পিন্ পতন নীরবতা। এবারের মতো এতো প্রশান্তি চিত্তে রিয়াদুল জান্নাহ্য় নামাজ পড়ার সৌভার্গ্য কখনো হয়নি। সব সময় চিৎকার, চেচাঁমেচি, ধাক্কাধাক্কির মধ্যে কোন রকম ২ রাকাত নফল নামাজ পড়তে পেরেছিলাম। প্রতিবার সেখান থেকে ফিরার পর আমরা হৃদয়ে ব্যাথা অনুভব করতাম এবং আক্ষেপ ছিল প্রিয় নবীর রওজার সম্মুখে এ কেমন বেআদবি। অথচ পবিত্র কুরানে আল্লাহ সুবাহানু ওয়াতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবীব নবী করিম (সাঃ) এর সম্মুখে উঁচু গলায় কথা বলার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেন। সেখানে এমনতর পবিত্র স্থানে, যেখানে দুরদেশ থেকে আমরা গুনাহ্ মাফ ও আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য আসি সেখানে অন্যকে সুযোগ করে না দিয়ে কিভাবে নিজে আগে পাবো সে চেষ্টায় লিপ্ত থাকি। একটি কথা আছে “সভ্যজাতি চিন্তা করে আমি তো পাবোই, তাই সে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। আর অসভ্য জাতি ভাবে আমাকে আগে পেতে হবে”। রিয়াদুলজান্নাহ্য় নামাজ পড়লেই জান্নাতে যাওয়া যাবে এবং আমাকে আগে জান্নাতে যেতে হবে এমন মানসিকতার কারণে আমাদের এই অসভ্য, বিশৃঙ্খল ও অশোভনীয় আচরণ। আমরা কি ভেবে দেখেছি এটাই কি আমার নবীর শিক্ষা বা ইসলামের দীক্ষা? প্রত্যেক কাফেলার পক্ষ থেকে তাই এ ব্যাপারে উমরাহ ও হাজীদের কুরআন হাদিসের আলোকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সতর্ক করা উচিত। আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে অন্যকে সহযোগিতা করার মনোভাব তৈরী করতে পারলেই তো এ পবিত্র স্থানে ইবাদতের সার্থকতা নিহিত। আমাদের প্রিয় নবীও তো আমাদের জন্য জায়গা করে দেয়। পূর্বের তিক্ত স্মৃতিগুলো আমাকে সবসময় পীড়া দিতো। তাই এবারের অভিজ্ঞতা ছিল আত্মতৃপ্তিদায়ক বা প্রশান্তিদায়ক।
হাজীদের জন্য হজ্জের পরে কিংবা আগে মসজিদে নব্বী ও মহানবীর (সাঃ) রওজা যিয়ারত যে কত জরুরী এবং সৌভাগ্যের বিষয় তা প্রিয় নবী (সাঃ) এর একটি হাদীস থেকেই প্রমান হয়ে যায়। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার কবর জিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল (বায়হাকী)। সুবাহানআল্লাহ্। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ সুবহানুওয়াতায়ালা স্বয়ং বলেন, “যদি এই জালিমরা আপনার দরবারে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতঃ এবং আল্লাহর রাসুল যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তাহলে তারা আল্লাহকে অবশ্যই তওবা কবুলকারী ও দয়ালু হিসেবে পেতই ।তাই আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের জন্য এটি কত বড় সম্মানিত স্থান আয়াতটি তারই প্রমান দেয়। হায়াতুন্নবী মহানবী (সাঃ) পবিত্র মদীনা নগরীকে ভালবাসতেন এবং এখানেই তিনি অবস্থান করছেন। একথা ভাবতেই শরীর মন আন্দোলিত হয়ে উঠে।
এই মসজিদে নব্বী (সঃ) এ রয়েছে ৮টি বরকতময় রহমতের স্তম্ভ বা থাম (পিলার)। প্রথম স্তম্ভটির নাম উস্তুয়ানা হান্নানা, এ স্তম্ভটি সেই খেজুর গাছের গুঁড়ির স্থানে তৈরী হয়েছে। মিম্বর তৈরীর পূর্বে মহানবী (সাঃ) এখানে খোতবা দিতেন। মিম্বরটি স্থানান্তরিত হওয়ার পর যে গাছটি ক্রন্দন করেছিল, তা ঐস্থানেই ছিল। এ স্তম্ভটিকে উস্তওয়ানাতু মুখাল্লকও বলা হয়। সাহাবীদের কেউ কেউ এখানে নফল নামায আদায় করতেন। দ্বিতীয় স্তম্ভটির নাম উস্তওয়ানাতু আয়েশা। একে উস্তওয়ানাতুল কুবা বা মুহাজিরীনও বলা হয়। এখানে রাসুলে পাক (সাঃ) গোপনে ১০ (দশ) ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন। এটি দোয়া কবুলের স্থান। হযরত মা আয়েশা (রাঃ) এ গোপনীয়তা প্রকাশ করেন বিধায় এর নাম উস্তুয়ানা আয়েশা (রাঃ)। এটা মহানবী (সাঃ) এর হুজরা শরীফ ও মিম্বর শরীফের মধ্যকার তৃতীয় স্তম্ভ। কেবলা পরিবর্তনের পর রসুল (সাঃ) এ স্তম্ভটির দিকে নামাজ আদায় করতেন। বিশিষ্ট মুহাজিরগণ যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণ এ স্তম্ভের দিকেই নামাজ আদায় করতেন এবং সেখানে মিলিত হতেন। তৃতীয় স্তম্ভটির নাম উস্তাওয়ানাতু তওবা। এটা হুজরা শরীফ থেকে দ্বিতীয় এবং মিম্বর শরীফ থেকে ৪র্থ স্তম্ভ। যা হযরত আয়েশা (রাঃ) এর হুজুরার দিকে অবস্থিত। কথিত আছে যে, এ স্তম্ভ ও কবর শরীফের মধ্যে বিশ গজের ব্যবধান, হযরত আবু লুবাবা (রাঃ) একটি ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তিনি নিজেকে স্তম্ভটির সাথে বেঁধে ফেলেন এবং বলেছিলেন, যতক্ষন না রাসুলে পাক (সাঃ) আমাকে খুলে দেবেন ততক্ষন পর্যন্ত আমি এভাবেই থাকবো। প্রায় ১০ দিন মতান্তরে ৫০ দিন কান্নাকাটির পর আবু লুবাবা (রাঃ) এর তওবা (আল্লাহ পাকের নির্দেশে) কবুল হলে তাঁর বাঁধন মহানবী (সাঃ) খুলে দেন। কেবল নামাজ ও প্রশ্রাব পায়খানার সময় তার পুত্র এসে বাঁধন খুলে দিতেন। সুতরাং এ স্তম্ভটিও তওবা কবুলের স্থান হিসেবে চিহ্নিত ও বিবেচিত। এটি এখন রওজা শরীফের অভ্যন্তরে পড়ে গেছে। চতুর্থ স্তম্ভটির নাম উস্তওয়ানুতুস সরীর। এটা জানালা শরীফের সন্নিকটে উস্তনায়ে তাওবায় পূর্ব দিকে অবস্থিত। এখানে রাসুলে পাক (সাঃ) ইতিকাফ করতেন। রাতে হযরত (সাঃ) এর আরামের জন্য বিছানা মুবারক পাতা হতো। হযরত আয়েশা (রাঃ) চিরুনী দিয়ে তাঁর মাথায় চুল আঁচড়িয়ে দিতেন। পঞ্চম স্তম্ভটির নাম উস্তাওয়ানাতু মুহাররস । একে উসতয়ানাতু আলী ইবনে আবী তালিবও বলা হয়। কেননা তিনি প্রায় এস্থানে নামায আদায় করতেন এবং এখানে বসে রাত্রিতে হযরত (সাঃ) কে পাহাড়া দিতেন। এ স্থানটি ঐ দরজার সম্মুখ ভাগেই ছিল, যে দরজা দিয়ে মহানবী (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) এর হুজরা থেকে মসজিদে গমনা গমন করতেন। ৬ষ্ট স্তম্ভ হলো উস্তওয়ানতুন উফুদ । এটা উস্তওয়ানতুল মুহাররসের পশ্চাতে অবস্থিত। ইসলাম গ্রহণের জন্য যখন বিভিন্ন এলাকার লোকজন এবং বিভিন্ন গোত্রের ও রাষ্ট্রদূত মদীনায় আসতেন, তিনি এখানে উপস্থিত হয়েই তাদেরকে দর্শন লাভের সুযোগ প্রদান করতেন। আর সাহাবা কেরাম তাঁর আশে পাশে বসতেন। সপ্তম স্তম্ভের নাম মুরব্বআতুল বঈর। এর অপর নাম মকামে জিররাই। কেননা হযরত জিবরাইল (আঃ) অধিকাংশ সময়ে এখানে ওহী নিয়ে অবতরন করতেন। তিনি হযরত দেহইয়ায়ে বলবী (রাঃ) এর রূপ ধারন করে অহী নিয়ে আসতেন, তখন তাঁকে এখানেই উপবিষ্ট দেখা যেত। অষ্টম স্তম্ভ এর নাম উস্তওয়ানা তাহজ্জুদ যেখানে মহানবী হযরত (সাঃ) এর তাহাজ্জুদের স্থান নির্দিষ্ট ছিল। এ স্তম্ভটি হযরত মা ফাতেমা যোহরা (রাদিঃ) এর হুজুরা শরীফের পশ্চাতে উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্ণিত আছে যে, রাত্রিতে রাসুল (সাঃ) বিছানা পেতে এখানে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। যখন সাহাবীগণ তাঁর অনুসরন করে তথায় তাহাজ্জুদ পড়তে ভীড় জমাতে লাগলেন মহানবী (সাঃ) উম্মতের উপর এ নামায ফরয হওয়ার আশংকায় (যদি তারা তা সঠিকভাবে আদায় করতে না পারে তার জন্য) তিনি ইরশাদ করলেন, বিছানা গুটিয়ে ভেতরে রেখে দাও। এসব বরকতময় মর্যাদবান ও ফজিলতময় স্তম্ভগুলোর কোন না কোনটির সামনে সাহাবারা একরাম দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন, এবাদত বন্দেগী করতেন।
অতঃপর চতুর্থ দিন মদিনা থেকে আমরা জোহরের পর বাইতুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে মক্কার পথে রওয়ানা দিই। সবাই উমরাহর জন্য হোটেল থেকেই ইহ্রামের পোশাক পরিধান করে নিই। ‘জুলহুজাইফা মিকাত’ থেকে ২ রাকাত এহরামের নামাজ শেষে আমরা নিয়্যত বেঁধে নিব, কাফেলার পক্ষ থেকে আমাদের মোয়াল্লেম এমনই নিদের্শনা দেন। প্রিয় রাসূলের (সাঃ)- এর প্রিয় ভূমি, অসংখ্য সাহাবার (প্রায় ১০ হাজার সাহাবীর) কবরস্থান জান্নাতুল বাকী, আল্লাহর প্রিয় রাসূলের (সাঃ) ও তাঁর অনুগত বান্দাহ্দের পদধূলিতে ধন্য এই মদিনাতুল মুনওয়ারাকে বিদায় জানাতে চোখ ছল ছল করে উঠ্ছিল। হৃদয়ে বেদনা অনুভব করছিলাম। তবে বার বার আবারো আসবার দৃঢ় প্রত্যয় ও পরম সৃষ্টিকর্তার নিকট ফরিয়াদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। আমরা যেতে যেতে পথে কোন ঐতিহাসিক স্থান বা নির্দশন দেখলেই প্রফেসর ড. গিয়াস ভাই আমাদের অবগত করছিলেন। এছাড়া মাইক্রোফোনে তিনি উমরাহর নিয়ম কানুন এবং কি করতে হবে ও কি করা যাবে না সে সকল বিষয়ে বিষদভাবে বর্ণনা করছিলেন। অতঃপর মিকাতে পৌঁছে সবাই নিয়্যত বেঁধে দুই রাকাত নামাজ আদায় করি। পথে আমরা একটি রেস্টুরেন্টে বিরতি নিই। ভালো ভালো রেষ্টুরেন্ট গুলো প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। রেষ্টুরেন্টে গরম গরম চায়ের সাথে বিশাল বিশাল নান এবং নলার ঝোল অসাধারণ লেগেছিল। আমরা তৃপ্তি সহকারে সান্ধ্য ভোজ সম্পন্ন করে আবার যাত্রা শুরু করি। পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাসূলের (সাঃ) জীবনের অনেক কিছুই দৃষ্টিপটে ভেসে আসছিল। এই দুর্গম মরু প্রান্তরে হয়তোবা এখানে কোথাও সেদিন প্রিয় নবী মক্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রভুর নির্দেশে প্রিয় বন্ধু ও শ্বশুর আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে নিয়ে যাচ্ছিলেন অথবা কোথাও বিশ্রাম নিয়েছিলেন । হয়তোবা যুদ্ধ বাহিনী নিয়ে শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করতে কখনো কোন সময় এখানের কোন পথ দিয়ে গিয়েছিলেন। এসব ভাবনা কল্পনার আকাশে ভাসছিল। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত মরুবুকে চড়ে বেড়ানো উট, কখনো দূম্বা, আবার কখনো ভেড়ার পাল দেখেছি। অবশেষে মক্কার বায়তুল্লার কাছাকাছি চলে আসলাম। ‘ক্লক টাওয়ার’ দেখা মাত্র হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলাম। দীর্ঘদিন বা দীর্ঘ সময় মা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর সন্তান যেমন মাকে দেখলে তার মন প্রশান্তি ও স্বস্তি পায়। আমিও সেরকম অনুভূতিতে শিহরিত হলাম। সবাই ‘লাব্বাইক’, ‘আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পড়ছে আর গাড়ি বাইতুল্লার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ‘ক্লক টাওয়ার’ এর ‘পুলমন জমজম’ হোটেল এ আমাদের বুকিং ছিল। কাফেলার মোয়াল্লেম অবশেষে হোটেলের সকল রীতি রেওয়াজ সমাধা করে আমাদের রুমের কার্ড ধরিয়ে দিলেন। আর সকলকে লাগেজ রেখে হোটেল লবিতে মিলিত হবার জন্য সময় বেঁধে দিলেন। যেন আমরা একসাথে ওমরাহ্ করতে পারি। তখন মাথায় শুধু ওমরাহ্ কিভাবে করবো সেটাই ঘুরছিল। চারপাশে তাকাবার সময় বা ইচ্ছা ছিল না।
অতঃপর প্রফেসর গিয়াস ভাই এবং তাঁর সঙ্গীরা সহ আমরা মসজিদে যাওয়ার পূর্বে সবাইকে খেজুর বিবরণ করা হয় । কাফেলার প্রায় ৫৫ জন একত্রে উমরাহ্র উদ্দেশ্যে বাইতুল্লা মসজিদে ঢুকে পড়ি। সবাই হাতের বার কোড সম্বলিত বেল্ট দেখালে এবং ওমরার জন্য পূর্ব থেকে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে এনড্রয়েড মোবাইল এ্যাপস্ দেখালে আমাদের ঢুকবার অনুমতি দেয়। কাবা ঘর দৃষ্টি গোচর হবার সাথে সাথে শোকরানা জানিয়ে পরম করুনাময়ের অশেষ কৃপার জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম । অতঃপর আমাদের মোয়াল্লেমকে অনুসরন করে আমরা উমরাহ্ কার্যাদি (আলহামদুলিল্লাহ!) অনেকটা নির্বিঘ্নে ও স্বস্তির সাথে সম্পন্ন করি। পুরুষরা চুল কামাই করতে চলে যান। আর আমরা মহিলারা হোটেলে যার যার রুমে চলে যাই। অপেক্ষা করি চুল ছাটার জন্য । আমার হ্যাসব্যান্ড আসলে উনি আমার চুল ছেটে দেওয়ার পর আমি আমার ননদের চুল কেটে দিই । অনেক রাত অতঃপর ফ্রেশ হয়ে কাফেলা থেকে দেয়া ডিনার সেরে কিছুক্ষনের জন্য বিশ্রাম নিই। কিন্তু মন মানছিলো না রুমে থাকতে। তাই অল্প কিছুক্ষণ পর আমরা বাইতুল্লাহ মসজিদের দোতলায় ছুটে চলি তাহাজ্জুদের জন্য। তবে আমাদের সবার মন খারাপ থাকে এই কথা ভেবে যে কাবা ঘরে সংলগ্ন এলাকায় আমরা আর প্রবেশ করতে পারবো না। অর্থাৎ পরবর্তীতে তাওয়াফ করতে চাইলে ২ তলা বা ৩ তলা বা ছাদ থেকে তাওয়াফ করতে হবে। আবার সেখানে চারিদিকে নির্মাণ কাজ চলার কারণে ঘেরা দেওয়ায় অনেক সময় ভালোভাবে কাবা ঘর দেখা যায় না। এভাবে মক্কায় হোটেল থেকে মসজিদে আর মসজিদ থেকে হোটেলে প্রথম দিন অতিবাহিত হয়। এখানেও অনেকটা মদিনার মতো অবস্থা। মার্কেটে অনেক দোকানপাট বন্ধ। পূর্বের মতো ধাক্কাধাক্কি করার মতো ভীড় না থাকলেও নামাজের সময় হালকা পাতলা ভীড় পরিলক্ষিত হয়। এবার বেশিরভাগ উমরাহ হাজী তুরস্ক, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান সহ রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে এসেছে। খুব সামান্য বাঙ্গালী, পাকিস্তানী পরিলক্ষিত হয়। আবার সেখানে স্থানীয় আরবরাও তাদের বাচ্চা সহ পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। কাবাঘর সামনাসামনি আর দেখতে পাবো না এ কথা ভেবে মন খারাপ থাকলেও পরম দয়ালুর কাছে এর একটা বিহীত করার জন্য দোয়া করছিলাম। আর মাত্র ২ দিন থাকবো। অতএব বার বার তাওয়াফ যেন করতে পারি তার জন্য মহান প্রভুর নিকট আরজি করছিলাম। উল্লেখ্য আমাদের মক্কায় একটি জু’মা পাবার সৌভাগ্য হয়। জু’মা শুরুর ঘন্টাখানেক আগে থেকে আমরা মসজিদে অবস্থান করছিলাম। এক ফাঁকে একজন মাঝবয়সী মহিলা হঠাৎ আমাদের মাঝখানে একটি চেয়ার নিয়ে বসে প্রায় ৩০-৪০ মিনিট আরবীতে কুরআন হাদীস বয়ান করছিলেন। কারণ তিনি যখন আরবীতে ‘ক্বালা’ শব্দটি বলে বিভিন্ন সাহাবা ও রাসুল (সাঃ) নাম নিচ্ছিলেন তখন বুঝলাম তিনি হাদীস বলছেন। আরবী ভাষা না জানার কারণে তার মূল্যবান কথাগুলোর কিছুই জানতে পারলাম না। আবার জুমার খুৎবা শুরু হবার ১৫-২০ মিনিট পূর্বে সেখানে নিয়োজিত আরবী মহিলা কর্মীদের একজন আমার স্মার্ট ফোন আছে কিনা এবং আমি ইংরেজী ভাষা জানি কিনা তা জানতে চান। আমি সম্মতি দিলে তিনি আমাকে মোবাইলে একটি ছোট কাগজে লেখা একটি এ্যাপস্ ডাউনলোড করে নিতে বলেন। আমার স্মার্ট ফোন না থাকায় আমি বোন মিসেস হারুনকে দেখিয়ে দিলে তিনি তা ডাউনলোড করেন। তিনি সাথে একটি ইয়ার ফোনও দেন। খুৎবা শুরু হলে সেটি চালু করতে বলেন এবং অপশনে ইংরেজী ভাষা দিলে ইংরেজীতে খুৎবার সাবটাইটেল দেখা যাবে জানান। আসলে খুৎবা আরবীতে হওয়ায় আমরা কিছুই বুঝতে পারি না, খুবই বেদনাদায়ক। তাই সৌদি সরকারের এই নতুন ব্যবস্থা খুব যুগোপযোগী মনে হয়েছে। কারণ এখানে বিভিন্ন ভাষা-ভাষীর মুসলমানরা সমবেত হন। খুৎবা মূল্যবান কথাগুলো শুনবার জন্য আমাদেরও প্রাণ ব্যাকুল হয়। তবে আমাদের কাফেলার প্রধান কর্ণধার ড. গিয়াস ভাই রিয়াদ ইউনিভার্সিটির ছাত্র হওয়ায় তিনি আধুনিক আরবী ভাষায় পারদর্শী। তিনি পরদিন পবিত্র তায়েফ সফরের সময় খুৎবা বাংলায় বুঝিয়ে বলবেন জানান। তাই খুৎবা না বুঝলেও মন খারাপ না করে তাঁর জন্য দোয়া করলাম এবং পরদিন খুৎবা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। পরের দিন আমরা মহানবী (সঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত তায়েফ সফরে যাই। পূর্বে আরো তিনবার আমার তায়েফ যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। প্রফেসর ড. গিয়াস ভাই থেকে জানতে পারি সৌদি আরবের চারটি রাজধানীর একটি হচ্ছে তায়েফ। এটি কৃষি এলাকার অন্যতম । এখানে আঙ্গুর, আনার, তীন, মধু ও গোলাপ চাষ হয় । এখানে ঐতিহ্যবাহী আতর’ তৈরী হয় এবং স্থানীয়ভাবে এ স্থানকে ‘গোলাপের শহর’ বলা হয় । এ শহরে ছয়টি মিকাতের একটি অবস্থিত । উল্লেখ্য তায়েফের পর্বতগুলো বেবুনদের (এক জাতীয় বানর) জন্য অভয়ারণ্য । এই যত্রতত্র পাথুরে পর্বতে তাদের আনাগোনা দেখা যায় ।
এটি ভূপৃষ্ট থেকে অনেক উচুঁতে অবস্থিত হওয়ায় এখানে আবহাওয়া অনেক স্বস্তিদায়ক। তাই এটি তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে যখন জনজীবন অসহনীয় হয়ে উঠে তখন স্থানীয় আরবরা এখানে আসেন। এখানে তাদের অনেকরই প্রাসাদতুল্য বিশাল বিশাল বাড়ি আছে। তারা গ্রীষ্মে অবকাশ কাটাতে এখানে আসে। খুবই সাজানো গোছানো শান্ত তায়েফ শহর । জনসংখ্যা খুবই অপ্রতুল। মাঝে মধ্যে ট্যুরিস্টদেরই দেখা যায়। যাত্রা পথে প্রফেসর ড. গিয়াস ভাই ঐতিহাসিক মসজিদ ও স্থানগুলো সম্পর্কে বলছিলেন এবং জুমার খুৎবার সার কথাগুলো বুঝিয়ে বলেন। সেখানের স্থানীয় একটি মসজিদে আমরা জোহরের সালাত আদায় করি। অতঃপর আমাদের কাফেলার একভাই আল বাইকের দাওয়াত দেন। তিনি আমার স্বামীর ঘনিষ্ঠ ও স্নেহধন্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট তরুণ ব্যবসায়ী নিজামউদ্দিন সোহেল ভাই যিনি ক্রেইভ রেস্টুরেন্ট এবং কক্সবাজারের সাদাফ হোটেলের কর্ণধার। তার আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হই। তিনি তার অসুস্থ মায়ের আরোগ্য কামনা করে সকলে কাছে দোয়া চান এবং তার রেস্টুরেন্টে ও বিপদে পড়লে কক্সবাজারে হোটেলে সবাইকে সহায়তার আশ্বাস দেন। লাঞ্চে খাবারের জন্য একটি বিশাল পার্কে আমরা যাত্রা বিরতি করি। বাচ্চারা কি সুন্দর খেলা করছে আর মায়েরা একসাথে চাদর বিছিয়ে খাবার দাবার সহ গাছের নীচে গল্প করছে। খাবার চলে আসলে আমরা গাড়ীতে বসে লাঞ্চ সারবার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ বাইরে হালকা বৃষ্টির সাথে ঠান্ডা বাতাস আমাদের কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল। অতঃপর আবার মক্কার পথে যাত্রা। এরই মধ্যে আমরা জানতে পারি মহিলাদের হাতের বেল্ট দেখলে তাদেরকে তাওয়াকের জন্য প্রবেশ করতে দেয়া হয়। তাই তায়েফ থেকে পৌঁছেই মাগরিবের পর বাইতুল্লা তাওয়াফের সিদ্ধান্ত নিই। এভাবে যখন উপায় জেনে গেলাম তখন আমাদের মহিলাদের আর কে আটকায়। আমরা সালাত, তাওয়াফ সবই বেশির ভাগ সময় কাবা প্রাঙ্গনে করতাম। প্রতিবার তায়েফ থেকে যাওয়ার সময় মিকাতে উমরাহ্র নিয়ত/ এহরাম করি । এবার পূর্বানুমতি না থাকায় পারলাম না । পরদিন ছিল জিয়ারাহ্, আমার ও এড হারুন ভাইয়ের পরিবার গেলাম না । কারণ ইতিপূর্বে আমরা অনেকবার গিয়েছি । তাই হেরেম এলাকায় রয়ে গেলাম । জেয়ারায় হজ্বের সময় যে সব কার্যাবলী পালন ও অবস্থানের জায়গা সমূহ ঘুরে ঘুরে দেখানো হয় । যেমন শয়তানদের পাথর মারার স্থান, আরাফা, মিনা, মোজদালেফার অবস্থানের স্থান, মসজিদের নিমারা, জবলে রহমত, জবলে সাওয়ার, জবলে নূর প্রভৃতি দেখানো হয় ।
এবারের মতো আল্লাহর ঘর তাওয়াফে এত প্রশান্তি আর পাইনি। কারণ শৃঙ্খলা থাকবার কারণে কোথাও ভীড় এবং ধাক্কাধাক্কি ছিল না। খুবই নির্বিঘ্নে এবং অল্প সময়ে আমরা তাওয়াফ করতে পারতাম। কিন্তু পুরুষদের সে সুযোগ ছিল না কারণ শুধু এহরাম বাধা অবস্থায় তারা প্রবেশ করতে পারতো। অতঃপর তাদের তাওয়াফের ইচ্ছে হলে দোতলা বা ছাদে উঠে প্রচুর সময় নিয়ে তাওয়াফ করতে হতো। কড়া নিয়ম শৃঙ্খলার কারণে এবার মক্কায় কোথাও হারিয়ে যাবার বা পথ হারাবার সুযোগ ছিল না। কারণ সকলকে এক পথে প্রবেশ করে আবার একই পথে বের হতে হচ্ছিল। আসলে এ-এক বিশ্বের সকল মুসলমাদের মহা মিলন মেলা। রুকু সিজদার তরিকা এক থাকলেও বিভিন্ন পদ্ধতিতে আল্লাহর এই বান্দাগুলো তাঁর ইবাদত করছিল। এখানে ওহাবী, শিয়া, সুন্নী, সালাফী, মাজহাবী, লা-মাজহাবী, সাদা কালো বর্ণ, গোত্র প্রভৃতির কোন ভেদাভেদ নাই। আমরা সবাই এক আল্লাহর গোলাম। সবাই মুসলামন ভাই-ভাই। এই অনুভূতিই আমাদেরকে এখানে যেন এক করেছিল। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের জন্য সহানুভূতিশীল। তাই অচেনা ভাই-বোনেরা অনেক সময় খেজুর বা তসবিহ্ বিতরণ করেন। এক মুরুব্বী কোরআন ও তদ্ সংক্রান্ত ছোট ছোট কুরআন হাদীসের আলোকে লেখা বই বিতরণ করছিলেন। তিনি জেনে নিচ্ছিলেন আমরা কোন ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, আরবী বিভিন্ন ভাষায় কোরআনের তরজমার বই আছে। দেশে অনেক বাংলা তরজমা থাকায় এক কপি ইংরেজী তরজমার কোরআন নিই। এছাড়া মক্কায় আমার স্বামীর ছাত্র জীবনের বন্ধু মক্কা টাওয়ারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইদ্রিস রাজু আমাদেরকে দেখতে অনেক উপহার সামগ্রী নিয়ে ছুটে আসেন। তিনি আমাদেরকে একবেলা খাওয়াবার জন্য এবং জেদ্দায় ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু অতি সংক্ষিপ্ত সফরে আমরা বায়তুল্লাহ্র নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হারাতে চাই না বলে ভবিষ্যতে তার দাওয়াত কবুলের আশা ব্যক্ত করি। অন্য যতবার এসেছি কাবা ঘরের দেয়াল, মাকামে ইব্রাহীম কিংবা হাজরে আসওয়াদ ধরবার জন্যও চুমু খাবার জন্য কিংবা হাতিমে নামাজ পড়বার জন্য তাওয়াফকারীদের অসংলগ্ন আচরণ, উন্মদনা আমাকে খুবই ব্যথিত করতো। আল্লাহর ঘরের সামনে এরূপ আচরণ আমার অন্তরে ভয় ধরিয়ে দিতো। আমি এই ভেবে ভয় পেতাম যে আল্লাহর অপছন্দনীয় আচরণ সহকারে আমরা তাওয়াফ করছি । ফলে আল্লাহ্ না শেষে আমাদের উপর রাগান্বিত হন । আর তার রাগতো আমাদের ধ্বংস করে দিবে । আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন । এটি কি নবীর শিক্ষা ও দীক্ষা আমরা বায়তুল্লাহর সামনে দেখাচ্ছি? অথচ ধৈর্য্য, সহনশীলতা, অন্যকে সহযোগিতা করার মত এমন মানবীয় গুণগুলোই তো সকল মুসলামানদের হওয়া উচিত ছিল। এ যেন, তৎকালীন জাহেলী যুগের জাহেলী আচরণের শামিল। অন্ততঃ আল্লাহকে ভয় করে বাইতুল্লাহকে সম্মান দেখিয়ে আমাদেরকে নিজেদের সংযত করা উচিত। তাই করোনা মহামারী আমার পরম প্রভূর পক্ষ হতে আর্শীবাদই মনে হচ্ছিল। কারণ মক্কা ও মদিনায় এইবার যে শৃঙ্খলা ও শুদ্ধতা দেখেছি তা পূর্বে দেখেনি। এ নিয়ম শৃঙ্খলা যেন সবসময় বজায় থাকে এর জন্য দোয়াও করেছি । অতঃপর বায়তুল্লাকে বিদায় জানাবার সে দিনটি চলে আসে। বিদায়ের সন্ধিক্ষণে অন্তরে আবার ফিরে আসার বীণা বেজে উঠে। অতএব বিদায়ী তাওয়াফ শেষ করে যতক্ষণ দৃষ্টিগোচর হয় ততক্ষণ কাবা দেখছিলাম। চোখে দেদীপ্যমান হয়ে আছে । খানায়ে কাবা, মাকামে ইব্রাহিম, হজরে আসওয়াদ, হাতিম, মিজাবে রহমত, সাফা মারওয়া প্রভৃতি কাবা কেন্দ্রিক দৃশ্য । হৃদয়ে কাবা আর নয়নে মদীনা নিয়ে ভবিষ্যতে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বার বার আসবার জন্য আল্লাহ তায়ালা যেন সুযোগ করে দেন এবং তাওফিক দান করে তার জন্য দোয়া করছিলাম। পরম করুনাময় আমাদের সকলের মনের নেক আশা পূরণ করুন। আমিন।
লেখকঃ নারী উন্নয়নকর্মী, কলামিষ্ট ও প্রিন্সিপ্যাল সিভিএনএস ।

আরও পড়ুন

মাদারীপুর বাবু চৌধুরী ক্লিনিকের ওয়াশরুমে নবজাতক মেয়ে শিশুর জন্ম দিয়ে পালিয়ে গেলেন অজ্ঞাত মা

হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়াকে দেখার পর কি বললেন জামায়াত আমীর?

বেগম খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় কাপাসিয়া প্রেসক্লাবে বিশেষ দোয়া মাহফিল

কাপাসিয়ায় গাছ কেটে অবৈধভাবে কয়লা তৈরি করার দু’টি চুল্লী ধ্বংস করেছে উপজেলা প্রশাসন

রাউজানের ডাবুয়ায় খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্যে খতমে কুরআন ও দো’য়া মাহ’ফিল

বাঁচতে চায় ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত কুবি শিক্ষার্থী অনন্যা

২০২৪-২৫ সেশনের ক্লাস শুরু এবং ৫ দফা দাবি ইডেন শিক্ষার্থীদের

কুবি’র বিজয়-২৪ হলে কালচারাল এন্ড স্পোর্টস উইকের উদ্বোধন

চকরিয়ায় স্বামীর নির্যাতন ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ

দোয়ারাবাজারে পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি

বেগম জিয়া দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সরকারের প্রজ্ঞাপন

বেগম জিয়া দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সরকারের প্রজ্ঞাপন

১১ পেজ ও আইডির বিরুদ্ধে ডিবি কার্যালয়ে মামলা করলেন সাদিক কায়েম