ঢাকাসোমবার , ২১ এপ্রিল ২০২৫
  1. সর্বশেষ

১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণঃ
আমার আম্মা : আমার জীবনের এক অবিনশ্বর আলোকবর্তিকা

প্রতিবেদক
নিউজ এডিটর
৮ আগস্ট ২০২১, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ণ

Link Copied!

(জন্ম ১০ই এপ্রিল ১৯৪৪ সাল – মৃত্যু ২০০৫ সালের ৯ই
আগষ্ট)

জিয়া হাবীব আহ্‌সান, এডভোকেট

আমি এক মহিয়সী নারীর কথা লিখছি, যার গর্ভে ধারন
হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যিনি ছিলেন আমার শিরা- উপশিরায় প্রবাহিত রক্ত কনিকা, আমার সমগ্র জীবনের এক অবিনশ্বর আলোকবর্তিকা। দয়া, অনুকম্পা, সৌহার্য্য, সৌজন্য, বিনয়, সদাচার ও পরোপকারীতা ছিল যঁার জীবনের মূল
বৈশিষ্ট। আমার জীবনে সকল ভালো কাজের অমীয় প্রেরনা শক্তি ছিল আমার মা।
প্রতিদিন যঁাকে পাই আমার কর্মে প্রেরণার উৎস হিসেবে। তঁার প্রতিটি উপদেশ,হিম্মত বানী আমাকে হতাশার ওজড়াজীর্নতাকে উপড়ে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল যোগায়। ভাতৃত্ববোধ, আত্মীয়তার বন্ধন, সামাজিক দায় দায়িত্ব, হালাল রুজির অবিরাম সংগ্রাম এসব কিছুই তঁার জীবন উপদেশ বানীর কিছু
অংশ। ৯ই আগষ্ট সে মহিয়সী নারী আমার মা জননী আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগমের মৃত্যুবার্ষিকী। একজন আদর্শ মা, সমাজকর্মী ও পরোপকারী নারী হিসাবে স্থানীয়ভাবে তঁার অত্যন্ত সুখ্যাতি রয়েছে। রাউজান সুলতানপুর গ্রামের
বরেণ্য শিক্ষাবীদ মরহুম এডভোকেট এজাহার হোসেন বি.এল এর তিনি বড় মেয়ে এবং বিশিষ্ট আইনজীবী হাটহাজারী গুমানমর্দন গ্রামের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক ও জাতীয় সমবায় ব্যক্তিত্ব এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যার সহধর্মীনি। একজন আদর্শ মা ও নারীর সুযোগ্য সন্তান
হিসেবে আমি তঁার কিছু মানবিক গুনাবলী আজ পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৬১ সালের ৯ই এপ্রিল আব্বার সাথে তঁার বিয়ে হয়। দীর্ঘ সংসার জীবনের বহু চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে ২০০৫ সালের এদিনে ভোরবেলা ফজরের নামাজের ওজু বানানোর প্রস্তুতি নিতে বাথরুমেই হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি
আকস্মিকভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জামালখান সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে নেয়া হলে প্রিয় চিকিৎসক (কার্ডিওলজিষ্ট) ডাঃ আলহাজ্ব নুরুল আমিন চৌধুরী তঁাকে মৃত ঘোষনা করেন (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন)।
এভাবে হঠাৎ মা জননীকে হারাবো কখনো ভাবতে পারিনি। একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবেচেয়ে বিশ্বস্থ, আস্থাশীল, নির্ভেজাল, খঁাটি প্রেমের আধঁার, স্রষ্টার অন্যতম শ্রেষ্ট রহমত তার “মা”। যাকে হারিয়ে আমি যেন পায়ের নীচের থেকে
মাটি হারালাম। নিজেকে এতো অসহায় আর কখনো মনে হয়নি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিন গুলোতে মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসার স্মৃতি আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। বাবার বকুনি ও কড়া শাসন থেকে বঁাচাতে সবসময় ঢাল পেতে দিতেন মা। দৃঢ়তার সাথে বলতেন “আমার ছেলে কোন খারাপ কাজের সাথে জড়িত নয়”। স্কুল জীবনে দেয়ালিকা প্রকাশ, স্কাউটিং, খেলাধুলা, বক্তৃতা, বিতর্ক লেখালেখিতে খুবই ব্যস্থ থাকতাম। মা আমার সকল ভালো
কাজের সমর্থক ছিলেন। মানবাধিকার কর্মকান্ডে আমাকে সবচেয়ে বেশী মানসিক ও আর্থিক সহায়তা যোগাতেন আমার মা। চেহারা দেখলেই বুঝতে পারতেন সন্তানের মনে কোন দুঃখ আছে কিনা। পকেটে টাকা আছে কিনা, মানি ব্যাগ চেক করে দেখতেন, টাকা দিতেন। নিজের শাড়ীর আঁচল ভিজিয়ে কপাল আর গঁায়ের গাম মুছে দিতেন। নিজের হাতে ভাত তরকারী খাওয়াতেন । মায়ের সাথে বসে কোনদিন কথা বলতে না পারলে আমি যেমন ঘুমাতে পারতাম না, আমার মাও ঘুমাতে পারতেন না। বিয়ের পর আমার প্রতি মায়ের ভালোবাসার বিরাট অংশ যেন পর্যায়ক্রমে আমার স্ত্রী আর সন্তানদের দিকে চলে গেল। ঘরে ফিরতে দেরী হলে বলতেন,
“মা হয়ে তোকে সহ্য করছি, বউ কিভাবে সহ্য করবে জানি না। বউমা ভালো মেয়ে বলে সহ্য করছে।” আমার অনুপস্থিতিতে আমার স্ত্রীকে সান্তনা দিতেন, সঙ্গ দিতেন। এদেশের প্রতিটি মা যদি এভাবে নিজ নিজ সন্তানকে শাসন করতেন, সহযোগিতা দিতেন, দেশে কোন নারী নির্যাতন, বৈষম্য, পারিবারিক সহিংসতা ও অশান্তি থাকতো না। বউমার কাছে জীবনের সুখ দুঃখের কথা বলে জীবন সংগ্রামে সাহস যোগাতেন। সকলের কাছে বউমা ও সন্তানদের, নাতি-নাতনির
প্রশংসা এবং গল্প করাই তঁার স্বভাব ছিল। তিনি পরনিন্দা পছন্দ করতেন না। মানুষের পজেটিভ দিক আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। আত্মীয়-স্বজনের খেঁাজ খবর নেয়া ও
হক আদায় করা পছন্দ করতেন। স্বামী সংসারের জন্য তঁার অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগ অতুলনীয়। আব্বা একজন ব্যস্ত আইনজীবী জনপ্রতিনিধি ও সমবায়ী ছিলেন বিধায় তঁার পরিবারের পুরো দায়িত্ব তিনি পালন করতেন এবং সংসার এর জন্য বাবাকে কোন চিন্তা করতে হতো না। স্বামীর খাবার দাবার, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই তিনি দেখাশুনা করতেন। সন্তানের কোন বিপদ হলে মায়ের মনে আগে থেকেই জানা হয়ে যেত। এমন আলৌকিকত্ব দেখিনি । ইন্তেকালের ২/৩ দিন আগে
আমাকে হঠাৎ বলেন, “আমার নাতনি রাইসা দাদীর মতো হবে, তোকে আমার মত ভালোবাসবে, খবর নিবে, তুই কোন চিন্তা করিস না।” এটা তঁার পরকালে পাড়ি দেওয়ার এটা যেন আগাম বার্তা ছিল তা তখন বুঝতে পারিনি। আমার মা আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগম ৬১ বছর বয়সে মারা যান। স্বামীর দেয়া উপহার দেওয়ান বাজার মাছুয়া ঝর্ণা লেইনস্থ নিজ বাড়ীতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান ও চোখের মনি ছিলাম। তবে সন্তানদের তিনি বৈষম্য করতেন না। ৬ মেয়ে ও ১পুত্র সন্তানকে মানুষ করতে তিনি নিজের জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আরাম আহ্লাদ্ সুখ শান্তি বিসর্জন দেন। স্বামীর প্রতি ছিল তঁার অসাধারণ
ভক্তি ও ভালোবাসা। যেন তঁাকে চোখের আড়াল হতে দিবেন না। বাবাও তাই। স্বামী- স্ত্রীর এমন মিল মহব্বত খুব কমই দেখা যায়। মান- অভিমান হলে তা আবার ঝড়ের বেগে স্বাভাবিক হয়ে যেতো। বাবাও আমার মায়ের উপর খুবই নির্ভরশীল ছিলেন। তঁার মৃত্যুতে আমার বাবা অসহায়, হতবিহ্বল, অবুঝ এতিম শিশুর মতো হয়ে যান।
স্ত্রীর কবর এর পাশে নিয়মিত তেলাওয়াত ও জেয়ারতের মাধ্যমে ২১টি মাস কাটিয়ে দেন। কখন হযরত মোল্লা মিসকিন শাহ্ (রহঃ) মসজিদ সংলঘ্ন কবর গাহে স্ত্রীর পাশে শায়িত হবেন এটাই ছিল তার শেষ স্বপ্ন সাধ। একজন ব্যস্ততম ও বিশেষজ্ঞ আইনজীবী হওয়া স্বত্বেও স্ত্রীর মৃত্যুর পর পেশা ও অর্থের প্রতি তঁার আর কোন মোহ দেখলাম না। নাতি-নাতনি, ছেলে- মেয়ে, জামাতা, পুত্রবধু সকলেই তঁাকে সময় দিয়ে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলেও তিনি এক মুহুর্তের জন্যও প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভুলতে পারেননি। একজন নারীর জীবনে এর চেয়ে আর বড় সাফল্য, কতিত্ব, বিজয় ও পাওয়া কি হতে পারে? মা তঁার সন্তানদের মানুষ করতে একজন নিউক্লিয়াসের ভূমিকা পালন করেন। প্রতিদিন ভোরে তিনি সকলের আগে ঘুম থেকে উঠতেন, রাতে সবার শেষে ঘুমাতে যেতেন। তঁার ত্যাগের বিনিময়ে সন্তানদের মধ্যে প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। তঁার দু’মেয়ে চিকিৎসক, এক মেয়ে ও একমাত্র পুত্র সন্তান আইনজীবী, একজন এম.বি.এ পাশ এবং অন্য দুইজন ও উচ্চ শিক্ষিত গৃহিনী। আমরা ঘরে আসলে মা সব সময় ‘পজেটিভ’ সংবাদ গুলো শুনাতেন, ‘নেগেটিভ’ কোন কথা শুনাতেন না। এমনকি এব্যাপারে অন্যদেরও বারন করতেন। যেকোন মানসিক অশান্তিও টেনশন প্রশমনে তিনি যাদুর ভূমিকা রাখতে পারতেন। মনে সাহস ও কর্মের প্রেরনা যোগাতে তিনি অমিয় শক্তি হিসাবে কাজ করতেন। আমার মা জননী অত্যন্তসাধারণ, ধর্মপ্রাণ ও মানবতাবাদী নারী ছিলেন। দুঃস্থ নারী ও গরীব আত্মীয়-স্বজনকে গোপনে অকাতরে দান করতেন। তিনি স্বামী থেকে তঁার পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রচুর অর্থ খুঁজে নিতেন এবং তা তঁার মনের সুখে গরীবদের বিলিয়ে দিতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাবা থেকে তিনি এক লক্ষ টাকা চেয়ে বসলেন। বললেন এটা আমি কোথায় খরচ করবো প্রশ্ন করা যাবে না। বাবাও আর জিজ্ঞেস করেননি। মৃত্যুর পর জানতে পারলাম তিনি এ টাকা দিয়ে এক দুঃস্থ ও অসহায় নারীকে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি (মা) নাতি নাতনি শিশুদের সাথে শিশু হয়ে যেতেন। মিশে যেতেন তাদের সাথে, ছড়া, রূপকথা, গল্প, কবিতা, গানে যেন একাকার। মাঝে মাঝে সব নাতি-নাতনীদের নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করতেন। শিশুরা খুব মজা পেত তঁার সাথে। কাজের ছেলে মেয়েদের সাথে তাদের দুঃখ বেদনা নিয়ে কথা বলতেন। মনযোগ দিতেন তাদের কথায়, এতে তাদের মন হালকা হতো।

তিনি কাজের লোকদের কাজে নিজে সহযোগীতা দিতেন। যাতে তাদের উপর প্রেসার না হয়। নিজে বিশ্রাম না নিয়ে তাদের বিশ্রাম দিতেন। মাকে আমি ডোমেষ্টিক ভায়োল্যান্সের এ সমাজে একজন অসাধারণ মানবিক গুনসম্পন্ন অনুকরনীয় নারী আর্দশ হিসেবে পেয়েছি। তঁার মাঝে প্রতিহিংসা কিংবা কারো প্রতি ক্ষোভ দেখিনি। সকলের কল্যান কামনা করতেন তিনি। তঁার একটি খারাপ স্বভাব ছিল ঔষধ খেতে চাইতেন না। ফলে প্রেসার ও ডাইবেটিকস আন কন্ট্রোল ছিল। নিজের প্রতি যত্ন নেয়ার চেয়ে স্বামী সন্তানদের যত্ন নিতে তিনি বেশী উদগ্রীব থাকতেন। এধরনের নিঃস্বার্থপরতার এমন নজির আর হয় না। আমার পিতা মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব এ.এম য়্যাহ্য়্যা দীর্ঘদিন বৃহত্তর গুমানমর্দনের চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, এদেশের গ্রাম উন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ও সমাজকর্মী হিসেবে স্বামীর সহযোদ্ধা ছিলেন মা। তিনি স্বামী- সন্তানদের পেছনে মাকড়সার মতো জীবন উৎসর্গ করেন। তিনি তদানিন্তন সময়ের রাউজান সুলতানপুর গ্রামের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব এডভোকেট মরহুম এজাহার হোসেন বি.এল এর জেষ্ঠ্য কন্যা। রাউজানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও হেড মাস্টার মরহুম আবু মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন (এম.এ) তঁার বড় ভাই। ৬ ভাই, ৫ বোনের মধ্যে তিনি সকলের আদরের ছিলেন।

চন্দনপুরা গুলএজাহার বেগম স্কুল ও রাউজান নন্দীপাড়া স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। প্রাইমারী স্কুলে বৃত্তি লাভ করেন। এস.এস.সি পরীক্ষার পর তঁার বিয়ে হয়ে যায়। তিনি নিয়মিত পত্র পত্রিকা, কোরান, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করতেন এবং শিক্ষনীয় ও গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলো পরিবারের সদস্যদের পড়ে শুনাতেন।মায়ের মৃত্যুর পর আমার পিতা ও পরিবারের সকলে মিলে তঁার স্মৃতি ও মহৎ কর্ম সমুহকে ধরে রাখতে গঠন করি “জায়তুন-য়্যাহ্য়্যা ওয়েল ফেয়ার ট্রাষ্ট”। উক্ত ট্রাস্টে আমার পিতা বিপুল অর্থ দান করেন। ট্রাস্ট সদস্যদের চঁাদা/জাকাত ও অনুদানে গঠিত ফান্ড থেকে নিরবে ছাদকায়ে জারিয়ার কাজ চলছে (আলহামদুলিল্লাহ্) গরীব এতিম মেয়ের বিয়ে, দুস্থদের আইনী সহায়তা, স্বাস্থ্য সেবা, পুস্তক প্রকাশনা, বেকারদের কর্মসংস্থান, শিক্ষাবৃত্তি, নারী শিক্ষা, বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ, বৃক্ষ রোপন প্রভৃতি কাজে প্রতি বছর ট্রাস্ট থেকে বিপুল অর্থ অনুদান দেয়া হয়। প্রিন্সিপ্যাল, চিটাগাং ভিক্টরী ন্যাশনাল স্কুল এবং প্রবন্ধকার ও নারী উন্নয়নকমর্ী আমার স্ত্রী আশ্ফা খানম আহসান (হেলেন) তাঁর শ্বাশুড়ী মা কে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, নারী শিক্ষায় অবদানের জন্য তঁাকে সংশিষ্টরা চিরদিন স্মরনে রাখবেন। চট্টগ্রামের রাউজান থানাধীন সুলতানপুর গ্রামের (কেরাণী বাড়ীর) প্রবীণ শিক্ষাবিদ মরহুম এজাহার হোসেন (বি.এল) এডভোকেটের জেষ্ঠা কন্যা জায়তুন আরা বেগম ছোট বেলা থেকেই মানবদরদী ছিলেন মর্মে জানা যায়। অভিভাবকদের নিকট হতে প্রাপ্ত সকল অর্থ তিনি গোপনে অসহায়, দরিদ্র নারী ও শিক্ষাথর্ীদের জন্য দান করে দিতেন।

তিনি চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আইনজীবী এদেশের গ্রাম উন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মরহুম আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা সাহেবের সহধমর্ীনি এবং মানবাধিকার কর্মী ও কলামিষ্ট এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান এর মা-জননী। তিনি সন্তানদের ধর্মপ্রান, মানবদরদী মানুষ হবার শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রেরনা যোগান। তিনি তঁার একমাত্র পুত্রবধূ আশফা খামনকেও উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহ ও প্রেরনা যোগান। পুত্রবধুর প্রতি এ ধরনের ভালবাসা খুব কম নারীর থাকে। তঁার মেয়েদের মধ্যে ২ কন্যা ডাক্তার, ২ কন্যা গ্র্যাজুয়েট, এক কন্যা আইনজীবী ও অপর কন্যা এম.বি.এ। তঁার একমাত্র পুত্রসন্তান এডভোকেট জিয়া হাবীব আহসানকেও তিনি সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এবং মানুষের সেবায় উৎসাহ ও প্রেরণা যোগান। তিনি নিজেও তদানিন্তন সময়ের এস.এস.সি ও প্রাইমারী বৃত্তি প্রাপ্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী গুল-এ-জার বেগম উচ্চ বিদ্যালয় এবং নিজগ্রাম রাউজানের নন্দীপাড়া স্কুলে তিনি যথাক্রমে অধ্যয়ন করেন। বিশিষ্ট গবেষক জনাব আলহাজ্ব মোঃ দিদারুল আলম তঁার রচিত ‘আমার বংশ শেজরা’ গ্রন্থে এ মহিয়সী নারীর বংশ পরিচিতি সম্পর্কে লিখেন, ‘‘রাউজান সুলতানপুর গ্রামের মুন্সী শরিয়ত উল্লাহর একমাত্র পুত্র এডভোকেট আবু মোহাম্মদ এজাহার হোসেন বি.এল এর প্রথমা কন্যা আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগম। তার মাতার নাম আনোয়ারা বেগম যিনি বিখ্যাত মুকিম বংশের মেয়ে। জায়তুন আরা বেগমের দাদার নাম শরিয়ত উল্লাহ, দাদীর নাম ছুপিয়া খাতুন। ছুপিয়া খাতুন ফটিকছড়ি বক্তপুর গ্রামের আধ্যাত্মিক সু-পুরুষ শাহ পরান ফকিরের বংশধর। তঁার পিতা আবু মোঃ এজাহার হোসেন ‘আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ হতে আইন শাস্ত্রে ১৯৪২ সালে ব্যাচেলর অব ল’ ডিগ্রীর সনদ অর্জনে ভারতের কলকাতা হাওড়া কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
তিনি দীর্ঘদিন হাওড়া গভঃ এস্টেট এর আইন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর তিনি ভারতে সকল সহায় সম্পত্তি অর্থ বিত্ত রেখে স্বপরিবারে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি ৬ নবাব সিরাজদ্দৌল্লাহ রোডে ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং মোমিন রোড়ে ‘দি স্ট্যান্ডার্ড লিটারেচার কোম্পানী’ নামে একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। এই লাইব্রেরীতে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জার্নাল ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ থাকায় তথায় সুধীজনের বেশ আনাগোনা ছিল। তিনি রাউজান মুন্সির ঘাটায় শিক্ষিত বেকার যুবক ও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি কমার্সিয়াল কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তদানিন্তন সময়ে ৮৫০/- টাকা ভাতা গ্রহণে ২টি ইমপোর্ট ফার্মেরও দায়িত্ব পারন করেন যার নাম যথাক্রমে এম/এস গাঙ্গুলি এন্ড কোম্পানী এবং এম/এস ওরিয়েন্টেল ইন্টারন্যাশ্নাল কোম্পানী হাটহাজারীর ফতেয়াবাদে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করে একটি ‘কিষাণ সমিতি’ও গঠন করেন। সমাজ উন্নয়নে তার ব্যাপক অবদান ছিল।’’ মরহুম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, মরহুম ডাক্তার এম.এ হাশেম, মরহুম আরহাম আলী চৌধুরী প্রঃ ঝর্ণা কোম্পানী, মরহুম খায়রুজ্জামান এবং মরহুম নাদেরুজ্জামান চেয়ারম্যান প্রমুখ ব্যক্তিগণ মরহুম এডভোকেট এজাহার হোসেন বি.এল. এর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। মরহুমা জায়তুন আরা বেগমের বড় ভাই আবু মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন এম,এ (ইসলামী ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) একজন স্বনামধন্য শিক্ষাবীদ ছিলেন। তিনি ১৯৬০ থেকে আমৃত্যু ১৯৯১ সন পর্যন্ত ফটিকছড়ি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়, নোয়াজিশপুর অদূদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, ডাবুয়া তারাচরণ শ্যামাচরণ উচ্চ বিদ্যালয়, গড়দুয়ারা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী, আর্যমিত্র হাই স্কুল, রাউজান, ফজলুল কাদের চৌধুরী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। জায়তুন আরা বেগমের মেঝো ভাই মরহুম আবু মনছুর মোঃ হাসান ইমাম (মনছুর) লিবিয়া ত্রিপোলী পাওয়ার ষ্টেশান এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সিলেট সারখানায় কর্মরত প্রকৌশলী ছিলেন।

সেজো ভাই আবু মনজুর মোঃ হায়দার ইমাম বি,কম অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এ,জি,এম (ম্যানেজার) এবং ছোট ভাই আবু মামুন মোঃ আকতার ইমাম পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা ও হাজী আব্দুল আহাদ অব: প্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। তিনি (মরহুমা) অত্যন্ত ধর্মপ্রান ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এবং স্বামীর সাথে তিনি পবিত্র হজ্বব্রত ও ওমরাহ পালন করেন। কোরান তেলোয়াত, ইসলামী সাহিত্য পাঠ, এবাদত বন্দেগীতে তিনি অবসর সময় কাটাতেন। বই পড়ে অন্যদের শুনানো ছিল তঁার অভ্যাস। সারাটা জীবন জায়তুন আরা বেগম তঁার স্বামীর ও পুত্রের সমাজ উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং সহমমর্ীতা প্রদান করেন। তিনি নাতি-নাতনিদের ছড়া বলতেন, গান শুনাতেন এবং গল্প করতেন। তাদের বড় হবার জন্য লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন। তঁার প্রিয় গান ছিল “মধুর আমার মায়ের হাসি, চঁাদের মুখে জ্বলে, মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে”। কাজের মানুষদের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই সদয়। তাদের তিনি সময় দিতেন, মনযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতেন এবং মনের ব্যাথা দূর করার চেষ্টা করতেন। প্রায়ই তাদের কাজ নিজে করে দিয়ে তাদের ছুটি ও আরাম দিতেন। রোগে শোকে তাদের চিকিৎসা করাতেন ও গোপনে অর্থ সাহায্য দিতেন। নাতি-নাতনি ও শিশুদের সাথে তিনি শিশু হয়ে যেতেন এবং তারা তাদের অত্যন্তআপনজন হিসেবে তঁাকে পেতেন। শ্রেণীভেদে তিনি সকলের দুঃখ-বেদনা ও সমস্যা সান্তনা দিয়ে দূর করে দিতেন। একমাত্র পুত্রকে কাজের ব্যস্ততা কমিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সময় দিতে শাসন করতেন।
তঁাকে মমতাময়ী শান্তির আঁধার বললেও অত্যুক্তি হবে না। তঁার মধ্যে কাব্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিভা থাকলেও সংসারের চাপে তা চাপা পড়ে যায়। তঁার হস্তাক্ষর ছিল খুবই সুন্দর। তিনি স্বামীর নিকট থেকে যে অর্থ পেতেন তা নিজের আরাম আয়েশ কিংবা বিলাসিতায় ব্যয় না করে তা দুঃস্থ, অনাথ, দরিদ্র, আত্মীয়-স্বজন ও পল্লীবাসীদের জন্য অকাতরে গোপনে দান করতেন। যা আজো গ্রামে গেলে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন থেকে শুনতে পাই। বিশেষ করে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী নারীদের জন্য তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস। তিনি দ্বীণ প্রতিষ্ঠায় ও নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ধর্ম প্রচারে অকাতরে দান করেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি তঁার স্বামী থেকে একলক্ষ টাকা নিজের জন্য চেয়ে নেন এবং শর্ত দেন যে, কি কাজে তিনি তা ব্যয় করবেন তা জানতে চাওয়া যাবে না। পরে দেখা যায় তিনি গোপনে সব টাকা কতিপয় নিঃস্ব দরিদ্র নারীর চিকিৎসা ও বিবাহ কার্যে ব্যয় করে দিয়েছেন। তঁার মৃত্যুতে প্রবন্ধকার একজন আস্থাশীল অভিভাবক ও শুভাকাঙ্খীকে হারালেন। লেখিকা মরহুমার একমাত্র পুত্রবধু হলেও তিনি তঁাকে নিজ কন্যাতুল্য মনে করতেন। মন খুলে কথা বলতেন ও শুনতেন। তঁার মতো দরদী মনের নারী সমাজে বিরল। তঁার শুন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়। তঁার মৃত্যুর ১৯ মাসের মধ্যে স্ত্রী শোকে কাতর মরহুমার স্বামী আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর আব্বা এডভোকেট এ.এম য়্যাহ্য়্যা গত ৬ই মে ২০০৭ ইং সালে ইন্তেকাল করেন। স্ত্রীর শিয়রের পাশে তঁাকে দাফন করা হয়। এতে বুঝা যায় জায়তুন-য়্যাহ্য়্যা দম্পতির উপর আল্লাহ্র রহমত কতটুকু জোরালো ছিল। আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগম তঁার মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্তস্বামী, সন্তান ও পরিবারের জন্য মা মাকড়সার মতো জীবন উৎসর্গ করেন। নিজের শরীর, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার কথা না ভেবে অসুস্থতার মাঝেও পরিবারের সকলের মুখে হাসি ফুটাতে সার্বক্ষনিক প্রয়াস চালান। পরিবার পরিজন আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে তিনি নিউক্লিয়াস এর মতো ঐক্য, সংহতি ও যোগাযোগ বজায় রাখতেন। পরিবারের ছোট বড় সকলকে হাসিমুখে বিদায় দিতেন ও হাসিমুখে বরন করে নিতেন। বাড়ীর সকলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষায় থাকতেন, টেলিফোনে খবর নিতেন, ঘুমাতে যেতেন না। এভাবে প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ের জন্য তিনি কষ্ট স্বীকার করতেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ Íতিনি সন্তানদের, নাতি-নাতনিদের মানুষ করতে শ্রম দিয়ে যান। আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায়ে ও মেহমানদারীতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তিনি পরনিন্দা ও গর্হিত কাজ একদম পছন্দ করতেন না এবং কেউ পরচর্চা করলে থামিয়ে দিতেন। তিনি সকলের ভালো গুনের প্রশংসা করতেন। এজন্য তঁার সাথে কথা বলেও শান্তিপাওয়া যেত। আল্লাহ্ আমাদের ভালো ভালো কাজের বিনিময়ে আমাদের প্রিয়তমা মা-বাবার পরকালীন সাফল্য বয়ে আনুক। জান্নাত নসীব করুন, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আজকের দিনে এটাই মুনাজাত।

-লেখকঃ আইনজীবী, কলামিষ্ট, সু-শাসন ও মানবাধিকার-কর্মী।

330 Views

আরও পড়ুন

ঝিনাইগাতীতে কূপ খনন করতে গিয়ে নিহত দুইজনের পরিবারের পাশে বিএনপি

ঠাকুরগাঁওয়ে ব্রাইট স্টার মডেল স্কুল এন্ড কলেজের বর্ষবরণ ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধন

জুরীতে ২৫ নারী উদ্যোক্তাদের গবাদি পশু ও তাঁত শিল্প সামগ্রী বিতরণ

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শেরপুরের দুই ছাত্রদল নেতা বহিষ্কার

চট্টগ্রাম পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণার্থীদের স্কাউটসের ওরিয়েন্টেশন কোর্স

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সহায়তায় জবি ছাত্রদলের হেল্প ডেস্ক

আজ বিশ্ব লিভার দিবস: জেনে নিন লিভার সম্পর্কে

নালিতাবাড়ীতে কিশোরীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে যুবক আটক

কাপাসিয়ায় বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় সহায়তা করলেন জামায়াত নেতা আইউবী

মহেশখালী নৌঘাটে সী ট্রাক চালু ও পল্টুন স্হাপনকে স্বাগতম- ড. হামিদুর রহমান আযাদ

গরমে যেসব অসুখ বেশি হতে পারে

জামালপুরে তিন হাজার পাঁচশত পিস ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী আটক