ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকেন তিনি। ছবি আঁকা তার নেশা ও পেশা দুটোই। তার আঁকা ছবি ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে সবার কাছে। এমনকি বিখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণ সহ বিভিন্ন কবি ও লেখকগণ বইয়ের প্রচ্ছদে তার ছবি ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি সহ অসংখ্য মানুষের মুখ অংকন করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। কক্সবাজার জেলার পাহাড়ী দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে বেড়ে উঠা এই তরুন উদয়মান চিত্রশিল্পীর নাম পারিবারিক ভাবে রেজাউল করিম হলেও সর্বত্র আর. করিম নামেই বেশ পরিচিত। দরিদ্র কৃষক পরিবারেই তার জন্ম। বাড়ি মহেশখালী পৌরসভার পুটিবিলা গ্রামে। বাড়ির দেয়ালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি আঁকার সময় তার সাথে প্রতিবেদকের কথা হয়।
প্রশ্ন- কবি নজরুল ইসলামের ছবি আঁকার কারণ কি?
আর.করিম- তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় কবি নজরুল ইসলামের ছবি আঁকার মধ্য দিয়েই এ জগতে প্রবেশ করেছি। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। যার বাস্তবরূপ আমরা তার কবিতা ও গানে দেখতে পাই। সেই ভাললাগা থেকেই মুলতঃ কবি নজরুল ইসলামের ছবি আঁকছি।
প্রশ্ন- এছাড়াও ছোটবেলায় কার ছবি আঁকতেন?
আর.করিম- ছোট বেলায় যখন ছবি আঁকার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলাম তখন খাতায় পেন্সিল দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বিশ্বকবি রবি ঠাকুরের ছবি আঁকতাম।
প্রশ্ন- কোন ধরণের ছবি আঁকতে ভাল লাগে?
আর.করিম- ক্রমাগত ছবি আঁকতে গিয়ে ভাললাগার বিষয়টিও পরিবর্তন হয়। তবে আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবির পাশাপাশি মানুষের মুখ আমাকে বেশ কাছে টানে। তাই এই ধরণের ছবি আঁকি।
প্রশ্ন- আবহমান বাংলার কোন ধরণের ছবি আঁকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
আর. করিম- যে ছবি মানুষের চোখে সুন্দর নয় কিন্তু আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে নান্দনিক বিষয় চোখে পড়ে-সেইসব ছবি আঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কেননা দৃষ্টি শক্তি দিয়ে আমরা সব দেখলেও বুঝার জন্য দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। কারণ সত্য সবসময় সুন্দর হয়, কিন্তু সুন্দর সবসময় সত্য হয়না।
প্রশ্ন- মানুষের মুখ অংকনের বিষয়টি কিভাবে নির্বাচন করেন এবং কার মুখ আপনাকে বেশি টানে?
আর. করিম- মুলত যাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা আছে এবং যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে তাদের ছবি আঁকতেই আমার ভাল লাগে। এক কথায় যার ভিতর আমি আমাকে খুঁজে পাই তার ছবি আঁকার জন্য নিজ থেকেই উৎসাহিত হই। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে শিল্পী মান্না দে এর ছবি আঁকতে। এই পর্যন্ত এই শিল্পীর প্রায় ৫০ এর অধিক ছবি অংকন করেছি।
প্রশ্ন- মানুষের মুখ এবং আবহমান গ্রাম বাংলার কি পরিমাণ ছবি অঁংকন করেছেন?
আর. করিম- অসংখ্য ছবি এঁকেছি। তার সঠিক হিসেব রাখিনি। তবে মানুষের মুখ প্রায় পাঁচশ এবং আবহমান বাংলার তিনশতাধিক ছবি এঁকেছি।
প্রশ্ন- আপনার বাড়ীর দেয়ালে শিল্পী কুদ্দুছ বয়াতি, মনির খাঁন আর প্রয়াত এন্ডু কিশোরের ছবি দেখতে পাচ্ছি। কখন এবং কেন এঁকেছেন জানতে পারি কি?
আর. করিম- তিন জনই আমার প্রিয় শিল্পী। প্রয়াত এন্ডু কিশোরের অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর প্রথম তার ছবি আঁকি। আর দেয়ালের ছবিটি শিল্পীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে অংকন করেছি।
প্রশ্ন- মহেশখালীর কোন কোন বিখ্যাত ব্যক্তির ছবি এঁকেছেন?
আর. করিম- বিখ্যাত লেখক ডঃ সলিমুল্লাহ খাঁন, সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হক, সাবেক এমপি আলমগীর ফরিদ, এমপি আশেক উল্লাহ রফিক, গবেষক সাদাত উল্লাহ খান, কবি খালেদ মাহবুব মোরশেদ সহ অনেকের ছবি অংকন করেছি।
প্রশ্ন- এই পর্যন্ত কয়টি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন?
আর. করিম- এই পর্যন্ত ৫টি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ উদিচী শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্যোগে মহেশখালী উপজেলা মিলনায়তনে এবং ২০১৫ সালে মহেশখালী কলেজে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সহযোগীতায় কক্সবাজার আর্ট ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনী ও মানবতার জন্য শিল্প, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রথম আন্তর্জাতিক জল রং চিত্র প্রদর্শনী এবং ২০১৯ সালে কক্সবাজার আর্ট ক্লাব আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে চিত্র প্রদর্শনীতে আমার অংশগ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন- ছবি আঁকতে গিয়ে আপনার ভাল লাগার বিষয়টি যদি শেয়ার করতেন।
আর. করিম- মেধা, মনন, শৈল্পিক চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যখন একটি ছবি আঁকা সম্পন্ন করি, ঐ ছবি দেখে মানুষ যখন নেতিবাচক মন্তব্য করেন তখন বড্ড কষ্ট হয়। পরের ছবিতে যখন ঐ মন্তব্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আরেকটি ছবির বাস্তব রূপ দিতে পারি তখনই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে।
প্রশ্ন- ছবি আঁকতে গিয়ে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল কী?
আর. করিম- ছবি আঁকতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হয়েছি। তারপরেও ছবি আঁকা বন্ধ করিনি। আমার সমবয়সীরা যখন ভাল চাকরী বা ব্যবসা নিয়ে টাকা ইনকাম করছে সেখানে আমি ছবি আঁকা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তাই দেখে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তারপরেও আমি আমার ছবির মাধ্যমে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সঠিক বার্তাটি প্রেরণের চেষ্টা করছি। আমাদের এই সমাজে সুদ, ঘুষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা দান খয়রাত করলে ভাল মানুষ বলে। আর ধর্মের দোহায় দিয়ে শিল্পীকে নাস্তিক্যবাদ চর্চা করে বলে উপহাস করে। তাই আমি এই সমাজকে দেখাতে চাই ছবি আঁকা শুধু ছবি আঁকা নয়, এটি পুরো জগতের বহিঃপ্রকাশের অন্যতম মাধ্যম।
প্রশ্ন- মহেশখালী নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
আর. করিম- সব শিল্পী সংগঠক নয়। এটি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আমি সংগঠক হয়ে মহেশখালীতে এই শিল্পটি বিকশিত করার সমুন্নত চেষ্টা রেখে এগুচ্ছি। ভবিষ্যতে মহেশখালীর জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আর্ট স্কুল খোলার স্বপ্ন আছে।
শিল্পীর সাথে একান্ত আলাপচারিতায় প্রতিবেদক এস. এম. রুবেল।