——
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা নিয়মিত ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল। গত দেড় দশকে এই বিকৃতি বহুলাংশে দূর করা সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার থাকার কারণে।
হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখন্ড নানা নামে পরিচিত হয়েছিল। বলা হতো, বঙ্গ-পুন্ড্র-সুক্ষ-গঙ্গাহ্রদ্ধি-বজ্রভূমি-বরেন্দ্র-সমতট-তরিকেল-গৌড় বাগড়ী ইত্যাদি নাম ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের। বাঙালির পরিচয় খুঁটিয়ে দেখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে এটা সত্য যে, সে সময়ের পূর্ববঙ্গ আজকের বাংলাদেশ। যে বাঙালি সংকর জাতি হিসেবে অবজ্ঞাত ছিল, তার পরিচয়ে দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, আজ আমি বলতে পারি,আমি বাঙালি। আজ আমি বলতে পারি বাঙালি একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই।
বিশ্বজুড়ে বাংলার যে পরিচিতি, সেই অর্থে এই ভূখন্ডকে শুধু ভৌগোলিক আকারে খর্বীকৃত বলার সু্যোগ নেই। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অপেক্ষায় সময়ের পরিসর অতিক্রম করেছে। তিনিই উপমহাদেশের একমাত্র নেতা, যিনি উপমহাদেশের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এই অর্জনে নিজেদের নিবেদন করেছেন বীরদর্পে। মানুষের ভালোবাসার অবিস্মরণীয় চেতনাবোধে সিক্ত হয়েছে তাঁর নেতৃত্বের দূঢ়তা। বিশ্বের অনেক নেতা যেভাবে ইতিহাসের পৃষ্টায় আছেন অজেয় প্রেরণায়, তেমন বঙ্গবন্ধু আছেন বিশ্বের সাতশত কোটি মানুষের অজস্র অনুপ্রেরণায়।
১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ অর্থাৎ, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
নেলসন ম্যান্ডেলা নামের সাথে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, হো চিন মিনের নামের সঙ্গে ভিয়েতনাম, সুকর্ণের নামের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, মিসরের সঙ্গে কর্ণেল নাসের এমন আরও অনেকে। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম উচ্চারণ না করে বাঙালির আত্মপরিচয় কখনো পূর্ণ হবে না।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয় ইতিহাসের বঙ্গের পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিসত্তার দর্শনের জায়গা থেকে পাকিস্তান গণপরিষদে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ব বাংলা বলার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট তিনি গণপরিষদে বলেন,”স্পিকার মহোদয়, সরকার পূর্ব বাংলার নাম বদল করেছে পূর্ব পাকিস্তান। বাংলা নাম ব্যবহার করার জন্য আমরা দাবি জানাই। বাংলা নামের ইতিহাস আছে ,তার ঐতিহ্য আছে..।”
এভাবে নিজের জাতিসত্তার প্রশ্নে তিনি অনঢ় ছিলেন। কোথাও সামান্যতম আপস করেননি। বাঙালির বিত্তবৈভবকে তিনি লালন করেছেন নিজের আত্মপরিচয়ের সবটুকু জায়গা জুড়ে।
তাঁর মৃত্যু দিবসে শারীরিক মৃত্যুর বিষয়টি সত্য। কিন্তু, ইতিহাসে তিনি মৃত্যুহীন অমর মানুষ। তাঁর জন্ম না হলে বাঙালির হাজার বছরের উপেক্ষার জায়গাটি প্রশমিত হতো না। তাঁর মৃত্যুহীন জন্ম বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট বাঁকবদলের ইতিহাস। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। বিশ্বের সব মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সঙ্গে তিনি বাঙালি জাতিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন। তাঁকে বাংলা সাহিত্যে অনবরত স্মরণ করেছেন দেশের লেখকবৃন্দ। এজন্যই তো শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামানের কাব্যের স্বরে বলেছেন,
“সবুজ শ্যামল বনভূমি মাঠ নদীতীর বালুচর
সবখানে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘর।
সোনার দেশের মাঠে মাঠে ফলে সোনাধান রাশি রাশি ফসলের হাসি দেখে মনে হয় শেখ মুজিবের হাসি।
তিনি বাঙালি জাতির হিরণ্ময় জ্যোতি । ইতিহাসের পাতায় তাঁর অবস্থান বঙ্গ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা। তিনি ছিলেন নজরুলের রক্তাম্বরধরিণী মা কবিতার সেই সৃষ্টির নব পূর্ণিমা।”
লেখক:
শোয়াইব আহমেদ নিলয়
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।