আবু বকর ছিদ্দিক, মহেশখালী :
কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ীর মাঝখানে অবস্থিত কোহেলিয়া নদী । সৃষ্টি কালের যুগ যুগ ধরে বহমান হয়ে জোয়ার-ভাটায় অাপন গতিতে চলছে কোহেলিয়া নদীর স্রোত । কিন্তু অচিরেই কক্সবাজার তথা বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে এ নদীটি । সম্প্রতি কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১৪’শ ১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে । অার সে প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য ও পলি মাটি গুলো পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীর উপর ফেলায় দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে এ নদীটি । ফলে ঐ নদীর উপর চলাচল কারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট সহ বিভিন্ন ধরনের নৌ-যান চলাচলে বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে । কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্য নদীতে ফেলার নিয়ম না থাকা সত্বেও তারা কোন ধরনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে প্রকল্পের ব্যবহারিত দূষিত বর্জ্য গুলো পাশ্ববর্তী কোহেলিয়া নদীতে ফেলছে । এদিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সাথে মিশে গিয়ে বর্তমানে নদীর পানি ঘোলাটে এবং দূষিত হওয়ায় প্রায় শতাধিক চিংড়ি মাছের প্রজেক্টের মাছ মারা যাচ্ছে । একারনে চলতি চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদাররা কয়েক’শ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে জানান চিংড়ি ব্যবসায়ীরা । দিন দিন ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে নদীটি নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে । নদীর পানি ঘোলাটে ও ভরাট হয়ে যাওয়ার কারেনই অাগের মত তেমন অার জেলেদের জালে মাছও ধরা পড়ছেনা । ফলে এ নদীর উপর নির্ভরশীল জেলে সহ হাজারো অধিক লোকজন তাদের পেশা হারিয়ে বেকারত্ব হওয়ার অাশংকা সচেতন মহলের । বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ , বাংলাদেশে ছোট বড় প্রায় ২৫০ টিরও বেশী নদ-নদী রয়েছে , অার এ নদীর উপর লাখ লাখ মানুষ তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন । তেমনি কক্সবাজার জেলার অারেক পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ নদী হচ্ছে মহেশখালীর কোহেলিয়া নদী । বর্তমানে এ নদীর উপর নির্ভরশীল উপজেলার কয়েক হাজার জেলে পরিবারের নারী-পুরুষ রয়েছে । কিন্তু এ নদী দিন দিন ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় জেলেদের জালে অাগের মত তেমন অার ধরা পড়ছেনা সামুদ্রিক মাছ । মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ হওয়ার সুবাদে সেখানে নিরাপত্তার উজুহাত দেখিয়ে কোহেলিয়া নদীতে জেলেদের মাছ ধরাও নিষেধ করে দিয়েছে প্রকল্প নির্মাণ কর্তৃপক্ষ । তাই তাদের একমাত্র পেশা হারিয়ে এ নদীর উপর নির্ভরশীল অনেক জেলে এখন বেকার হয়ে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সিমাহীন কষ্টে দিন যাপন করে যাচ্ছেন । অন্যদিকে এ নদীর উপর দিয়ে চলাচল কারী ইঞ্জিনজাতীয় নৌ-যানও বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে । নদী ভরাটের কারনে ভাটার সময় ছাড়াও পূর্ণ জোয়ারেও এখন বড় ও মাঝারি লবন বোট চলাচল করতে পারছে না । অাগে এ নদীতে দেখা যেত পাঁচ হাজার মণ ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন লবনের বোট চলাচল করলেও এখন সে বড় ও মাঝারি কোন ইঞ্জিন জাতীয় নৌ-যান চলাচল করতে পারছে না । শুধু তাই নয় এ নদীর উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের একমাত্র অায়ের উৎস হারিয়ে যাওয়ার অাশংকা করছেন স্থানীয় সচেতন মহল । এদিকে নদীতে জেগে ওঠা চর গুলো একের পর এক খন্ড খন্ড ভাবে ঘের নির্মাণ করে দখলে নিচ্ছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভূমি দস্যুরা । তারা প্রথমে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করে নদীর চর অবৈধ ভাবে দখল করে নিচ্ছে , ফলে দিন দিন ছোট হয়ে অাসছে কোহেলিয়া নদী । এভাবে একের পর এক ভূমি দস্যুরা নদীর চর দখলে নিলেও এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের । মাতারবাড়ী উত্তর রাজঘাট এলাকার মুরুব্বি অাবুল কাসেম জানান , অামরা ছোট বেলা থেকে দেখে অাসছি এই নদীটি গভীর ও বিশাল অাকার ছিল অার মাছ পাওয়া যেত প্রচুর । এখন এই নদীটি দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় একদিকে মাছ শুন্য হয়ে গেছে অন্যদিকে নদী ভরাটের কারনে পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে বন্যার সৃষ্টি হয় । ইউনুছখালীর ব্যবসায়ী মোছাদ্দেক ফারুকী বলেন , কোহেলিয়া নদীটি যেভাবে দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয় ভবিষ্যতে এ নদীর অস্থিত্ব থাকবে না । অাগে এ নদী দিয়ে বড় বড় লবন বোট চলাচল করলেও এখন বড় বোট ছাড়াও ছোট ছোট লবনের বোটও অার অাসতে পারছেনা । এ কারনে লবন অানলোড করতে ব্যাপক হিমশিম খেতে হচ্ছে লবন ব্যবসায়ীদের । সরকার এ গুরুত্বপূর্ণ নদীটি ড্রেজিংএর ব্যবস্থা না করলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে লবন চাষী ও ব্যবসায়ীরা । এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে বলেও জানান তিনি । উত্তর মহেশখালী উন্নয়ন ফোরামের অাহবায়ক ও মহেশখালী উপজেলা অাওয়ামীলীগের সদস্য মোঃ হাসান বশির বলেন , কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় মারাত্বক প্রভাব পড়ছে নদীর দু-পাড়ের চিংড়ী প্রজেক্ট ও লবন চাষিদের । শীঘ্রই এ নদী ড্রেজিংএর ব্যবস্থা না করলে শত শত চিংড়ী প্রজেক্ট ও চাষিদের লবন মাঠে পানি নিষ্কাশনে বাঁধা গ্রস্থ হবে , এতে একদিকে যেমন দেশে লবন ঘাটতি দেখা দিবে অন্য দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চিংড়ী মাছ ও কাঁকড়া ব্যবসায়ীরা অার প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার । সম্প্রতি সারা বাংলাদেশে অবৈধ ভাবে দখল হওয়া নদী পুনঃরুদ্ধার ও ভরাট হওয়া নদী গুলো ড্রেজিংএর ব্যবস্থা করা হলেও মহেশখালীর কোহেলিয়া নদীর দখলদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং নদীর ড্রেজিং না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এই অঞ্চলের মানুষ গুলো । পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় তাদের ভুমিকা কে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন অত্র অঞ্চলের লোকজন । বাংলাদেশ পরিবেশ অান্দোলন (বাপা’র) যুগ্ন সম্পাদক বিশিষ্ট পরিবেশবিদ শরীফ জামিল বলেন , যে কোন কারনে কোহেলিয়া নদী মারা গেলে এখান কার শত শত জেলে এবং লবন চাষী ও ব্যবসায়ীর জীবন হুমকির মূখে পড়বে । কাজেই প্রকৃতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উল্লেখ করে তিনি বলেন , কোহেলিয়া নদীর অাশে পাশে চলমান অপরিকল্পিত ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করাসহ যতাযত ভাবে কোহেলিয়া নদীর সিমানা নির্ধারণ করে তা উদ্ধার করা উচিৎ বলে মনে করেন এ পরিবেশবিদ ।